একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এম নুরুল হুদা এবং তাঁর সমাজকর্ম

দাঊদ আরমান »

বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এম নুরুল হুদা বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া ইউনিয়নের বিখ্যাত “বধুর বাপের বাড়িতে” জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫১ সালের জানুয়ারির ৫ তারিখে। অত্যন্ত সরল ও নির্লোভ মনের এই মানুষটি ছোট বেলা থেকেই এলাকার মানুষের অত্যন্ত আদরের পাত্র ছিলেন। তরুণ বয়স থেকেই ওনার কাজের মাধ্যমে বোয়ালখালীর অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। নিজের দেশের জন্য তিনি অনেক অবদান রাখলেও সেগুলো আজকের প্রজন্মের মানুষের কাছে অজানা রয়ে গিয়েছে। ২০২১ সালের ২৮ ডিসেম্বর বিকেলে তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরলোকগমন করেন। আজ তাঁর জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে চাই।
পশ্চিম পাকিস্তানের অপশাসনে নিমজ্জিত সমাজব্যবস্থায় বেড়ে ওঠার দরুন সেই তরুণ বয়স থেকেই ওনার মনের মধ্যে একটা বিপ্লবী চেতনা দানা বাঁধে। ১৯৬৫ সালের কথা। আইয়ুব খানের অপশাসনে বিক্ষুব্ধ বাংলার মানুষ। নুরুল হুদা তখন কধুরখীল উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র, যেটা বর্তমানে সরকারি উচ্চবিদ্যালয়। সেই সময় উনি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর একজন অনুসারী ছিলেন। বিপ্লবের আগুন তাঁর মধ্যে দাউদাউ করে জ্বলতো। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালে আন্দোলন শুরু হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে তখনও কার্যত এটির প্রতিবাদ সরাসরি করা যাচ্ছিলো না। পাকিস্তানি প্রশাসনের ভয়ে তখনও অনেক জায়গায় চুপিসারেই প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে হচ্ছিলো। ঠিক সেই সময়টাতে তরুণ নুরুল হুদা এবং ওনার কতিপয় সঙ্গীসাথী সিদ্ধান্ত নেন যুগান্তকারী একটা উদাহরণ সৃষ্টি করার। পরিকল্পনা অনুসারে ১৯৬৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতের বেলা তারা নিজ বিদ্যালয়ে একটা শহীদ মিনার তৈরি করার দৃঢ় অঙ্গীকার নেন।
নুরুল হুদা এবং তার বিপ্লবী সাথীদের সাহসিকতার ফসল এই শহীদমিনারটিই স্কুল পর্যায়ে নির্মিত বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার। এই শহীদমিনার প্রতিষ্ঠার খেসারত স্বরূপ ওনাকে এবং আবুল হাসানকে বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় বিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত অনুদান।
এভাবে দিন গড়িয়ে চলে আসে মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই সময়টা। ততদিনে নুরুল হুদা বোয়ালখালীতে জনপ্রিয় এক বিপ্লবী ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। যুদ্ধের শুরু থেকেই নিজ এলাকা বোয়ালখালীতে বিভিন্ন মিশনে নেমে পড়েন তিনি। এমনই এক অপারেশনে উনি এবং আরো কিছু মুক্তিযোদ্ধা মিলে বোয়ালখালীর অন্নপূর্ণা হাটের চন্দদের বাড়িতে লুকিয়ে হাতবোমা বানানোর কাজ করছিলেন। এই কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ। বোমা বানানোর সময় ভুলক্রমে হঠাৎ কিছু বোমা বিস্ফোরিত হয়ে অনিল চন্দের সারা শরীর ঝলসে যায়। মুহূর্তেই বিষয়টা পুরো এলাকায় জানাজানি হয়ে যায়। গ্রাম এলাকায় তৎক্ষণাৎ ডাক্তার যোগাড় করাটা দুরূহ ব্যাপার ছিলো। উপরন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের পরিকল্পনায় যুক্ত থাকায় তাড়াতাড়ি নিরাপদ জায়গায় লুকানোর তাড়া ছিলো। গুরুতর জখম অনিল চন্দকে নিয়ে বোয়ালখালীর খরণদ্বীপ থেকে নদীপথে রাউজানের কৈয়েপাড়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ওনারা। কিন্তু ভাগ্য সেদিন সুপ্রসন্ন ছিলো না। এলাকার রাজাকারবাহিনীর সহায়তায় কেরানিবাজার এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক আটক হন নুরুল হুদা এবং আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী আকবর। তাদেরকে ধরে নিয়ে নগরীর চন্দনপুরায় এক টর্চারসেলে নিয়ে আসা হয়। সেখানে অসংখ্য বন্দিদের একসাথে নির্মম অত্যাচার করা হয় দিনের পর দিন। ঘরের সিলিংয়ে উল্টো করে ঝুলিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হতো। কোন তথ্য আদায় করতে না পারায় ওনাদের বেশ কয়েকজনকে কয়েকদিন পর সার্কিট হাউজে এনে পুনরায় নির্যাতন করা হয়। সেই সময় নুরুল হুদা এক কানে শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলেন যার কারণে মৃত্যুর আগ অব্দি উনি অনেক কষ্ট পান। কৌশলে সেখান থেকে পলায়ন করলেও যুদ্ধের শেষ অব্দি উনি সংগ্রাম চালিয়ে যান। নিজ এলাকা পোপাদিয়ায় রাজাকারবৃত্তিতে জড়িত থাকায় নিজের এক নিকট আত্মীয়কে মেরে ফেলার নজির সৃষ্টি করেন উনি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের লাশঘরে পরিত্যক্ত একজন আহত সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসার মতো সাহসিকতা দেখান তিনি।
মহান মুক্তিযুদ্ধের অবসান হলে ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে উনি ন্যাপ ভাসানীর প্রার্থী হিসেবে ধানের শীষ প্রতীকে বোয়ালখালী-চান্দগাঁও আসনে নির্বাচন করেন। ফান্ডের অভাবে বলার মতো কোন প্রচারণা করতে না পারলেও, বোয়ালখালীর মানুষের মাঝে তুমুল জনপ্রিয় হওয়ায় উনি বিপুল ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানলাভ করেন যেটা তার মতো সাধারণ একজন প্রার্থীর জন্য বিশাল এক অর্জন ছিলো। জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ প্রার্থী ব্যারিস্টার কফিল উদ্দিনের কাছে হেরে যান তিনি। অথচ সেই আসনে উক্ত নির্বাচনে সাবেক এমপি মইন উদ্দীন খান বাদল এবং আরো কিছু প্রথিতযশা প্রার্থী জামানত হারান।
১৯৮৪ সালের কথা। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী কাজী জাফরকে বোয়ালখালীতে নিজবাড়ি “বধুর বাপের বাড়ি”তে দাওয়াত করে এনে উনি একরকম একক প্রচেষ্টায় বোয়ালখালীর জনপ্রিয় স্যার আশুতোষ কলেজকে সরকারিকরণ করার ব্যাপারে রাজি করান। অথচ উনি চাইলে নিজের জন্য কিছু একটা চাইতে পারতেন; যেটা অসম্ভব কোন কাজ ছিলো না। তার সেই জেদের ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে কানুনগোপাড়ায় অবস্থিত স্যার আশুতোষ কলেজ সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে। আজও যখন কোন কাজে কানুনগোপাড়ায় যাই, কেন জানি খুব অবাক লাগে। কারণ এই মানুষটাই কিনা নিজের বড় মেয়ের এসএসসি পরীক্ষার ফি যোগাড় করতে পারছিলেন না একসময়। অথচ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিজের জন্য কোন ব্যবসা বা আয়ের ভালো সুযোগ তৈরি না করে তিনি এলাকার উন্নয়নটাকে প্রাধান্য দেন।
২০১৭ সালে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে নিয়ে ভারতের ব্যাঙ্গালোরে একটা হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলাম। অসুস্থ থাকায় ওনার ব্যক্তিগত মোবাইলটা আমার কাছেই ছিলো দীর্ঘ দেড়মাস। এইসময় আমি সাবেক এবং বর্তমান অনেক এমপি, মন্ত্রী এবং বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের ফোনকল রিসিভ করতাম প্রতিদিন, যারা উনার খোঁজ নেওয়ার জন্য কল করতেন। সফল অস্ত্রোপচার শেষে দেশে ফেরার সময় আমি উনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনার এতো মানুষের সাথে পরিচয় আছে, তাহলে আপনি এখনো আপনার বেড়ার ঘরটা পাকা করতে পারছেন না কেন?” জবাবে উনি বললেন, “আমি কখনো কিছু পাওয়ার আশায় কারো কাছে হাত পাতবো না। এই মানুষগুলো আমাকে ভালবাসে আমার ব্যক্তিত্বের জন্য। আমি আমার এই ব্যক্তিত্ব নিজ স্বার্থের জন্য বিসর্জন দিতে পারবো না। সেটা যদি করতামই তাহলে আমার নিজের পরিবার পরিজন এতো দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে যেত না, তারা অনেক সুবিধার মধ্য দিয়ে বড় হতো।“
আজকে বোয়ালখালীর ঐতিহ্যবাহী কালুরঘাট সেতুর পুনর্নিমাণের জন্য চারদিকে কতো আশার বাণী শুনি। উনি মৃত্যুর আগ অব্দি “কালুরঘাট সেতু চাই” আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তিনি চট্টগ্রামের বিখ্যাত অ্যাডর্ন পাবলিকেশন এর অন্যতম পরিচালক ছিলেন। এছাড়া এনজিও প্রত্যাশীর পরিচালনা পর্ষদের সদস্য, বোয়ালখালীর পোপাদিয়া হাওলা উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য, নিজ এলাকার সৈয়দ আবদুল করিম জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবেও উনি দায়িত্বপালন করেন।