মুকুন্দ দাস : যাঁর গানে ভিত কেঁপেছিল ব্রিটিশ শাসকের

রতন কুমার তুরী »

অবিভক্ত বাংলায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল মূলত ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাধারার বিরুদ্ধে।  প্রকৃতপক্ষে তারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে এদেশে বাণিজ্য করতে এসে চেপে বসেছিল এ দেশের মানুষের ওপরই। তাদের ধারণা ছিল, এদেশের সম্পদ তারা চিরদিন লুণ্ঠন করে তাদের নিজেদের দেশে পাঠাত পারবে। এভাবে তারা প্রায় দুশো বছর শাসন করার পর এদেশ থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু    ব্রিটিশদের ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে  চলে যাওয়া এত সহজ ছিল না। এর জন্য এদেশের মানুষকে করতে হয়েছিল অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম।  এ আন্দোলনের ছিল বিভিন্ন ধরন। কেউ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল তাদের পণ্য বর্জন করে অহিংস পন্থায়,  কেউ করেছিল সরাসরি রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম, কেউ করেছিল ব্রিটিশবিরোধী লেখালেখির মাধ্যমে, কেউবা করেছিল ব্রিটিশবিরোধী গান গেয়ে। লেখনির মাধ্যমে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সফল প্রতিবাদ করেছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আর এ জন্য নজরুলকে কম মূল্য চুকাতে হয়নি। তাঁর প্রকাশিত বই বারবার বায়েজাপ্ত করেছে ব্রিটিশ সরকার। জেলেও যেতে হয়েছিল শুধু লেখনির অপরাধে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সেরূপ আরেকজন অগ্নিপুরুষ হলেন মুকুন্দ দাস। যিনি তাঁর ব্রিটিশ বিরোধী গানের মাধ্যমে অখণ্ড ভারতবাসীকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। তাঁর এমন একটি গানের পংক্তি এমন :

ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে

মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে।

তাথৈ তাথৈ দ্রিমি দ্রিমি দং দং

ভূত পিশাচ নাচে যোগিনী সঙ্গে।’

সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। বাংলায় ঘরে বসে নেই কেউ। অগ্নিঝরা সেই দিনে গানের সম্ভার আর যাত্রাপালা নিয়ে দেশের শোষিত-বঞ্চিত অসহায় মানুষের মাঝে স্বদেশি চেতনার জাগরণ ঘটাতে সমগ্র বাংলা তিনি চষে বেড়িয়েছেন। শুধু গান গেয়েই তিনি ব্রিটিশ  সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি আর কেউ নয় দেশ ও মানুষের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ চারণকবি মুকুন্দ দাস।

পিতার নাম গুরুদয়াল দে আর মাতা শ্যামাসুন্দরী দেবী। বাবা কাজ করতেন বরিশালে ডেপুটির আদালতে। মুকুন্দ দাসের বাবার দেওয়া নাম ছিল যজ্ঞেশ্বর দে। তবে যগা নামেই ডাকতেন সবাই। যজ্ঞেশ্বরের জন্মের পর ঐ গ্রামটি পদ্মায় তলিয়ে গেলে তারা সপরিবারে চলে আসেন বরিশালে। বরিশালের ব্রজমোহন স্কুলে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু। সংসারে অসচ্ছলতার কারণে পড়াশোনা বেশিদূর এগোয়নি।

চাকরি থেকে অবসর নিয়ে গুরুদয়াল বরিশালে একটি ছোট মুি দোকান দিয়েছিলেন। আর এই দোকানটি নিয়েই শুরু হয় মুকুন্দের কর্মজীবন। ছোটবেলা থেকে শুনে-শুনেই গান গাইতে পারতেন। বরিশালের তৎকালীন নাজির বীরেশ্বর গুপ্ত একটি কীর্তনের দল গঠন করেছিলেন। ১৯ বছর বয়সে সেই দলে যোগ দেন যজ্ঞেশ্বর। অল্পদিনের মধ্যেই তার গায়করূপে সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। বৈষ্ণব-সন্ন্যাসী রামানন্দ অবধূত যজ্ঞেশ্বরের গলায় হরিসংকীর্তন ও শ্যামাসঙ্গীত শুনে মুগ্ধ হন। রামানন্দ সাধুর নিকট  থেকে বৈষ্ণবমন্ত্রে দীক্ষা নেওয়ার পর যগার নাম হয় মুকুন্দ দাস।

একসময় মুকুন্দ দাস নিজেই একটি কীর্তন দল গড়ে তোলেন। বিভিন্ন পূজাপার্বনে কীর্তনের এই দল নিয়ে বরিশালের বিভিন্ন স্থানে তাঁকে যেতে হতো। এভাবে অনেক কীর্তনীয়া দলের সাথে তার সখ্য গড়ে উঠে।

সনাতন চক্রবর্তী ওরফে সোনা ঠাকুরের প্রেরণায় প্রবল দেশাত্মবাধে উদ্ধুদ্ধ হন মুকুন্দ। দেশের মানুষকে পরাধীনতা ও নানা প্রকার সামাজিক দুর্দশার বিরুদ্ধে সচেতন করার উদ্দেশ্যে এ সময় তিনি গান ও যাত্রাপালা রচনায় মনোনিবেশ করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে বরিশালে ইংরেজবিরোধী বিক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে। মুকুন্দ এ বিক্ষোভে অংশ নেন এবং একের পর এক গান, কবিতা ও নাটক রচনা করতে থাকেন।

স্বদেশী আন্দোলন বিশেষ করে বিদেশিপণ্য বর্জন আন্দোলনে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। ‘বঙ্গনারী রেশমি চুড়ি আর পরো না’ তাঁর এই গানটি একসময় গ্রামে গ্রামে তীব্র উন্মাদনা জাগিয়েছিল। এরপর বরিশালের হিতৈষী পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন মুকুন্দ দাস। সেই সময়ে বিভিন্ন দেশবরেণ্য নেতা এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হন।

এভাবেই এক সময় মুকুন্দ দাস বরিশালের অশ্বিনীকুমার দত্তের সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর আগ্রহে মাতৃপূজা নামে একটি নাটক রচনা করেন। ইংরেজ সরকার মাতৃপূজা নাটকটি বাজেয়াপ্ত কওে এবং তাঁকে কারাগারে পাঠায়। জেল থেকে মুক্তিলাভের পর মুকুন্দ দাস দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও সুভাষচন্দ্র বসুর অনুপ্রেরণায় নতুন করে যাত্রাদল গঠন করে পুনরায় পালা রচনায় মনোনিবেশ করেন। ১৯১৬ সালে চিত্তরঞ্জন দাশের আমন্ত্রণে কলকাতায় যান তিনি। কলকাতায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সাথে দেখা করেন। কবি মুকুন্দকে গান গেয়ে শোনান ও নিজের লেখা কয়েকটি বইও উপহার দেন।  বাংলার জনগণ তাঁকে চারণকবি আখ্যা দেন। গান করে সারাজীবন সাতশোর মতো মেডেল ও বহু পুরস্কার পান তিনি। তাঁর রচনার মধ্যে আছে- সাধনসঙ্গীত, পল্লীসেবা, ব্রহ্মচাারিণী, পথ, সাথী, সমাজ প্রভৃতি।

মুকুন্দ দাস-এর ব্রিটিশবিরোধী গান আজও ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষকে উজ্জীবিত করে।