আরাফাত : বিশ্ব মুসলিমের মিলন কেন্দ্র

হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »

আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনই সমস্ত প্রশংসার প্রকৃত মালিক, যিনি এ বিশ্বব্রহ্মা-ের সৃষ্টিকর্তা ও সকল প্রাণির রিযিকদাতা। তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করি, যিনি তাঁর ইবাদতের জন্য পবিত্রতার শর্তারোপ করেন। তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি, যিনি অকৃতজ্ঞ ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না।
আল্লাহ্ এক, অদ্বিতীয়। তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই। তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। তাঁর প্রভুত্বে কারো কোন অংশীদারিত্ব নেই। আমাদের কা-ারী, সত্যের দিশারী সায়্যিদুনা হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র বান্দা ও তাঁরই রাসূল।
আল্লাহ্ তাআলার মাখলুকাত বা সৃষ্টিকূলের তিন অবস্থা রয়েছে। যথা, স্থান, কাল ও পাত্র। এগুলোর মধ্যে অনেক কিছু আমাদের কাছে পবিত্র ও সম্মানিত। আমাদের দৃষ্টিতে সম্মান ও মর্যাদার মানদ- হচ্ছে সম্পর্ক। সহজ কথায়, আল্লাহ ও রাসূলের সাথে সম্পর্কিত স্থান, কাল ও ব্যক্তিগণ আমাদের কাছে সম্মানিত, সমাদৃত। আল্লাহ্ ও রাসূলের প্রতি বিশ্বাসী বান্দাগণও সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘সম্মান তো আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনদের জন্য, কিন্তু মুনাফিকদের তা জানা নেই’। (৬৩:৮) আবার যে সকল বস্তু বা প্রাণি আল্লাহ্র কুদরতের নির্দশনবহ, এগুলোও তা’যীম বা সম্মানের অধিকারী। যেমন ‘সাফা-‘মারওয়া’ নামের পাহাড়দ্বয়, কুরবানীর প্রাণিগুলোকে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্র ‘নিদর্শন’ বলা হয়েছে, আবার এগুলোকে সম্মান করা অন্তরের ‘তাকওয়া’ হিসাবে বিবেচিত হয়েছে।
সুরা মা-ইদাহ্’র ২য় আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহ্র নিদর্শনাদির মর্যাদাহানিকে হালাল (বৈধ) সাব্যস্থ করো না। না সম্মানিত মাসকে, না হেরমে প্রেরিত প্রাণিগুলোকেও, না কণ্ঠাভরণ-ঝুলানো পশুগুলোকে, আর সেসব লোকদের মান-সম্মানেরও অবমাননা করোনা, যাঁরা সম্মানিত ঘর (বাইতুল্লাহ্র)র উদ্দেশে নিজ প্রভুর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টির জন্য এসেছে’। বর্ণিত বিষয়াদি আল্লাহ্র কুদরতের নিদর্শন হিসাবে এগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন, শ্রদ্ধা পোষণ করা প্রতিটি মুমিন নর-নারীর ওপর ওয়াজিব। এর ব্যত্যয় করা, অসম্মান করা হারাম। হজ্বের অনুষঙ্গ হিসাবে ‘হাদি’ বা কুরবানী দেওয়ার জন্য আনীত প্রাণি বা পশুগুলোকে নিদর্শন স্বরূপ তা’যীম বা সম্মান প্রদর্শন করা জরুরি হলে, পবিত্র হজ্বের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম যে সকল স্থানে পালন করতে হয়, সে সকল স্থানাদিও নিঃসন্দেহে পবিত্র নিদর্শন। হজ্বের তিন ফরযের মধ্যে প্রধান হল আরাফা’র ওকূফ বা অবস্থান। কাজেই আরাফার ময়দান তো তর্কাতীতভাবে অন্যতম নিদর্শন। তাই, তাও সম্মানিত।
পবিত্র কুরআনের আয়াত’র ভিত্তিতেই আরাফার ওকূফ ফরয সাব্যস্থ হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা (হে কুরাইশ গোত্র ভুক্তরা) ও সেখান হতেই (হজ্বের দিন) প্রত্যাবর্তন করো, যেখান থেকে সকলে (হাজী সাধারণ) প্রত্যাবর্তন করেন। আর (এখানে) আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয়, আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, দয়ালু’। এটি সুরা বাকারার অন্তর্গত ১৯৯তম আয়াতের তর্জমা। আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপট এ রকম, ‘আরবের সর্বোত্তম, অভিজাত বংশ কুরাইশ। কৌলিন্যের শ্রেষ্ঠত্বের কারণে তাঁরা সাধারণের সংশ্রব এড়িয়ে চলত। সর্বসাধারণ হজ্বের দিন আরাফাতে জমায়েত হলেও কুরাইশরা বসে থাকত মুযদালিফায়। সাধারণ লোকেরা যখন আরাফাত থেকে প্রত্যাবর্তন করত, কুরাইশরা তখন মুযদালিফা থেকেই ফিরে যেত। এটা তাদের বংশগৌরব ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করত। এ আয়াতে তাঁদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তাঁরাও যেন অন্যান্য লোকের সাথে আরাফাতে অবস্থান করতঃ একই সাথে ওখান থেকেই প্রত্যাবর্তন করে’ (খাযায়েনুল ইরফান)। এতে পূর্ব প্রথা বিলুপ্ত হয়। হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আলাইহিমাস সালাম)’র সুন্নাতও এটাই। যা ক্রমান্বয়ে অভিজাত শ্রেণি রূপান্তরিত করেছিল এবং সেভাবে চলে আসে। নবীজি ইবরাহীম (আ.)র ধাঁচে তাঁর শরীয়তের অবকাঠামো দাঁড় করান। এ প্রসঙ্গে বুখারী ও মুসলিমে হযরত আয়েশা ‘সিদ্দীকা’ (রাদ্বি.) হতে অনুরূপ বর্ণনা বিদ্যমান। বর্ণিত আয়াতের পূর্ববর্তী আয়াতে সরাসরি আরাফাতের নামও উল্লেখ করা হয়েছে। যাতে প্রধানতঃ আরাফার ওকূফ সম্পন্ন করেই মুযদালিফায় আসতে বলা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘অতএব, যখন তোমরা আরাফাত থেকে প্রত্যাবর্তন করবে, তখন আল্লাহ্র স্মরণ (যিক্র) করো মাশআরে হারামের নিকটে’। ‘মাশআরে হারাম’ কুযাহ্ পর্বতস্থিত জায়গা, যেখানে ইমাম দাঁড়ান। ‘মাশআরে হারাম’ বলে মুযদালিফার কথা বলা হয়েছে। সুরা বাকারার ১৯৮তম এ আয়াতে স্পষ্টতঃ আরাফাত’র নাম উল্লেখ রয়েছে। সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করে মুযদালিফায় আসতে বলা হয়েছে। প্রত্যাবর্তন বা ফিরে আসার বিষয় পূর্ববর্তী স্থানে অবস্থান’র কথা নিশ্চিত করে। আরাফাতে না গেলে ‘ফিরে আসা’র কথা অবান্তর। এ আয়াত দু’টি স্থানের অবস্থান নিশ্চিত করে, ১. আরাফা, ২. মুযদালিফা। প্রথমোক্ত স্থানের অবস্থান বা ওকূফ ফরয, আর শেষোক্ত স্থানের ওকূফ ওয়াজিব।
কুরআন মাজীদে ‘আরাফাত’ শব্দের উল্লেখ হয়েছে বহুবচনে। হাদীস শরীফ ও ফিকাহ গ্রন্থে এক বচনেও শব্দটির প্রয়োগ দৃষ্ট হয়। স্থান একটিই, তবে এটি দ্বারা সয়মকালও বুঝানো হয়। বহুবচনে প্রয়োগকৃত হলে নির্দিষ্টস্থানের নামই উদিষ্ট হবে। আর এর বিভিন্ন দিকে বিস্তৃতি পাওয়ায় বহুবচনে প্রয়োগ বলেও অনেকে মন্তব্য করেন। (লুমআত দ্র.) মক্কা মুকাররামা হতে পূর্বদিকে প্রায় নয় মাইল এবং মিনা হতে প্রায় ছয় মাইল দূরবর্তী বিস্তৃত এক ময়দানের নাম আরাফাত। ৯ যিলহজ্ব বেলা দ্বিপ্রহরের পর সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলার পর হতে পরদিন সুবহে সাদিক’র আগ পর্যন্ত যে কোন সময় এ ময়দানের যে কোন প্রান্তে কিছুক্ষণ অবস্থান করা হজ্ব’র প্রধান রুকন। সেটা এক লহমার জন্য হলেও হজ্বের ফরয আদায় হয়ে যাবে। হজ্বের অপর দু’ ফরযের কথা আমরা জেনেছি যে, প্রথমতঃ ইহ্রাম, আর ১০ যিলহজ্ব হতে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে যে কোন সময় তাওয়াফ সম্পন্ন করা। ‘আরাফা’ শব্দের অর্থ পরিচিতি, চেনা, জানা। দ্বাহ্হাক’র অভিমত, আদি পিতা হযরত আদম ও মা হাওয়া (আলাইহিমাস সালাম) বেহেশত থেকে দুনিয়ায় চলে আসার সময় পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। দীর্ঘদিন তাঁরা একে অপরের সন্ধান করতে থাকেন। এক পর্যায়ে আল্লাহ্র ইচ্ছা হলে তাঁরা পরস্পরের সাক্ষাৎ পান যিলহজ্ব মাসের ৯ তারিখ। যেখানে তাঁদের উভয়ের দেখা হয় সে ঐতিহাসিক স্থানটিরই নাম আরাফাত। এখানে তাঁদের সাক্ষাৎ হলে তাঁরা পরস্পরকে চিনতে পারাতে স্থানের নাম আরাফাত হিসাবে প্রসিদ্ধি পায়। যেদিনে তাঁদের এ সাক্ষাত ঘটে দিনটিরও নাম হয় ইয়াওমে আরাফাহ্। (খাযাইনুল ইরফান)
এমন একটি প্রসিদ্ধি আছে যে, ই’তিরা-ফ (আরবী) শব্দ ‘আরাফা’ উদ্ভূত। পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে মুসলমান নর-নারী এখানে এসে আল্লাহ্র কাছে নিজ নিজ গুনাহ্ বিচ্যুতির ই’তিরাফ বা স্বীকারোক্তি দিয়ে তাঁর জন্য অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এ কারণে এর নাম হয় আরাফা। আদম-হাওয়া (আ.) ও এখানে এসে নিজেদের বিস্মৃতির কথা স্বীকার করে আল্লাহ্র নিকট প্রার্থনায় বলেছিলেন, ‘রাব্বা-না যোয়ালামনা আনফুসানা’, তাই এ ময়দানের নাম হয় আরাফা। অথবা, এদিন এখানেই এসে তাঁদের উভয়ের তাওবা কবুল হয়। এ সম্পর্কে আরেকটি অভিমত এমনও আছে যে, জিব্রাঈল আমীন (আ.) হজ্ব পালনের আহকাম সমূহ হযরত ইবরাহীম (আ.) কে শিখিয়ে দিলেন। এরপর তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হাল আরাফতা’- অর্থাৎ আপনি কি হজ্বের করণীয় কাজগুলো বুঝে নিয়ে, স্থানগুলো চিনে নিয়েছেন? তিনি ইতিবাচক উত্তর দিলেন। এ ‘আরাফতা’ শব্দভিত্তিক স্থানটির নাম হয়ে যায় ‘আরাফা’। [ড. ইলিয়াস আব্দুল গণি কৃত ‘তারীখে মক্কা মুকাররামা]
আরাফাতেই রয়েছে জবলে রহমত। এখানে দুআ কবুল হয়। আদম-হাওয়া (আ.)র প্রার্থনাও কবুল হয়েছে। আরাফার ময়দানেই পবিত্র কুরআনের সেই ঐতিহাসিক ঘোষণার শেষ আয়াত অবতীর্ণ হয়, ‘আল-ইয়াওমা আকমালতু লাকুম দ্বীনাকুম’ (অর্থাৎ আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম)। এই সেই আরাফাত, যেখানে লক্ষাধিক সাহাবী সমেত মহানবী (দ.) তাঁর বিদায়ী হজ্ব’র ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, ঘোষিত হয় দ্বীন’র পূর্ণতার ঐশীবাণী।

লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।