করোনার কারণে এবার শীতার্ত মানুষের কষ্ট বাড়বে

কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম »

শীতের বার্তা এসেছে আমাদের দুয়ারে। এদেশে পৌষ ও মাঘ মাস শীতকাল। যদিও আগেভাগেই শীত তার আসার কথা জানান দেয়। দেশজুড়ে শীতের মাস পৌষেই হিমেল হাওয়ায় প্রকৃতিতে নামে নিরবতা। বিরূপ আবহাওয়ার প্রভাব কাটিয়ে সমুদ্র এখন শান্ত। ঠান্ডা হাওয়া আর শুষ্কতার কারণে শীত সকলের প্রিয় ঋতু হলেও করোনা ভাইরাস বিস্তারের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ থাকায় তা এখন আতংকে পরিণত!
বিশ্বজুড়ে এই ভাইরাসের কারণে লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে, আক্রান্ত কোটি কোটি। যে কারণে এই শীতকাল যেন এক ভয়ের নাম। এরপরও তার আবেদন কম নয়।
প্রতি সকালের কুয়াশা আর ঠান্ডা হাওয়া জানান দেয়, শীত আসে সারা গাঁ জুড়ে। পাখিরা গাছের ডালে জবুথবু হয়ে আছে। জমে আছে ঘাসের ওপর শিশির বিন্দু। তবে আগের চেয়ে এখন শীতের আমেজ অনুভব হয় কম সময়। বিশ্বব্যাপী নানা দূষণের কারণে উত্তপ্ত হচ্ছে পৃথিবী। উষ্ণতা বাড়ছে। বাড়ছে সমুদ্রস্তর। ফলে আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে দ্রুতই। স্বাভাবিকভাবে যার প্রভাব পড়ছে আমাদের দেশেও।
প্রতি বৎসর শীতকাল আমাদের মাঝে আসে। আবার চলেও যায়। কিন্তু কষ্ট হয় অসহায় ও দুঃখী মানুষের। যদিও এবার করোনার কারণে দুঃখ-কষ্টটা দ্বিগুণ হবে। বর্ষা ও শীতকাল। এ দুটো কালেই অসহায় মানুষেরা সবচেয়ে বেশি কষ্টে ভোগে। যৎসামান্য সাহায্য তারা পায় তা দিয়ে কোনভাবেই তাদের কুলোয় না। কষ্ট সহ্য করেই দিন পার করতে হয়। শীতে উত্তরাঞ্চল, নগরের ফুটপাত, কারো বাড়ির বারান্দা, দেশের বিভিন্ন রেলস্টেশন ও গ্রামাঞ্চলে দেখা মিলবে অসংখ্য দুঃখী মানুষের। দেখা যাবে, সেথায় তারা খোলা আকাশের নিচে গায়ে ছালা আর শরীরের কাপড় জড়িয়ে কোনমতে শুয়ে আছে। ক্ষণে ক্ষণে ঠান্ডায় কুঁকড়ে উঠছে। পাশে কুকুর, বেড়ালের আনাগোনা। আবার আমরা দারিদ্র্যমুক্ত স্বদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখাই! মানুষের অসহায়ত্বের এমন দৃশ্য আমরা আর দেখতে চাই না। ‘শীতে একটি অসহায় মানুষও কষ্ট পাবে না’-এমন সংকল্প আমাদের নিতে হবে। এমনিতে করোনার কারণে এবার শীতার্ত মানুষের কষ্ট আরো বাড়বে। যে কারণে করোনার এই কঠিন দিনের শীতে শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি।
শীতে অসহায় মানুষের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসতে দেখা যায় অনেককে যা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। কেবল মিডিয়া কভারেজ কিংবা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে যদি এই সাহায্য হয় তাহলে তা কখনো সুফল বয়ে আনবে না। সাহায্য, সহযোগিতা হতে হবে নিঃস্বার্থ, সৎ উদ্দেশ্যপূর্ণ। শীতার্ত মানুষের সাহায্যার্থে প্রথমে এগিয়ে আসার কথা রাষ্ট্রের। নানা সংস্থা, সংগঠনকেও শীতার্ত অসহায় মানুষের পাশে এগিয়ে আসতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে বিত্তশালী ও সামর্থ্যবান সব মানুষকেও। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শীতার্ত দরিদ্র মানুষকে খুঁজে বের করতে হবে।
ওরাতো অসহায়, ওদের কাছে নেই কোন দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো উপাদান! মিডিয়া চাইলে তাদের খুঁজে বের করার উদ্যোগ নিতে পারে। চাইলে গণমাধ্যম কর্মীগণ শীতার্তদের নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন করতে পারেন। দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিত্তশালীদের।
অবশ্য স্ব-উদ্যোগে এবং নির্মোহ মনোভাব নিয়ে অনেকে শীতার্ত মানুষের পাশে এগিয়ে আসেন। যা আমরা বিভিন্নভাবে দেখতে পাই। চেষ্টা করেন সরকারি, বেসরকারি অনেক সংস্থাও। কিন্তু যতটুকু এগিয়ে আসার কথা ততটুকু হচ্ছে না। সমন্বিত উদ্যোগ না নিলে বাদ পড়ে যাবে অনেক দরিদ্র শীতার্ত মানুষ। এজন্য দেশব্যাপী গরিব অসহায় মানুষের একটি তালিকা করা যেতে পারে। এ কাজে প্রয়োজনে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা ও সিটি কর্পোরেশনকেও কাজে লাগানো যায়। তালিকা ধরে প্রত্যেক শীতার্ত মানুষের কাছে শীতবস্ত্র ও আর্থিক সাহায্য পাঠানোর কাজটি সরকার করতে পারে। তবে, শীতার্ত মানুষের এসব বস্ত্র, অর্থসহ সব সাহায্য যেন দুর্নীতিমুক্ত ও সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে সংশ্লিষ্ট দুর্গতজনদের কাছে পৌছাঁয় তা নিশ্চিত করতে হবে। বিতরণ ব্যবস্থা যেন ত্রুটিমুক্ত হয় সেদিকেও নজর রাখতে হবে। অন্যান্য সংস্থাও তাদের মতো করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। অর্থাৎ সমন্বিত একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কাজটি সুসম্পন্ন করতে পারলে দরিদ্র ও অসহায় মানুষকে শীতের কষ্ট থেকে রক্ষা করা যাবে। পাশাপাশি সবাইকে শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। আসুন, সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে করোনাকালের এই শীতে শীতার্ত মানুষের কষ্ট লাঘবে সবাই হাত বাড়িয়ে দিই। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলি যখন শীতের কাপড়-চোপড় দেয়, তখন শীতকাল অনেকটা শেষের পথে। এ ধরণের সাহায্য তাদের প্রয়োজনের সময় দিতে পারলে অর্থাৎ শীত শুরু হওয়ার সাথে সাথেই এ সাহায্য তাদের কাছে পৌঁছানো দরকার। সরকারের কাছে সামাজিক বলয়ে থাকা মানুষের তালিকা আছে। এবার করোনার সময়ও হতদরিদ্রদের তালিকা করা হয়েছে। সুতরাং সরকারের উচিত এখন ঐ তালিকা ধরে শীতবস্ত্র পৌঁছিয়ে দেয়া। নগরে যাদের থাকার জায়গা নেই, এই শীতে তাদের কষ্ট বেশি। সরকারের উচিত তাদের ঠাঁই করে দেওয়া যাতে অন্তত তারা কোনোরকমে বাঁচতে পারে। দেশের প্রতিটি মানুষের অন্ন,বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এই ৫টি মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সরকারের বা প্রশাসনের তা ভুলে যাওয়া উচিত নয়।
করোনার সময় শীতবস্ত্রের পাশাপাশি ত্রাণসহায়তা, পুষ্টি সহায়তা-এর ব্যবস্থা করতে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। বেসরকারি সংগঠনও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। করোনা-আমাদের মানবিক ও সংবেদনশীল হতে যদি না শেখায় তবে অসহায় মানুষ কোথায় যাবে। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের সুখ স্বাচ্ছন্দ তথা বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক