ভুলের খেলাঘর

রওনক জাহান

ঝড়ের রূপে এলে দিলে সকল শিকল খুলে
আমি এখন মুক্তস্বাধীন বাঁধন-কাঁদন ভুলে

শনিবার, বিকাল পৌনে ছয়টা। সময়টা এক ভয়ংকর ঝড়ের। না, এ ঝড় প্রকৃতিতে নয়, এক সর্বহারা দিকভোলা নাবিকের জীবন নামের জাহাজে জমে থাকা কষ্টের কালো মেঘ, বলা যায় কালবৈশাখীর ঝড়। হঠাৎই আচমকা, বিনা পূর্বাভাসে আছড়ে পড়েছিল, তারই অভাগা বক্ষ ভেদ করে। এই প্রথম হঠাৎই সে আবিষ্কার করল, যে শান্তির আশ্রয় এতদিন তাকে পরম মমতায় আগলে রেখেছিল, সেই আশ্রয়টুকু আজ আর নেই। ঝড়ের কবলে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে তার শান্তির নীড়। শুধু খোলসটুকু পড়ে আছে।
জন্মের পর থেকে আপন বলে যা কিছুকেই আঁকড়ে ধরেছে সে, সবটুকু আজ যেন একবারে শ্মশানভূমি। নিরেট শূন্যে পর্যবসিত হচ্ছে। আজ আর তার জন্য কিছুই অবশিষ্ট নেই। পৃথিবীর একমাত্র আপন আশ্রয়টুকু হারিয়ে আজ সে সম্পূর্ণ বন্ধনমুক্ত, ঠিক যেন ঝড়ে ভেঙে যাওয়া নীড়হারা পাখিটির মতো। আজ সে মুক্তস্বাধীন। আর কোনদিন কোনো বন্ধন হয়তো তাকে বাঁধতে পারবে না। জন্ম থেকে তিল তিল করে গড়ে ওঠা বন্ধনই যাকে বাঁধতে পারল না, তাকে বাঁধার সাধ্য কার। অবশ্য মাঝে মাঝে ভাবে সে, আসলেই কি কোনোদিন তার কোনো বাঁধন ছিল? যেটুকু এতদিন সে তার নিজের আপনবলয় বলে ভেবে এসেছে তা কি কোনোকালে তার ছিল? হয়তো ছিল না, আর ছিল না এই বোধটাকে অবশ করে রেখেছিল যে বস্তুটি তার এইমাত্র মৃত্যু হয়েছে। আর তাই আজ আর তার খারাপ লাগারও কথা নয়। যেটুকু কোনোদিন তার ছিলই না, সেটুকু হারাবার আর কষ্ট কিসের? কিন্তু কি অদ্ভুত! কষ্ট তার হচ্ছে! কিন্তু কেন হচ্ছে? জানা নাই তার। এ হয়তো অভ্যস্ত কোন কিছু থেকে হঠাৎ পৃথক হয়ে যাওয়ার কষ্ট। সময় সব অভ্যাসকে বদলে দিতে পারে। সুতরাং একদিন এটুকুও থাকবে না। আর তার চোখের জল একদিন ঠিকই শুকিয়ে যাবে যখন কান্নার উপলক্ষ খুঁজে পাবে না। সেই পাষাণের জীবন তখন কেমন হবে ভাবতে ভালোই লাগে। সে হয়তো অন্য রকম একটা জীবন। যেখানে একজন মানুষ হাসিকান্না, সুখ-দুঃখ-ইত্যাদি পার্থিব প্রহসন হতে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে যাবে। মহাভারতের কৃষ্ণ একেই বুঝি বলেছিলেন, নির্বাণ লাভ’! তুচ্ছের জন্য এ সংসারে অনেকেই তো বাঁচে, অসীমের সীমা পেতে বাঁচে ক’জন? ও হ্যাঁ, যে ঝড়ের কথা বলছিলাম, তাহলে কেন তাকে ঝড় বললাম? ঝড় তো তাকেই বলে যে পুরোনাকে ধ্বংস করে নুতনের সামনে ব্যতিব্যস্ত থাকে। যা বা যে বস্তু তাকে নতুন করে নতুন জীবনের সন্ধান দিল তাকে ত ঝড় বলা-ই যায়। আর ঝড় যতই ভয়ংকর হোক না কেন, তার তা-বটা কিছুক্ষণের। কিন্তু তার পরবর্তী শান্ত প্রকৃতিটাই স্বাভাবিক ও স্থায়ী। তার জীবনের সবকিছুই একদিন শান্ত ও স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তবে সেই স্বাভাবিকতা ভিন্ন চক্ষুতে অস্বাভাবিকই ঠেকবে। কারণ তাদের স্বাভাবিকতার রূপটাকে যে তার সাথে ঠিক মেলানো যায় না।
অস্বীকার করতে পারবো না, জীবনের পথ চলায় আজ পর্যন্ত অনেক আশ্রয়স্থল আমাকে হাতছানিতে ডেকেছে। কিন্তু কোনোটাই আমার স্থান সংকুলনা করতে পারেনি। আমাকে শুধু দূর থেকে আকৃষ্টই করে গেছে, কাছে যেতেই ভয়ে দুরে সরে গেছে। হয়তো ভেবেছে ‘এই পাষাণের ভার, সাধ্য নাই সইবার’। বহু মানুষের ভালোবাসা আমায় সিক্ত করে গেছে বারবার, আমি তা অনুভব করার সামর্থ্যটুকু হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু আমার তৃষিতপ্রাণ আমায় বারবার প্রলুব্ধ করে গেছে, হয়তো গোপনে তাদের ভালোও বেসেছে কিন্তু আমার পাষাণের শক্ত আবরণ ভেদ করে বাইরে আসার সাধ্য হয়নি কখনও। তাই তো নীরবে, আমার চোখের অগোচরে মাঝে মাঝে তার দীর্ঘশ্বাস পড়ে, আমি টের পাই, কিন্তু কিছুই বলি না। কি আর বলব, তাকে না আমি স্বাধীনতা দিতে পারি, না তার গোপন ঈপ্সাকে দমন করতে পারি। আর তাই এটুকু দীর্ঘশ্বাস যদি তাকে সান্ত¡না জোগায়, তাকে আমি বাধ সাধব কেন? আমি সন্ন্যাসী হতে পারি, কিন্তু সে তো ভেজা তুলা। চাপলেই চুষে চুপসে পড়ে। সে স্নেহ, মায়া-মমতা ভালোবাসা সবকিছুর প্রতিই বড় দুর্বল। যেই মানুষগুলোর ভালোবাসা তাকে বড় কাতর করে তোলে তাদের প্রত্যেককেই আমি ভালো করেই চিনি। তাদের কথা স্মরণ করতেই তার মন যে কতটা ব্যাকুল হয়ে ওঠে তাদের একটিবার শুধু চোখের দেখাটি দেখতে, তাও অনুভব করতে পারি। কিন্তু আমি যে তার মতো ভালোাবাসতে জানি না। ভালোবাসা বুঝতে বা বুঝাতে দুটোতেই আমি অক্ষম। তার এই ভালোবাসার বিবর্ণ পাখায় আমার হয়তো কোনদিনই চড়ে বসা হবে না। কিন্তু আমার যদি সাধ্য থাকত আমি তাকে ঠিক মুক্ত করে দিতাম তার আপনজনদের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্যে। আচ্ছা, আমার অপরাগরতার অপরাধ তার আপনজনেরা কখনও কি ক্ষমা করতে পারবে? তার সেই আদুরে মিষ্টি, সই, তার চিরদুঃখী মা, সেই ছোট্ট আপুনি, যার আবদার রক্ষা করতে তার বড্ড ভালো লাগত, ঢাব্বু মামা আর সেই আঙ্কুরবালা আপামনি, তারপর সোহাইব স্যার, যাকে সে খুব শ্রদ্ধা করত, তারপর তার সেই স্বপ্নের জাদুকর, তারা সবাই আমাকে ক্ষমা করতে পারবে তো? ইশ! কী নিষ্ঠুরভাবেই আমি তাকে তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছি। তারা হয়তো আজও তার জন্য ভীষণ কষ্ট পায়। না, এতদিনে তাদের অনেকেই হয়তো তাকে ভুলে গেছে। তবে হ্যাঁ, তার সেই চিরদুঃখী মা-জননী নিশ্চয়ই তাকে ভুলতে পারেনি। আমি কি বলছি এসব, মা কি কখনও সন্তানকে ভুলতে পারে? তা কি কখনও হয়? তবে সময় হয়তো সন্তান হারাবার কষ্ট কিছুটা হলেও কমিয়ে দিয়েছে। মানুষ কোনো শোকই চিরকাল একই রকম তাজা করে রাখতে পারে না। এটাই প্রকৃতির শিক্ষা!