সামাজিক বিশৃঙ্খলা

ড. আনোয়ারা আলম »

সামাজিক নিয়ম শৃঙ্খলা যখন শিথিল হয়ে আসে,সামাজিক মূল্যবোধ ভেঙে পড়ে তখনই সমাজ আবর্তিত হয়। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সামাজিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে একটা আন্তঃসম্পর্ক থাকে অর্থাৎ একটা সম্পর্ক আর একটি সমস্যার জন্ম দেয় যা জটিল সমাজের অস্বাভাবিক অবস্থার বিমূর্ত ধারণা। নানা কারণ এর পেছনে, অর্থনৈতিক, জৈবিক, মানসিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও প্রাকৃতিক কারণসহ আরও অনুসঙ্গ। এর সাথে যুক্ত হয় প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে মানুষের সামাজিক সামঞ্জস্যহীনতাসহ আরও কিছু অস্বাভাবিক অবস্থা। সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন যদি ত্রুটিপূর্ণ হয় তা সমাজে নেতিবাচক প্রভাব এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।
সমাজের কেন্দ্রবিন্দু কিন্তু পরিবার। পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেও আবর্তিত হয় সামাজিক সমস্যা সৃষ্টিতে।
এছাড়া দুর্নীতির বিস্তার, সম্পদ ও সুযোগের অসম বণ্টন যেমন তেমনি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চা ও সুশাসনের অভাবে নানাভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, আর বৃদ্ধি পায় সামাজিক সমস্যা তথা বিশৃঙ্খলা। সমাজ আবর্তিত হয় পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের সামাজিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে।
মূল্যবোধ শব্দটি এখন বহুল আলোচিত যেমন শিক্ষায় মূল্যবোধ, সংস্কৃতিতে মূল্যবোধ, রাজনীতিতে মূল্যবোধ অর্থাৎ যে কোন পরিষেবা ও পণ্য যাকে আমরা মড়ড়ফং ধহফ ংবৎারপবং বলি তার সঙ্গে মূল্যবোধ জড়িত থাকে। অর্থাৎ মূল্যবোধ বিষয়টি এক বিশাল ব্যাপার।
তবে এটি অনস্বীকার্য যে নানাভাবে সামাজিক যে কোন সমস্যা বা বিশৃঙ্খলার পেছনে পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এক বিশাল ব্যাপার। কারণ বিশ্বায়নের স্রোতে জাগতিকভাবে অনেক কিছুর অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটার সাথে ভোগবাদিতার বিকাশ ঘটেছে।
যদি পরিবারের কথা বলি একটা সময়ে যৌথ পরিবার ছিল আমাদের ঐতিহ্য। এটি এখন ভাঙনের পথে। ফলশ্রুতিতে বেড়েছে একক পরিবার; একই সাথে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বা অহংবোধের কারণে স্বামী বা স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদ বা বিচ্ছিন্নতা এবং বাড়ছে একক পরিবার বা লিভ টুগেদার সংস্কৃতি। আর ভগ্ন পরিবারের সন্তানেরাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাদকাসক্ত বা কিশোর গ্যাং এর মতো সমস্যা সৃষ্টি করছে। এমনকি একজন ঐশীর মতো অনেকে হয়তো বাবা ও মাকে নিজস্ব সত্তা থেকে আলাদা করে দিচ্ছে।
ব্রিটিশ শাসনামলের বহুকাল আগে থেকে বাংলার গ্রামীণ সম্প্রদায়ের যে বন্ধন তা ছিল বেশ শক্তিশালী। শাসকের পর শাসক গেছে কিন্তু এই বন্ধনে চিড় ধরাতে পারেনি। এটা ছিল এমন এক গভীর কাঠামো যাকে বলা হতো স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ সম্প্রদায়। যেখানে পারস্পরিক সম্পর্কের একতা ও বন্ধন ছিল এক বিশাল শক্তি। কিন্তু ব্রিটিশ শাসকেরা সুকৌশলে এতে ভাঙন ধরায় আর বিকাশ ঘটে নগারয়নের। ফলশ্রুতিতে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতার উদ্ভব। এই আধুনিক সমাজে নানাধরণের সংস্কৃতি বা অপসংস্কৃতির কারণে আমরা অনেকে নিজেদের পাশে কারা থাকেন বা তাদের সাথে বন্ধন দূরে থাক, অনেকে হয়তো একে অপরের কাছে অচেনা। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সমাজে ও রাষ্ট্রে। আমাদের আবেগ অনুভূতি এতই ভোঁতা, এখন চোখের সামনে কেউ কাউকে হত্যা বা হাইজ্যাক করছে তাতেও নির্লিপ্ত এমনকি সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে বরং অবলীলায় মোবাইলে ভিডিও করে মুহূর্তে ছড়িয়ে দিচ্ছি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
আমরা যাকে মানবিক মূল্যবোধ বলি যেমন দয়া,মায়া,মহত্ত্ব, ভালোবাসা, দুর্বলকে রক্ষা করা, দুর্জনের বিরোধিতা করা, শালীনতা, রুচিবোধ, সহযোগিতা, সহনশীলতা, সত্যপরায়ণতা, সততা এসব গুণাবলি কি ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে!!!
সমাজটা এমন হয়ে গেছে যারা সমাজের বিবেক তথা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় বা সাহিত্যিক কবিরাও অনেকে ব্যক্তিজীবনে নৈতিক মূল্যবোধের ধার ধারেন না, কিন্তু সমাজের অনেকে তাঁদের সেই অপরাধকে ক্ষমার চোখে দেখে। এর চাইতে দুর্ভাগ্য আর কি হতে পারে।
সমাজ মানে মার্জিত পরিশীলিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ সমাজ যা একটা গভীর মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার। তাই সমাজকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত করার জন্য প্রথমে দরকার পারিবারিক সুশিক্ষা; একই সাথে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ মানুষ হিসেবে আমার যা কিছু কর্তব্য আছে সে সম্পর্কে চেতনার বিকাশ ও নিজের শক্তিকে উপলব্ধি করার শক্তিকে জাগ্রত করা। একই সাথে বিজ্ঞান – মনস্কতা, সংস্কৃতি-মনষ্কতা, ও ইতিহাস সচেতনতার মাধ্যমের মাধ্যমে একটা যুক্তিবাদী মন তৈরি করা। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ও সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ ও সুশাসনের মাধ্যমে, সম্পদের সুষম বণ্টনে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র বিনির্মাণে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া।