বৈশাখী জামার জন্য ময়নার বায়না

ফারুক আহম্মেদ জীবন »

কালু দুপুরবেলা বাড়ি ফিরে গা-গোসল দিয়ে খেতে বসলে তার ছয়-সাত বছরের মেয়ে ময়না কেঁদে কেঁদে বায়না ধরেছে তার কাছে। সে এবার ঈদের পর তাদের গাঁয়ের বৈশাখী মেলায় যাবে। তাই তাকে একটা ঘাগরগাঁথা লাল টুকটুকে কুচি দেওয়া বৈশাখী ফ্রক কিনে দিতে হবে। সেই সঙ্গে একটা লাল পাজামা আর জুতা। যে জামা পরে সে এবার ঈদ করবে। আর বৈশাখী মেলায় গিয়ে নাগরদোলনায় চড়বে।

কালু একজন হতদরিদ্র ভ্যানওলা। যার দিন আনা দিন খাওয়া জীবন। বলা যায় সে একেবারে ছাপোষা নিঃস্ব অভাবী গরিব মানুষ। কালু তার ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে রাতদিন কলুর বলদের মতো খাটে। কিন্তু খেটে সে কি করবে?  দুর্ভাগা যে তার জীবনে কি আর কখনো অন্ধকার ঘুচে আশার আলো ফোটে?

তবু কালু যে বড় আশায় বুক বেঁধে নিত্যদিন হাড়ভাঙা ঘামঝরানো, কঠিন খাটনি খাটে। এভাবে দিনের পরে রাত, রাতের পরে দিন আসে। আর কালু সময় গুনতে থাকে। হয়তো কাল প্রত্যুষে সৌভাগ্য আপনা হতে তার দুয়ারে এসে ধরা দেবে। সেই আশায় প্রতীক্ষা তার একটি নতুন প্রভাতের। কিন্তু কালু জানে না কোনো দুঃখীর কপালে কখনো সুখ জোটে না।

আর তাই তো ময়নার জন্মের পরপরই কালুর স্ত্রী অর্থাৎ ময়নার মা- আয়না বেগমও অসুস্থ হয়ে পড়লো। জরায়ু আর মূত্রনালির ইনফেকশনে ভুগছে সে। প্রতিদিন তার জন্য ওষুধ কিনতে হয় কালুকে।

এদিকে ময়না বৈশাখী জামার জন্য বায়না করেই চলেছে। ময়নার মা আয়না বললো, মা ময়না বিরক্ত করো না তোমার বাবাকে।

একটু ধীর-স্থিরভাবে তোমার বাবাকে খেতে দাও।

ময়না বললো, না, আমার জামা কিনে দেবে কিনা বলুক আগে। ময়না কাঁদতে কাঁদতে চোখের-নাকের জলে একাকার হয়ে বলতে লাগলো, ও বাবা … বাবা … বলো না … আমার জন্য লাল বৈশাখী জামা কিনে দেবে তো?

কালু তার ছোট্ট মেয়েটাকে কি করে বুঝাবে যে, গরিবের শখ-আহ্লাদ থাকতে নেই।

এই পৃথিবীতে গরিবের জন্মই হয়েছে বুকভরা আশা নিয়ে স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে জীবনের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে অপূর্ণ স্বপ্নের জন্য দীর্ঘশ্বাসে হাহুতাশ করার জন্য।

কালু মনের কষ্ট মনে চেপে রেখে মেয়ে ময়নার মাথায় হাত বুলিয়ে দুচোখের জল মুছে দিয়ে বললো, ঠিক আছে মা। তোমার জন্য একটা লাল টুকটুকে কুচি দেওয়া ঘাগরগাঁথা বৈশাখী ফ্রক জামা কিনে আনবো। এবার তুমি খুশি তো? এবার চোখের জল মুছে একটু হাসো দেখি। ময়নার কেবল দাঁত পড়ে দাঁত উঠছে। আবার কিছু দাঁত এখনো ওঠেনি। সে দুহাত দিয়ে চোখের জল মুছে তার ফোকলা দাঁত বের করে চান্দের আলো ঝরা

বিশ্বজয়ী হাসি হাসতে লাগলো। আর দুহাত এক করে তালি দিতে দিতে বলতে লাগলো আহা কি মজা, কি মজা … আমার আব্বু আমার জন্য নতুন লাল বৈশাখী জামা কিনে দেবে।

ময়নার ছোট্ট সে কচি মুখের হাসির কাছে সাত রাজার ধন কেনো, পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ এক করলেও সে হাসির সমতুল্য হবে না। কোনো কিছু পাওয়ার আনন্দে অভাবী কোন পিতার সন্তানের মুখের মুক্তাঝরানো হাসি কতোটা সুখের, কতোটা আনন্দের, কতোটা তৃপ্তিদায়ক তা কেবল সেই পিতাই জানে।

কালুর স্ত্রী আয়না বললো, মেয়েকে জামা কিনে দেবে তো বললে। কি করে কিনবে? একে তো নিজেদের খাওয়াই জুটছে না। এই অভাবের মধ্যে …

কালু বললো, ও নিয়ে তুমি চিন্তা করোনা ময়নার মা। দেখবে ঠিক এক উপায় হয়ে যাবে।

মেয়ে ময়না বললো, আব্বু তুমি না খুব ভালো। আর মা আয়নার দিকে ময়না তাকিয়ে বললো, মা তুমি খুব পচা। কালু বললো, না মা ময়না, ও কথা বলতে নেই। তোমার আম্মুও অনেক ভালো।

ময়না বললো, তাই?  আচ্ছা ঠিক আছে। আম্মু তুমিও খুব ভালো। ময়না খেলতে চলে গেলো।

কালু গুছিয়ে তার ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। সে মনে মনে ভাবছে, আজ থেকে তাকে আরো একটু বেশি রাত পর্যন্ত ভ্যান চালাতে হবে। তাহলে তার মেয়ের শখ পূরণ করতে পারবে। এবারের মতো প্রতি বছরই তাদের গাঁয়ে বৈশাখী মেলা বসে। সে দুই-তিনদিন দুপুরে বাড়ি না এসে বাড়তি আয়ের জন্য গাঁয়ের পার্শ্ববর্তী মফস্বল শহরে ভ্যান চালাতে লাগলো। বাড়িতে বউকেও বলে দিয়েছে দুপুরের জন্য তার খাবার রান্না না করতে। দুপুরে কোনো হোটলেও সে খায় না। খুব বেশি তৃষ্ণার্ত আর খিদে পেলে একটু জল খেয়ে নেয়। এভাবে সে না খেয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে থেকে গভীর রাত অবধি ভ্যান চালায়। টাকা জমায় তার মেয়ে ময়নার জামা-জুতার জন্য। রাত পোহালেই ঈদ। আর ঈদের তিনদিন পরেই বৈশাখী মেলা। আর তাই অনেক রাত পর্যন্ত আজ বাজারের দোকানপাট খোলা। কালু গভীর রাত পর্যন্ত ভ্যান চালায়। শেষে মেয়ে ময়নার জন্য একটা লাল টুকটুকে ঘাগরগাঁথা কুচি দেওয়া ফ্রক লাল, পাজামা আর জুতা কিনে

বাড়ি ফিরছে। না খেয়েদেয়ে থাকা শরীরটা বেশ ক্লান্ত। মাথাটা কেমন যেন ঘুরছে। চোখেমুখে অন্ধকার দেখছে সে। দুজন লোক বললো, ভাই সামনের মোড়ে নামবো, যাবেন? কালু ভাবলো, এ পথ দিয়েই তো আমি বাড়ি ফিরবো। যাওয়ার পথে যদি কয়টা টাকা হয় অসুবিধে কি?

সে বললো, উঠেন। মফস্বল শহর ছাড়িয়ে গাঁয়ের অন্ধকার রোড। ভ্যানের সামনে হারিকেন রাখা। তাতে কোনো রকমে পথ দেখার মতো টিমটিম করে আলো জ্বলছে। মাঠের মধ্যে আসলে হঠাৎ পিছন থেকে যাত্রীবেশী ছিনতাইকারী দুজন চাকু বের করে বলে, এই শালা ভ্যান রাখ। দে তোর কাছে যা কিছু আছে, বের কর। কালু তো হতভম্ব। কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না সে। কালু বললো, কে আপনারা? কি করছেন কি? ওরা বললো, আমরা কে বুঝতে পারছিস না? চাকু পেটে ঠেকিয়ে বললো, আমরা

ছিনতাইকারী শালা। দে টাকাপয়সা আর যা কিছু আছে, দে। কালুর পকেট হাতড়ে মাত্র পঞ্চাশ টাকা পেলো। আর একটা পলিথিনে কিছু ওষুধ। আর মেয়ের জন্য কেনা জামাকাপড়-জুতা। কালু বললো, এগুলো নেবেন না। এগুলো আমার মেয়ের জন্য কিনা। আর এই টাকাটা আমি দেবো না। আমার মেয়ে ঈদে মিষ্টি কিনে খাবে। ছিনতাইকারীরা বললো, দে, দে শালা, বলছি দে। না হলে কিন্তু একেবারে জীবনে মেরে ফেলবো।

এভাবে ধস্তাধস্তি করতে করতে একজন হঠাৎ চাকু বসিয়ে দিল কালুর বুকে। কালু চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। কিন্তু মেয়ের লাল বৈশাখী জামা-পাজামা-জুতা ছাড়লো না। কিসের একটা শব্দ আাসতে ছিনতাইকারীরা সটকে পড়লো। কালুর নিথর দেহ পড়ে থাকলো পথে।

সকালে লোকমুখে সংবাদ আসতে কালুর স্ত্রী আয়না মেয়ে ময়নাকে নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে হাজির হলো। অনেক লোকের সমাগম। পুলিশও আছে। কালুর লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লো স্ত্রী আয়না। তখনো কালুর দুহাতে বুৃকের সাথে ধরে রাখা রক্তমাখা মেয়ে ময়নার বৈশাখী লাল জামাকাপড়ের ব্যাগ। ময়না কালুর লাশের ওপর আছড়া-পিছড়া খেয়ে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলো, আমি লাল বৈশাখী জামা চাইনে বাবা। তুমি কথা বলো বাবা। কথা বলো বাবা … কথা বলো।

ময়নাকে অমন আহাজারি করে কাঁদতে দেখে উপস্থিত অন্যদের চোখেও জল এলো।