নিত্যপণ্যের বাজারে অসহায় মধ্যআয়ের মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক »

রেয়াজউদ্দিন বাজারের মাছের দোকানে ঘুরছেন এক মধ্যবয়সী পুরুষ। ৫ থেকে ৬টি দোকানে জিজ্ঞেস করেছেন মাছের দাম। এরপরের দোকানে গিয়ে তিনি কিনলেন পাঙ্গাস মাছ। মাছের দোকানের সামনে কথা হয় এই ক্রেতার সঙ্গে। তার নাম মো. মোয়াজ্জেম হোসেন। চার সদস্য নিয়ে থাকেন রেলওয়ে কলোনি এলাকায়। পেশায় ব্যাংক কর্মকর্তা এ ব্যক্তি বলেন, বিগত পাঁচ বছর আগে ব্যাংকে যে বেতন ছিল, বর্তমানেও একই বেতন। দিন দিন খরচ বাড়লেও বাড়েনি কোন আয়। খরচ বাড়ায় বাসার একটি রুম তিনি এখন সাবলেট দিয়েছেন। মাসে যে বেতন পায়, তার অর্ধেক চলে যায় ঘরভাড়ায়। বাকি অর্ধেক গ্যাস, বিদ্যুৎ বিল, বাচ্চাদের স্কুলের বেতন দিয়ে বাজার থেকে যে ভালো খাবার কিনবো তার কোন উপায় থাকে না। সব মিলিয়ে মাসের শেষ সপ্তাহে হতাশা বেড়ে যায়। গতকাল একই বাজারে কথা হয় ব্রয়লার মুরগি কিনতে আসা আগ্রাবাদ ব্যাংক কলোনি এলাকার শিক্ষিকা ইয়াছমিন আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আগে স্বামীর আয় দিয়ে মোটামুটি পরিবার চালানো যেত। এখন ঐ আয়ে কোন ভাবে সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছে না বলে একটি প্রাইভেট স্কুলে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করি। কিন্তু দুইজনের আয়েও এখন পাঁচ সদস্য নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকা কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এবারে ঈদে বাচ্চাদের পোষাক কিনে দিলেও আমরা পুরোনো কাপড় দিয়েই কোনমতে ঈদ পালন করছি। আমাদের মতো মধ্য আয়ের মানুষের অবস্থা খুবি অসহায়। মাসের শেষে আর্থিক টানাপোড়েনে থাকি।’
এ শিক্ষক আরও বলেন, ‘মাসের বাজার চাল, ডাল, মরিচ কেনার পর, সাপ্তাহিক কাঁচাবাজার করতে রেয়াজউদ্দিন বাজারে আসি। মাছ ও গরুর মাংস দূরের কথা, এখন ব্রয়লার মুরগীও আমাদের মতো মধ্য আয়ের মানুষদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।’

একই বাজারে মাংসের দোকানে কথা হয়, আতিকুর রহমান নামে এক এনজিও কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সামান্য বেতনের চাকরি করি। যা বেতন পায় ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ, বাড়ি ভাড়াসহ সংসারের অন্যান্য খরচ মেটাতে নাভিশ্বাস উঠছে। স্ত্রীকে ছেলেমেয়েদের স্কুলে আনা-নেয়াসহ সাংসারিক বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। কোনো চাকরি করতে পারে না। তবে সে অনলাইনে কিছু ব্যবসা শুরু করেছে। সেখান থেকে অল্পকিছু আয় হয়। এভাবেই কোনমতে টেনেটুনে সংসার নিয়ে চলছি।’
এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘বর্তমান নিত্যপণ্যের বাজারের অবস্থা দিন দিন এমন হলে স্ত্রীকে গ্রামের বাড়িতে পাঠাতে হবে। অসৎপথে তো আয় করতে পারছি না। নিজেরও তেমন জমা নেই। এখন মাসের শেষে এসে দেখি কয়েকটা দোকানে ঋণের বোঝা! নিজেকে বর্তমান অবস্থায় বেশ অসহায় মনে হচ্ছে।’
রেয়াজউদ্দিন বাজারের গলির মুখে কথা হয় রিকশা চালক মো. হোসেন এর সঙ্গে। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে এসে ফিরিঙ্গী বাজারের একটি বস্তিতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘এলাকায় দিনমজুর হিসেবে কাজ করছিলাম। এখন কাজ নেই, তাই চট্টগ্রামমুখী হয়েছি। বস্তিতে একটা রুমে ব্যাচেলর থাকি। মেয়ের বিয়ের জন্য ঋণ হয়েছে ২ লাখ টাকা। প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে কিস্তির টাকা পাঠাতে হয়। এখানে এখন এক প্লেট ভাত ১৫ টাকা। হোটেলে সামান্য সবজি দিয়ে খাবার খেলে বিল আসে ৭০ থেকে ৮০ টাকা। কিন্তু রিকশা ভাড়া বাড়েনি। এ গরমে কারও থেকে ১০ টাকা বাড়তি চাইলেও দেয় না। রিকশা ভাড়া, ঘর ভাড়া দিয়ে হাতে তেমন টাকা থাকে না।’
শুধু ব্যাংক কর্মকর্তা নয়, আরো অনেকের সাথে কথা হলে তারা নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ে হুতাশা প্রকাশ করেছেন। নিজেদের মধ্য আয়ের মানুষ হিসেবে দাবি করে তারা জানিয়েছেন, খরচের সঙ্গে আয়ের ভারসাম্য না থাকায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল, ভোজ্য তেল, চাল, ডাল, মাছ, মাংস, সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকের সংসার সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছেন। অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে নগরীর অন্যতম ভোগ্যপণ্যের বাজার রেয়াজউদ্দিনবাজার সরেজমিনে দেখা যায়, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে খুচরা বাজারে চাল কেজিপ্রতি ৩ থেকে ৫ টাকা, আটা-ময়দার দামও বেড়েছে কেজিতে ৫ থেকে ৭ টাকা। তার মধ্যে পর্যাপ্ত যোগান থাকার পরও ডালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৮ থেকে ১০ টাকা। এছাড়া আদা, রসুন, পেঁয়াজের বাজার রয়েছে স্থিতিতে।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, নাজির ও মিনিকেট মানের সরু চালে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬৪ থেকে ৭৬ টাকা, পাইজাম ও লতা মানের মাঝারি চাল ৫৩ থেকে ৫৮ টাকা আর স্বর্ণা, চায়না ও ইরি মানের মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৫২ থেকে ৫৪ টাকা। যা গত সপ্তাহে কম ছিল প্রায় ৫ টাকার নিচে।
চালের দাম বাড়ার বিষয়ে রেয়াজউদ্দিন বাজারের মো. আলী সওদাগর বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে মৌসুমের ধান বের না হওয়ায় উত্তরবঙ্গের চালের উপর বাজার নির্ভরশীল। পরিবহন ও বিদ্যুৎ খরচ বাড়ায় মিলার পর্যায়ে চালের দাম সাময়িক বেড়েছে। নতুন ধান বের হলে দাম কমে যাবে বলে জানান এ ব্যবসায়ী।
তাছাড়া চালের পাশাপাশি খোলা ময়দা ও আটার দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৪ থেকে ৫ টাকা। গত সপ্তাহে যে খোলা ময়দা বিক্রি হয়েছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় তা গতকাল বিক্রি হয়েছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকায়। আর যে মানের খোলা আটা বিক্রি হয়েছিল ৪২ থেকে ৪৫ টাকায় তা এখন ৪৭ থেকে ৪৫ টাকায়।
ব্যবসায়ীরা বলেন, গম আমদানি খরচ বাড়ার কারণে ময়দা ও আটার দাম বাড়তে শুরু করেছে।
এদিকে চাল, ময়দা ও আটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সপ্তাহের ব্যবধানে সকল ধরনের ডালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৮ থেকে ১০ টাকা। বাজারে ডালের মধ্যে মাঝারি দানার মসুর ডাল বিক্রি হয়েছে ১২০ থেকে ১৪০ টাকা যা গত সপ্তাহে ১১৫ থেকে ১২০ টাকা। আর বড় দানার মশুর ডাল বিক্রি হয়েছে ১১০ থেকে ১১৫ টাকা যা গত সপ্তাহে ছিলো ৯৫ থেকে ১০৫ টাকা। আর ছোট দানার মসুর ডাল ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ১৩৫ থেকে ১৫০ টাকা ।

ডাল ব্যবসায়ীরা বলেন, ঈদকে ঘিরে কমদামে এলসি করা ভারতীয় ডাল, ছোলা আমদানি পণ্য আসার কথা থাকলেও তা পর্যাপ্ত আসেনি। যার ফলে অনান্য দেশ থেকে মসুর, অ্যাংকর আমদানি করতে হওয়ায় বুকিং রেট বেশি পড়েছে। যার ফলে দাম বেড়েছে।
এছাড়া সপ্তাহের ব্যবধানে চড়া মসলাজাত পণ্য পেঁয়াজ, আদা ও রসুনের বাজারেও কোন পরিবর্তন আসেনি। বাজারে দেশি ও আমদানি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৫৫ থেকে ৭০ টাকা। আর আদা ও রসুন ১৮০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
অন্যদিকে ব্রয়লার মুরগি, গরুর মাংস ও সবজির দাম সপ্তাহের ব্যবধানে কমতির দিকে থাকলেও গত এক মাসের ব্যবধানে এ তিনটি পণ্যের দাম বেশ বাড়তি। গত এক মাসের ব্যবধানে কেজিপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ টাকা বেড়ে গতকাল ব্রয়লার বিক্রি হয়েছে ২২৫ থেকে ২৩৫ টাকা আর সোনালি মুরগি বিক্রি হয়েছে ৩৪০ থেকে ৩৫৫ টাকায়। আর গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে ৮০০ থেকে ৯৫০ টাকা। তাছাড়া মাসের ব্যবধানে প্রত্যেক শাকসবজির দাম বেড়েছে কেজিতে প্রায় ১০ থেকে ১৫ টাকা।
বাজারে টমেটো, শিম, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শালগম, বেগুনসহ প্রায় সকল সবজির দাম ছিলো ৩৫ থেকে ৬০ টাকায়। স্থিতিতে রয়েছে ডিমের দাম। বাজারে প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হয়েছে ১১০ থেকে ১২৫ টাকায়। মাছের বাজারের কোন সুখবর নেই। বাজারে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকার নিচে কোন মাছই মিলছে না।
মাছের বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি রুই ও কাতলা ৩২০ থেকে ৩৮০ টাকা, শিং ও টাকি মাছ ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা, শোল ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা, তেলাপিয়া, কই ও পাঙাশ ১৮০ থেকে ২৫০ টাকা, কোরাল ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা এবং চিংড়ি ৬০০ থেকে ১০০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া এক থেকে দেড় কেজি ওজনের ইলিশ ১ হাজার২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা এবং ছোট ইলিশের কেজি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।