নববর্ষ ১৪৩১: থাকুক সুখে বাংলাদেশ

মোহীত উল আলম »

২১শে ফেব্রয়ারি এলে যেমন আমরা সর্বস্তরে যে বাংলা ভাষা চালু হতে পারেনি সেটি নিয়ে আক্ষেপ করি, তেমনি পহেলা বৈশাখ এলেও একটি অস্বস্তি থাকে যে আমাদের জীবনযাপন বাংলা সন তারিখ অনুযায়ী চলে না। শুধু বাংলা সন তারিখ দিয়ে যদি বিয়ের কার্ড ছাপানো হয় ও বিলি করা হয়, আমন্ত্রিত অতিথিরা ফোন বা মেসেঞ্জারে কিংবা ওয়াটসএ্যাপে জিজ্ঞেস করে করে আমন্ত্রণদাতার জান খেয়ে ফেলবে এ কথা বলে যে কার্ডে বাংলা তারিখ দিয়েছেন, কিন্তু বুঝতে পারছি না সেটা আসলে কোন তারিখ! কিন্তু আপনি যদি  শুধু ইংরেজি (ইংরেজি বলতে আমি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারটিকে বোঝাচ্ছি) সন তারিখ দিয়ে বিয়ের কার্ড ছাপান কেউ ফিরতি জিজ্ঞেস করবে না যে তারিখটা কোন তারিখ। অর্থাৎ ইংরেজিতে তারিখ দিলে বাংলা তারিখ দেওয়া না-দেওয়া অপশনাল, কিন্তু বাংলা তারিখ দিলে ইংরেজি তারিখও সাথে দিতেই হবে।

কিছুদিন আগে একটা চ্যানেলের মাধ্যমে একটি ভিডিও ক্লিপ পেয়েছিলাম। তা’তে ছিল কোন এক জাতীয় উৎসবে সমাগত জনতার কাছে একজন ভ্রাম্যমান সাংবাদিক কিছু তরুণ-তরুণীকে একে একে জিজ্ঞেস করছিলেন ভাষা দিবস কী? স্বাধীনতা দিবস কোনদিন? বিজয় দিবসই বা কোনদিন। সাংবাদিক যাদেরকে জিজ্ঞেস করছিলেন, আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম, কেউই সদুত্তর দিতে পারেনি। একুশে ফেব্রয়ারিকে স্বাধীনতা দিবস, কিংবা বিজয় দিবসকে স্বাধীনতা দিবস ইত্যাদি ধরনের উল্টাপাল্টা জবাব দিয়ে তারা আমাদের আশার হেনস্থা করেছিল। ভিডিও ক্লিপটি যদি বানানো না হয়, তা হলে বলতে হয় জাতির ভবিষ্যত পুরোপুরি অন্ধকার। ভাগ্যিস সাংবাদিক পহেলা বৈশাখ নিয়ে কোন প্রশ্ন করেন নি, করলে কী হতো আল্লাহই মালুম।

তবুও আমার মনে হয়, পহেলা বৈশাখের ব্যাপারে বোধহয় এসব তরুণ-তরুণী ঠিক উত্তরটাই দিতে পারত যে পহেলা বৈশাখ হচ্ছে বাঙলা নববর্ষের প্রথম দিন। জাতীয় উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যান্য দিবসগুলোর সঙ্গে ইতিহাস সচেতনতার প্রশ্নটি জড়িত আছে, তাই এগুলি একত্রে ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কিন্তু পহেলা বৈশাখ হচ্ছে একান্তভাবে সাংস্কৃতিক উৎসব। এটা যতোটা না ঐতিহাসিক, তার চেয়ে বেশি ভৌগোলিক। অর্থাৎ ভূগোল, অর্থাৎ জলবায়ুর পরিবেশ থেকে এই উৎসবের সূচনা হয়েছে। বাংলা নববর্ষ ১৪৩১ শুরু হচ্ছে মানে হলো বাংলা সালের গণনা শুরু হয়েছে আরবী সালের প্রবর্তনের সোয়া শ বছর পরে। জানা যায়, গৌড়ের রাজা শশাংক বাংলা বর্ষের গণনা শুরু করেন। তাঁর রাজত্বের সময়কাল ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে সপ্তম শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত। কিন্তু পহেলা বৈশাখকে বছর গণনার প্রথম দিন বিবেচনা করার কৃতিত্ব দেওয়া হয় স¤্রাট আকবরকে যিনি রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে সুবিধা আনয়নের জন্য হিজরীর বদলে বাংলা তারিখকে প্রাধান্য দেন। হিজরীর তারিখ চন্দ্রদোয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকায় তিনি বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী একটি স্থির তারিখ নির্ধারণ করে দেন–পহেলা বৈশাখ। তখন কৃষকেরা জমি থেকে ধান তুলে ধান বিক্রির পর্যায়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল থাকে বিদায় আকবর উপায় বের করলেন যে তখনই হচ্ছে রাজস্ব আদায়ের শ্রেষ্ঠ সময়।

অন্যদিকে আবহাওয়ার দিক থেকে বললে, পহেলা বৈশাখ জনজীবনের জন্য একটি বেকায়দা দিন। ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্য বইয়ে একটি মারাত্মক কবিতা পড়েছিলাম, যেটা স্মৃতিতে এখনও টুকটাক থেকে গেছে, “ঘাম ঝরে দরদর গ্রীষ্মের দুপুরে / খাল বিল চৌচির জল নেই পুকুরে”। আর আমরা জানতাম, বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য দু’মাস হলো গ্রীষ্মকাল। জলবায়ুর দিক থেকে দেখলে পহেলা বৈশাখ নিছক একটি খটমটে দিন। কিন্তু প্রকৃতির বিচরণের মধ্যে একটি ভারসাম্য থাকে। বৈশাখ খুব গরমের মাস হলেও, এই মাসটিই সবচেয়ে বেশি চিত্তচাঞ্চল্য ঘটিয়েছিল বাঙালী সংস্কৃতির প্রধানতম কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তিনি প্রেমিক প্রেমিকাকে আহ্বান করার সুরে লিখলেন সে বিখ্যাত কবিতা-গানটি “এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো।” প্রাকৃতিক ভূগোল পড়ে আমরা জেনেছি, সূর্য যখন উত্তপ্ত হয়ে একনাগাড়ে অগ্নিচুল্লীর মতো প্রকৃতিকে পোড়াতে থাকে, তখন নীচের ভূমিসংলগ্ন বায়ুমন্ডল হালকা হয়ে ওপরে উঠতে থাকে, এবং ওপরে গেলেই ঠান্ডা আবহাওয়ার সংস্পর্শে গিয়ে সে হালকা বায়ু জমাট বেঁধে মেঘের সৃষ্টি করে, অর্থাৎ জলীয় বাষ্প তৈরি হয়। তখন নীচের গরম বাতাসের সঙ্গে ওপরের মেঘের ধ্বস্তাধ্বস্তির কারণে প্রকৃতিতে ভীষণ নাড়াচাড়া হয়। ঈশান কোণের মেঘ বাইসনের মতো পুরো আকাশ জুড়ে দখলী নেয়, তখন প্রকৃতিতে যে বাত্যাবিক্ষুব্ধ সমারোহ হয়, যার ফলে মুর্হুমুহু বজ্রপাত ও বজ্রনিনাদ সহকারে আউলা-ঝাউলা ঝড় বয়, প্রকৃতির সে ভয়াবহ রূপ জানলা দিয়ে দেখে কবিগুরু আহ্বান জানালেন, হে দানবীয় শক্তি এসো, এসে মানবজীবন থেকে সকল অশুচিকে ঝেঁটিয়ে বিদায় কর। এটাই হলো কালবৈশেখী যেটিকে কবি মানবজগতের ত্রাতা হিসেবে দেখেছিলেন। রবীন্দ্রকাব্য চর্চায় ইংরেজ রোম্যান্টিক কবির শেলীর প্রভাব টের পাবার মতো। শেলী যেমন পশ্চিমা ঝটিকাকে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন ইতিবাচক শক্তি হিসেবে, কবিগুরুও তাই পর্যবেক্ষণ করলেন কালবৈশেখীর ঝাপটের মধ্যে।

প্রকৃতি খুবই ফলদায়িনী হয় বৈশাখ মাসে। একটি প্রিয় ফলের কথা বলি, যেমন ওজনে ভারী, তেমনি ভিতরের অংশে রঙে একেবারে প্রেয়সীর ঠোঁটের লাল লিপস্টিকের মতো। হ্যাঁ–তরমুজের কথা বলছি আমি। আর আমবাগানের দিকে তাকান হাজারে হাজারে আম্রকুঁড়ির বিস্তারিত রূপ পরিণত হচ্ছে আম্রবোলে। আর ফুলের বাগানে লাল, হলুদ, গোলাপী, পীত, বেগুনি, সাদা, খয়েরী আরও কত নাম না জানা ফুলে যে প্রকৃতি ভরে থাকে এ বৈশাখ মাসে! ফলমূলের জগতে যেমন একটি তিড়বিড় করা সৃজনপ্রবাহ চলতে থাকে, তেমনি চঞ্চল হয়ে ওঠে ফুলের মধূপায়ী পতঙ্গসমূহ, যার মধ্যে নানান রঙের পাখাওয়ালা প্রজাপতিই প্রধান। ফুলের পরাগ থেকে মধূ শোঁষার খদ্দের একমাত্র যে প্রজাপতি তা নয়, পাখির জগতের ডানাওয়ালা পাখিগুলো কিচিরমিচির করতে করতে ফুলের ওপর বসে, ফলের ওপর বসে, বসে গাছের ডালে, পাতায়, গ্রামীণ কৃষকের ছনের চালার ওপরে, এমনকি আমাদের শহুরে পাকা আবাসনের কার্নিশে দিব্যি বসে থাকে শালিখ, কবুতর, এবং আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে টিয়া পাখি, সবুজ ডানার হলুদ বাঁকানো ঠোঁটের অপূর্ব পক্ষীসকল।

আচ্ছা, প্রকৃতির এমন উতরোল সময়ে বসে আছে কি মানবগণ? না, বৈশাখ রুদ্র হলেও কাকতালীয় ভাবে এর আছে মোহনীয় রঙিন রূপ, সেই রূপের প্রতি আকর্ষিত হয়ে “আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে” গাইতে গাইতে আমাদের তরুণীরা সাদা শাড়ি, কালো পাড়, কিংবা লাল শাড়ি, কালো পাড়, চুলেতে বাহারী ফুলের মুকুট পরে, ঠোঁট লাল করে, মুখেতে আবীরের রং মেখে, হাতে শতসহস্র রঙের কাচের চুড়ি পরে, আর পায়েতে আলতা মেখে যখন গান গাইতে গাইতে দলে দলে বৈশাখী উদযাপনের অনুষ্ঠানে সমবেত হয়, তখন প্রকৃতিই অবাক হয়ে চেয়ে থাকে–এত সুন্দর এই বাংলাদেশের মেয়েরা! আচ্ছা ছেলেরা কেন পিছিয়ে থাকবে? তারাও সুশোভন রঙের পাঞ্জাবী পরে, দাড়ি কামিয়ে অথবা না কামিয়ে, মুখে একটা পরিতৃপ্তির হাসি বজায় রেখে মঙ্গলশোভায় যোগ দেয়। এই মঙ্গলশোভা আমার দৃষ্টিতে পৃথিবীতে এই জাতীয় অনুষ্ঠানের মধ্যে সেরা। হুতোম পেঁচা, হাতী, ঘোড়া, বাঘ, ময়ুর, কোন দানব, কোন দানব ধ্বংসকারী দেবতার বিরাট বিরাট মূর্তি (কাগজ আর কঞ্চি দিয়ে বানানো) নিয়ে যখন “এসো হে বৈশাখ” গাইতে গাইতে মিছিলগুলো চলে, তখন মোবাইলগুলো সচল হয় লাইভ ভিডিও করতে। এই আনন্দের সমাপ্তি হয় পহেলা বৈশাখের নানানরকমের প্রসাদবস্তু দিয়ে। পান্তাভাত-ইলিশমাছ, রাবড়ি-দই, লুচি-মাংস, কুলফি আইসক্রিমসহ বহুবিধ রসনাতৃপ্তিকারী খাবার। আর মেলা বসে কুটির শিল্পের, যেখানে ছোটবেলায় আমার অত্যন্ত প্রিয় ছিল টমটম গাড়ি। মাটির চাকা, চাকার মতো ছোট্ট একটা ঢোল, তাতে বাড়ি পড়ছে হালকা একজোড়া কাঠির, অথচ কানে তালা দেওয়ার মতো ভীষণ শব্দ।

কিন্তু দারীদ্র? পহেলা বৈশাখের এই উন্মাতাল উদযাপনের দিনে দারীদ্রের স্থান কোথায়? অথচ বৈশাখের সমস্ত উদ্বোধনের সূতিকাগার হচ্ছে কৃষকসমাজ, হতদরীদ্র কৃষককুূল, যাদের এখনও পান্তা আনতে নূন ফুরোয়। তাদের কি কোন উপায় আছে যে বৈশাখ যে এমন নয়নাভিরাম দৃশ্য তৈরি করেছে কুলীন সমাজে সে খবর রাখার? এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা যে আমরা জাতীয় দিবস বলতে যে সকল উৎসব উদযাপন করি সেগুলো একান্তই শহুরে মধ্যবিত্ত ইতিহাস-সচেতন জনগোষ্ঠীর দ্বারা উদযাপিত হয়। কিন্তু বস্তুত বৃহত্তর জনজীবনের সঙ্গে এগুলির সম্পর্ক খুব নিকট তা মনে হয় না। অন্তত পরিবেশে সেদিনগুলোতে এরকম কথা মনে হয় না যে আমরা যেমন ফেইসবুক ফাটিয়ে ফেলি অভিননন্দন আর শুভেচ্ছা জানাতে, তার বিন্দুমাত্র উৎসাহ বৃহত্তর জনজীবনে প্রতিফলিত হচ্ছে। ধর্মীয় উৎসবগুলোতে সম্প্রদায়-নিরপেক্ষভাবে যেমন একটা মাতামাতি তৈরি হয়, সেদিক থেকে জাতীয় অনুষ্ঠানগুলো তুলনামূলকভাবে তৃতীয় পর্যায়ের সাড়া জাগানো।

এটির প্রধান কারণ অর্থনৈতিক, দ্বিতীয় কারণ ইতিহাস সচেতনতা তথা শিক্ষার অভাব। এটা বলা হচ্ছে যে বাংলাদেশে বর্তমানে ধনী-দরীদ্রের মধ্যে তফাৎ বহুগুণে বেড়ে গেছে। এটাও বলা হচ্ছে যে কৃষিখামার সহ মৎস্যসম্পদ ও গবাদিপশুর উৎপাদন একটি উন্নয়নমূলক সূচকে পৌঁছালেও জনজীবনের দারীদ্রসীমানার আশেপাশে থাকা জনগোষ্ঠীর ভাগ্য অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। অর্থাৎ, অর্থনীতির ভাষায় বলতে হয়,  নতুন উদ্যোক্তা শ্রেণি নতুন শোষকসমাজে পরিণত হচ্ছে। সম্পদ উৎপাদনের বলয় বেড়েছে, কিন্তু এটি উলম্বন গতিতে এগোচ্ছে, আনুভূমিক গতিতে বাড়ছে না। অর্থাৎ, নব্য পুঁজিবাদী সমাজ তৈরি হচ্ছে, বা হয়ে গেছে, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষের সম্পদের নি:স্বতাও বেড়ে গেছে।

তারপরও পহেলা বৈশাখের যুগান্তকারী আবেদন হচ্ছে এই উৎসবটির চরিত্র সবচেয়ে বেশী অসাম্প্রদায়িক। সকল ধর্মের লোক এই দিনের অনুষ্ঠানাদিতে নি:সংকাচে অংশগ্রহণ করতে পারে।

১৪৩১ বাংলা বছর বাংলাদেশের জন্য সকল স্তরে আনন্দ ও সুখ বয়ে আনুক।

লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ