আনন্দ, আত্মউজ্জীবন ও আত্মোপলব্ধির বিজয় দিবস

মুস্তাফা মাসুদ»

আমাদের জীবনে কখনো কখনো এমন আনন্দের উপলক্ষ আসে, যা ব্যক্তিক বা পারিবারিক সীমানা ছাড়িয়ে বিস্তৃত হয় বিশাল পরিসরে, ভিন্ন মাত্রা আর তাৎপর্য নিয়ে। সেই আনন্দের উপলক্ষ তখন পুরো জাতিকে আবিষ্ট করে সর্বব্যাপী মোহমুগ্ধতায়; গভীর আবেগে। আমাদের জীবনে এমনি এক সর্বব্যাপী আনন্দের দিন হলো ষোলই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। এই দিনটি কারও একার নয়, সমগ্র জাতির। এটি ছোট্ট পরিসরে যেমন-তেমনভাবে উদযাপন বা স্মরণেরও বিষয় নয়। এই দিনটি আমাদের মহা-উৎসবের দিন। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে উচ্চকণ্ঠে জানান দেয়ার দিন যে, আমরা এক জাগ্রত স্বাধীন জাতি। বিশ্বের মানচিত্রে আমরা এমন এক গরীয়সী দেশকে স্থান দিয়েছি, যে দেশটি সৃষ্টি করতে গিয়ে ত্রিশ লক্ষ মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। প্রায় তিন লক্ষ মা-বোনকে নির্যাতিত হতে হয়েছে। চরম কষ্ট আর অশেষ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে এ দেশের স্বাধীনতাকামী অগণিত মানুষকে। এই যে এত জীবনদান, কষ্ট আর ত্যাগ স্বীকারÑ তার পরেই তো আমরা অর্জন করেছিলাম চূড়ান্ত বিজয়। দীর্ঘ নয়মাসব্যাপী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের শেষে নিশ্চিত হয়ে যায় আমাদের স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের আকাশে উঠেছিল সেই বিজয়ের রক্তিম সূর্য। একসাগর রক্ত আর অবর্ণনীয় কষ্টের বিনিময়ে অর্জিত সেই বিজয় তাই জাতীয় ইতিহাসের এক অক্ষয় ঘটনা; বাঙালির আত্মউজ্জীবনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। শত্রুর সাথে যুদ্ধ করে আজ থেকে অর্ধশতাব্দী আগে আমরা যে বিজয় অর্জন করেছিলাম, পেয়েছিলাম সাতরাজার ধনের চেয়েও মূল্যবান এক মানিকÑ স্বাধীনতা, একটি স্বাধীন দেশ আর একটি পতাকাÑ তার পেছনে আছে এক লম্বা ইতিহাস। অনেক না-পাওয়ার কথা। অনেক শোষণ-বঞ্চনা আর বৈষম্যের কাহিনী। বৈষম্য আর অন্যায়কে বাঙালি কখনো সহ্য করে না। অন্যায়কারীর চোখ রাঙানি আর জুলুম-নির্যাতনকেও সে কখনো পরোয়া করে না। ঠিক এ ব্যাপারটিই ঘটেছিল পাকিস্তানি শাসকদের সাথে বাঙালিদের।
আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশ একসময় ছিলো পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশÑ যা ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করেছিল ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। তখন এর পশ্চিমাংশের নাম ছিলো পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্বাংশের নাম পূর্ব পাকিস্তান, আরও আগে যার নাম ছিলো পূর্ববঙ্গ। তো, পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর পরই বাঙালিরা পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের অন্যায় ও বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হলো। প্রথমেই আঘাত এলো আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষা বাংলার ওপর। পাকিস্তানের বেশিরভাগ অর্থাৎ ৫৬ শতাংশ মানুষের (বাঙালিদের) মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসক কর্তৃপক্ষ বলল যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এতবড় অন্যায় ঘোষণা বাঙালিদের রক্তে আগুন ধরিয়ে দিল। তারা প্রতিবাদে ফেটে পড়ল। তাদের দাবি, উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকেরা বাঙালিদের এ ন্যায্য দাবি তো মানলই না; উল্টো জুলুম-নির্যাতন, শক্তি আর অস্ত্রের জোরে দমিয়ে রাখতে চাইল তাদেরকে। তাতে লড়াকু বাঙালিরা হার মানল না। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তুমুল আন্দোলন গড়ে উঠল ঢাকাসহ সারা দেশে। এরই এক পর্যায়ে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর চালানো হলো গুলি। এতে শহীদ হলেন বরকত, জব্বার, রফিক, শফিউরসহ অন্যরা। সদ্যস্বাধীন পাকিস্তানের একটি অংশের মানুষ অর্থাৎ বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি শাসকদের এহেন নিষ্ঠুর আচরণে সারা দেশের মানুষের মনে প্রশ্ন জাগল: এ কেমন পাকিস্তান! এ কেমন স্বাধীনতা! অথচ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বাঙালিদের অবদানই ছিলো বেশি। সেই দেশে এমন অন্যায় কেউ কি মেনে নিতে পারে? পারে না। বাঙালিরাও মেনে নেয়নি। আসলে পাকিস্তানি শাসকদের উদ্দেশ্যই ছিলো খারাপ। তারা চেয়েছিল, নিজেরা সব সময় প্রভুর মতো বাঙালিদেরকে শাসন করবে, শোষণ করবে; যা ইচ্ছে তাই করবে। বাঙালিরা যাতে শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না পায় তার ব্যবস্থা করা হয় সুকৌশলে। মাত্র একটি ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হলো: সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের শাসনামলে ১৯৬২ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরে বিভিন্ন পদে পশ্চিম পাকিস্তানের লোক যেখানে ছিলো ৬৯২ জন, সেখানে বাঙালি ছিলো মাত্র ৪২ জন। রেডিওতে অবাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ছিলো ৯৮ জন; আর বাঙালি মাত্র ১৪ জন। বিদেশে চাকরির ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণির গেজেটেড অফিসার অবাঙালি ছিলো ১৭৯; আর বাঙালি ৫৮। সেনাবাহিনীতে ব্রিগেডিয়ার পদে অবাঙালি ৩৪; আর বাঙালি মাত্র ১ জন। অথচ জনসংখ্যার হিসাবে বাঙালিদেরই বেশিসংখ্যক পদ পাওয়ার কথা, কিন্তু তা দেয়া হয়নি। এমনিভাবে সর্বক্ষেত্রে বাঙালিদের দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে দীর্ঘ তেইশটি বছর ধরে। এর পাশাপাশি বাঙালিদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনও চলেছে সমান তালে। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ নেতা পাকিস্তানি শাসকদের জুলুম-অত্যাচার আর শোষণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে এ দেশের জনগণকে একতাবদ্ধ করতে থাকেন। এরই এক পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ঘোষণা করেন ঐতিহাসিক ৬-দফা কর্মসূচি, যাতে বাঙালিদের ন্যায্য অধিকারের দাবি তোলা হলো জোরালোভাবে। ৬-দফার পক্ষে সারা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ একতাবদ্ধ হলো। এবার পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবকে ঘায়েল করতে উঠেপড়ে লাগে। ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে তাকে ফাঁসি দেয়ার ফন্দি করলেন সামরিক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। কিন্তু ততদিনে সময় অনেক চলে গেছে। দেশের মানুষ আরও সংঘবদ্ধ হয়েছে। ১৯৬৯ সালে শুরু হয় উত্তাল গণআন্দোলন। সেই আন্দোলনের জোয়ারে ভেসে গেলো আইয়ুবের ক্ষমতার দম্ভ। শেখ মুজিবকে জেল থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলেন তিনি। শুধু তাই নয়, প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাও ছাড়লেন তিনি। তার জায়গায় এলেন আরেক সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান, তিনিও পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী। ইতোমধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন এবং সমগ্র জাতির আশা-আকাক্সক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আর প্রবল আন্দোলনের মুখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া প্রথমবারের মতো পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করলেন ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে। এই নির্বাচনে বাঙালির প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে জয়ী হলো। কিন্তু তার পরও জেনারেল ইয়াহিয়া খান নির্বাচনে বিজয়ী দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তার পূর্বসূরিদের মতোই নানা তালবাহানা শুরু করলেন। একটি দল নির্বাচনে জিতেছে, ব্যাপকভাবে গণরায় পেয়েছে। সেই দলকে যদি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দেয়া না হয়, তাহলে সেই অন্যায় কি মেনে নেয়া যায়? কখনোই যায় না। বাঙালিরাও এমন ঘোরতর অন্যায় মেনে নেয়নি। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত তারা প্রতিবাদ আর ক্ষোভ-বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। এমনই অবস্থায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা করলেনÑ ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ্। এবারের সংগ্রামÑ আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রামÑ স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সারাদেশ তখন আন্দোলনে উত্তাল। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকচক্র আগের বিভিন্ন সময়ের মতো এবারও বাঙালিদের ন্যায্য দাবি মেনে নিল না। ক্ষমতা হস্তান্তর করল না; উল্টো তারা বেছে নিলো দমন-পীড়ন আর মানুষ হত্যার পথ। ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র মানুষের ওপর নির্মমভাবে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হলো অসংখ্য নিরীহ ঘুমন্ত মানুষকে। ঐদিনই মধ্যরাতের পরে তারা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের আগে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ইপিআর-এর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেশবাসীকে প্রতিরোধ-যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। তাঁর সেই ঘোষণাটি ছিলো এরকম : This may be my last message, from today Bangladesh is Independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh. Final victory is ours.’ অর্থাৎ ‘সম্ভবত এটাই আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা যে যেখানেই থাকুন এবং আপনাদের যার কাছে যা আছে তাই নিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দখলদার সৈন্যবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে হবে। যতক্ষণ না দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর শেষ ব্যক্তি বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত হবে, ততক্ষণ আপনাদেরকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। চূড়ান্ত বিজয় আমাদেরই হবে।’ সারাদেশে শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। এদেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র এবং সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ দলে দলে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এমনকি বহু মহিলা এবং অনেক কিশোর-তরুণও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। শুধু এদেশের অল্পকিছু মানুষÑ যারা জাতির সাথে বেইমানি করে; তারা রাজাকার, আল বদর, আল-শামস্ বাহিনী আর শান্তি কমিটির নামে পাকিস্তানিদের পক্ষ নিয়ে গণহত্যাসহ স্বাধীনতাকামী মানুষের ওপর নানান জুলুম-নির্যাতন চালায়। কিন্তু হানাদারদের শেষরক্ষা হয়নি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। তাদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলার মাটিতে যেমন পাকিস্তানি কর্তৃত্বের অবসান হয়, তেমনি চূড়ান্ত হয় আমাদের মহান বিজয়। আমাদের পূর্বপুরুষেরা জীবন দিয়ে এ দেশ স্বাধীন করে গেছেন আমাদেরই নিরাপদ বসবাসের জন্য। এই স্বাধীন দেশে এখন কেউ আর আমাদের মাতৃভাষাকে অপমান করতে পারে না। আমাদের ন্যায্য অধিকার নিয়ে, আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে ষড়যন্ত্র করতে সাহস পায় না। আমাদের রবীন্দ্রনাথকে বাদ দেয়ার কথাও কেউ বলতে পারে না। এই দেশ, এই স্বাধীনতা, লাল-সবুজের এই পতাকা আর আমাদের জাতীয় সংগীত একান্তভাবে আমাদেরই। এই দেশে আমরা মাথা উঁচু করে পথ চলি। হাসি, খেলি, গান গাই। বিজয় দিবস তাই আমাদের আত্মজাগরণের এক মহান উপলক্ষ। এই ঐতিহাসিক দিনে আমাদেরকে শপথ নিতে হবে: আমরা সোনার বাংলার সোনার মানুষ হবো। জ্ঞান-গরিমায় সমৃদ্ধ হয়ে দেশকে গড়ে তুলব সোনার বাংলাদেশ হিসেবে। আর, স্বাধীনতার শত্রুদেরকে আমরা কখনোই ছাড় দেবো না। আমরা আমাদের শপথে দৃঢ় থাকলে সে লক্ষ্য একদিন পূরণ হবে ইনশাআল্লাহ। – পিআইডি ফিচার

লেখক- প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক