‘সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়

সুভাষ দে »

করোনা প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা আমাদের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় এ ব্যাপারে প্রতিরোধ প্রচেষ্টায় শীর্ষ অবস্থানে থাকার খবরে আমাদের মন্ত্রী, সচিব, আমলারা নিশ্চয়ই আত্মপ্রসাদ লাভ করেছেন, মহামারির ব্যাপকতা কিংবা এটিকে নিয়ন্ত্রণ আনতে যে সার্বক্ষণিক নজরদারি কিংবা সতত সকল ক্ষমতাকে মহামারি প্রতিরোধে নিয়োজিত রাখা প্রয়োজন, তাতে তারা অনেকটা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বছরের মার্চের প্রথম থেকেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সম্পর্কে সকলকে সতর্ক করে আসছেন, প্রতিটি বক্তৃতায় বিশ্ব পরিসরে করোনার গতিপ্রকৃতি দেখে আমাদের বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্যবিদগণও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এর আভাস সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণও দিয়েছেন, সেভাবে আগাম প্রস্তুতি ও জনগণকে সচেতন হওযার কথা বলেছেন। ততদিনে করোনার নতুন ধরণ (যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা) আঘাত হানতে শুরু করেছে অথচ আমরা সচেতন হইনি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের যেখানে প্রতিনিয়তই কোভিড-১৯ জাতীয় পরামর্শক কমিটির পরামর্শ সুপারিশ মেনে চলার কথা, সেটি হয়নি। এমনিতেই কারিগরি পরামর্শক কমিটি গঠিত হয়েছে দেশে করোনার সংক্রমণের পর অনেক দেরিতে, তারপরও পরামর্শক কমিটিকে সবসময় সক্রিয় রাখা হয়নি। তাদের পরামর্শও আমলারা তেমন সিরিয়াসলি নেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার বিষয়টি মোকাবেলা বা প্রতিরোধে বৈজ্ঞানিক দিকটিই প্রধান অথচ আমাদের এখানে প্রশাসনিক দিকটিই প্রধান হয়ে উঠেছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় যে সকল ব্যবস্থাদি বা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা সঠিকভাবে প্রতিপালনে প্রথমবারের মতো সিরিয়াসনেস পরিলক্ষিত হয়নি। মৃত্যু ও সংক্রমণ প্রতিদিন যখন রেকর্ড করছে তখন নির্দেশনা বা লকডাউন যেভাবে ঢিলেঢালা চলেছে তা সকল মহল থেকে সমালোচিত হচ্ছে। লকডাউন দেওযা হয়েছে অথচ সরকারি- বেসরকারি অফিস-আদালত, কলকারখানা খোলা রাখা হয়েছে। আবার গণপরিবহন বন্ধ, মানুষ কিভাবে কর্তব্যকাজে যাওয়া আসা করবে? পরে নগরে গণপরিবহন চালু করা হয়েছে। তবে আন্তঃজেলা পরিবহন তথা বাস, ট্রেন, নৌযান, বিমান চলাচল বন্ধ রাখা যুক্তিযুক্ত হয়েছে। কিন্তু লকডাউন ঘোষণার সিদ্ধান্ত শোনার পর ঢাকা ও বড় বড় শহর থেকে মানুষ যেভাবে বাড়ি, গ্রামে ছুটেছে তার ফল হয়েছে ভয়াবহ, সংক্রমণ সকল জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। এখন প্রায় সব জেলাকেও ঝুঁকিপূর্ণ বলা হচ্ছে। ঢাকা মহানগরীতে সংক্রমণ তীব্র হয়েছে। মানুষ সংকটাপন্ন স্বজন নিয়ে হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটেছে, কোথাও আইসিইউ, বেড খালি নেই, এ্যাম্বুলেন্সেই মৃত্যুবরণ করেছেন অনেকে। অসহায় মানুষ চিকিৎসার আশায় ছুটে চলেছে, মিলছেনা চিকিৎসা সেবা-এই পরিস্থিতি প্রশাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
সরকার করোনা চিকিৎসা সেবা উপজেলা পর্যন্ত নিয়ে যেতে এবং জেলা-উপজেলা হাসপাতালগুলিতে আইসিইউ, কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করতে, অন্যান্য সরঞ্জামাদি, ওষুধ সহজলভ্য করতে সময় পেয়েছে। কিন্তু সে সময় যথাযথভাবে কাজে লাগানো হয়নি। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর সংক্রমণ যখন কমে আসছিলো, ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু হয়েছে। তখন থেকেই করোনার প্রতিরোধ প্রতিকারে পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করা প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি। এখনও দেশের জেলা ও বড় বড় নগরের হাসপাতালগুলিতেও কেন্দ্রীয় অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসানো হয়নি। মানুষ রোগী নিয়ে অক্সিজেনের জন্য ছুটাছুটি করছে। জেলাÑউপজেলা থেকে রোগী নিয়ে স্বজনরা ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় নগরের দিকে ছুটছে। জনগণের এ অবস্থায় করণীয় কি, তা বলে দেওয়া হচ্ছে না। জেলা উপজেলায় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা যথাযথ না থাকায় সমস্যা আরো তীব্র হয়েছে।
করোনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা কেবল সরকার বা প্রশাসনের নয়, এতে সামগ্রিকভাবে সকল রাজনৈতিক দল, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, তরুণদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ অথচ তারা জনগণকে সচেতন করতে সক্রিয় হননি। রাজনৈতিক নেতারা দলীয় সমাবেশ অনুষ্ঠান করেছেন। গাদাগাদি করে কর্মী সমর্থকরা নেতাদের পাশে থাকতে চেষ্টা করছেন, অধিকাংশের মুখে মাস্ক নেই, সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই, নেতারা কি এসব বিষয় করোনার জন্য যে বিপর্যয়কর তা কি খেয়াল করেননি? মানুষ ব্যাপকভাবে পর্যটন স্পটে ভিড় জমিয়েছে, বিয়ে শাদী, সামাজিক অনুষ্ঠান, মানববন্ধন, সমাবেশ হয়েছে, কোথায়ও সচেতনতা দেখা যায়নি। হোটেল রেস্টুরেন্টে স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। নগরে তাই করোনার সংক্রমণ ধীরে ধীরে বেড়েছে, অবস্থা এমন হয়েছে যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। প্রশাসন এই দীর্ঘসময়ে জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে তেমন প্রচেষ্টাও নেয়নি। এখনো তা পরিলক্ষিত নয়। এখন লকডাউনের সময় কিছু পুলিশ এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চোখে পড়ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কেন লকডাউনের সময় নিয়োজিত করা হলো না সেটি বিশেষজ্ঞরা উত্থাপন করেছেন। দোকানপাটগুলিতে উপচে পড়া ভিড়, পরিবহনে গাদাগাদি করে লোক উঠছে, নতুন করে কঠোর লকডাউনের কথা শুনে মানুষ ঢাকা ছাড়ছে। এতে সংক্রমণ আরো ছড়িয়ে পড়বে। সময় থাকতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে না পারলে, তা একসময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, জাতি ও জনগণের দুর্ভোগ সীমাহীন হয়ে ওঠে। এই করোনার সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি আরো প্রকট হয়েছে। এখানে দক্ষ, বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের লোকের প্রয়োজন।
আমরা মনে করি, করোনার জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলায় অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনার নেতৃত্বে জাতীয় কমিটি গঠন করে জাতিকে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকার ৬৪টি জেলায় জ্যেষ্ঠসচিব ও সচিবদের যে দায়িত্ব দিয়েছেন দেখভালের, তা খুব একটা কাজে আসবেনা। আমলারা করোনা প্রতিরোধে যার যার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছেন কি? পত্রিকান্তরে প্রকাশ, সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের অর্থ ৬ মাস ধরে বিপুল জনগোষ্ঠী পাচ্ছেন না, আবার করোনার সময় অসহায় দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দকৃত টাকার এক বড়ো অংশ অবণ্টিত রয়ে গেছে। সামনে কঠোর লকডাউনের কথা বলা হচ্ছে, এ সময় দরিদ্র, নি¤œবিত্ত, দিন আনে দিন খাওয়া মানুষের জীবন কিভাবে চলবে যদি দ্রুত ত্রাণ ও অর্থ তাদের হাতে প্রযোজনমতো না পৌঁছায়।
রাজনৈতিক দলগুলি জাতীয় এই দুর্যোগে কেবল সরকারের সমালোচনা করে নিজেরা হাত পা গুটিয়ে বসে থেকেছে। পত্রিকা, টেলিভিশনে মতামত দিলে কর্তব্য সমাধা হবে না। তাদের ওয়ার্ডভিত্তিক কর্মী-সমর্থক-তরুণদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক ব্রিগেড তৈরি করে করোনা প্রতিরোধে ব্যাপক প্রচার প্রচারণায় নামতে হবে, মানুষের পাশে থাকতে হবে। জনপ্রতিনিধিরা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেননি। নগরের প্রতিটি ওয়ার্ডে জনগণের করণীয় সম্পর্কে মাইকিং করা উচিত। সামনে রমজান, এ সময় জনগণের প্রতি সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া বেশি প্রয়োজন। সরকারি দলের উচিত ১৪ দলীয় জোটকে সক্রিয় করে জনগণের পাশে দাঁড়ানো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন ‘জীবনের দাবি সর্বাগ্রে’ এ জন্য জীবিকায় কিছু সংকট হলেও জীবনের প্রয়োজনে তা মেনে নিতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের সহায়তা, প্রণোদনা প্রয়োজন।
আমাদের জাতীয় জীবনে এত দীর্ঘসময় ধরে এত বড় দুর্যোগ আসেনি। তাই আসুন, রাজনৈতিক কর্মী, পেশাজীবী, সমাজকর্মী, এনজিও কর্মী, গণমাধ্যমকর্মী, ছাত্র-তরুণ সকলে মিলে ওয়ার্ড/ইউনিয়ন ভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলি। এ ব্যাপারে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসুন- জনগণ তা চায়। জনগণকে মাস্ক পরিধান, সামাজিক দূরত্ব অনুসরণ, টিকা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করি, সংক্রমিত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে স্বেচ্ছাসেবীর ভূমিকা পালন করি। ‘জীবনের দাবি আজ এতই বিরাট’-এই উপলব্ধি জাগ্রত করি সকলের মধ্যে।
লেখক : সাংবাদিক