আয়নাতে ওই মুখ

জোবায়ের রাজু

আয়নার সামনে দাঁড়ালে অহনাকে তার নিজের কাছেই বিশ্বসুন্দরীদের একজন মনে হয়। রূপের কমনীয়তার কোনো ত্রুটি নেই ওই মুখে। হাসলে গালে টোল পড়ে। কোনো এক উপন্যাসে অহনা পড়েছে টোলপড়া হাসির মুখের মেয়েরা মায়াবী হয়। উপন্যাসের ওই লাইনটুকু পড়ে নিজেকে মায়াবতীদের একজন ভাবতে ভালো লাগছে অহনারও।
মহল্লার বখাটে ছেলে অর্ণব। যে কিনা মাদকব্যবসার সাথে জড়িত দীর্ঘদিন ধরে। সেই অর্ণবও অন্য দশটি প্রেমিক পুরুষের মতো অহনাকে মনের সিংহাসনের রানি বানিয়ে রেখেছে। কিন্তু এমন বখাটে প্রেমিক পুরুষের মনের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার মতো মাথা নষ্ট এখনো হয়নি অহনার। জাকির, শফিক, রনি, আরাফাতের মতো সৎ ছেলেদের সবিনয়ে যেখানে ফিরিয়ে দিয়েছে, সেখানে অর্ণবের মতো একটা জুয়াড়ি ছেলের আহ্বানে সাড়া দেওয়াটা অনর্থক বটে। কিন্তু নাছোড়বান্দা অর্ণব। অহনার পথ আগলে দাঁড়িয়ে অনেকটা শপথ করেছে সে এই নষ্টজীবন থেকে সরে আসবে। মনের বাগানের গোলাপ সাজিয়ে রাখবে শুধু অহনাকেই। অতল সমুদ্রে ডুব দিয়ে মুক্তাভরা ঝিনুকটি খুঁজে আনবে শুধু অহনার জন্যই। নিশুতিরাতে দূর আকাশ থেকে সবগুলো নক্ষত্র ছিঁড়ে এনে মালা গেঁথে গলে পরাবে শুধু অহনার। এত আবেগ দেখানোর পরও টনক নড়েনি অহনার। এমন অসৎ ছেলেকে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে জীবনটাকে নরক বানানোর কোনো পদক্ষেপ আপাতত নিচ্ছে না অহনা। তবু কিভাবে যেন কার মাধ্যমে অহনার ফোন নাম্বার কালেকশন করে নেয় অর্ণব। অর্ণবের লাগাতার কলের মধ্যেও প্রেম প্রস্তাব পেয়ে অহনা রাগে-ক্ষোভে বিরক্ত হয়ে অর্ণবের নাম্বারটাই ব্ল¬ক করতে বাধ্য হয়। তারপরও অন্য নাম্বার থেকে থেমে থাকে না অহনার ফোনে অর্ণবের অবারিত কল আসা। উপায় না পেয়ে সিমটাই বদলাতে বাধ্য হয় বেচারি অহনা। একসময় হিংস্র হয়ে ওঠে অর্ণব। অহনার এই রূপের বড়াই দেখে হিংসা লাগে। ওই রূপের সৌন্দর্য এসিডে ঝলসে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে।
কলেজ থেকে ফিরছিল অহনা। পথ আগলে দাঁড়ায় অর্ণব। পূর্বের মতো এবারও ভালোবাসার প্রস্তাব দেয়। এবারও ইতিবাচক সাড়া দেয়নি অহনা। আর তাতেই ঘটে গেল অঘটন। এসিডের ছোট্ট শিশির মুখ খুলে অহনার মুখে ছুঁড়ে মেরে দৌড়ে পালায় অর্ণব। অহনার চিৎকারে কেঁপে ওঠে আকাশ। ক্রমান্বয়ে পুড়তে থাকে মুখের নরম মাংস।
জ্ঞান ফেরার পর অহনা নিজেকে আবিষ্কার করে হসপিটালের বেডে। তার সমস্ত মুখ ব্যান্ডেজে মোড়ানো। অহনাকে যেখানে এসিড নিক্ষেপ করা হয়েছে, তার পাশের একদল যুবক ছেলে তাকে হাসপাতালে এনে মানবিকতার পরিচয় দিয়েছে।
অর্ণব খেয়াল করল তাকে দেখে পাড়ার ইয়ং ছেলেগুলো হাসাহাসি করছে। বিষয়টি দৃষ্টিকটু লাগল তার। এমনকি তাকে দেখে সবাই কি যেন কানাঘুষাও করছে। হঠাৎ অর্ণবের ফোনে বন্ধু রাতুলের কল। ‘কি করছিস অর্ণব?’ অর্ণবের জবাব, ‘কিছু না।’ ওপার থেকে রাতুলের প্রশ্ন, ‘ফিমা কোথায়?’ অর্ণব বলল, ‘ও তো বাসায়, কেন?’ রাতুল কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবার বলল, ‘কিছু জানিস না?’ তাজ্জব কণ্ঠে অর্ণবের জবাব, ‘না তো! কি হয়েছে?’ রাতুল বলল, ‘ইয়ে মানে …! আচ্ছা থাক। রাখি এখন!’ অর্ণব দ্রুত বলল, ‘আহা, বল না কি হয়েছে? হ্যালো … হ্যালো…! ‘রাতুল লাইন কেটে দিয়েছে।
ঠিক আধঘণ্টা পর কঠিন এক বাস্তবতার গল্প শুনল অর্ণব। শুধু কঠিন নয়, লজ্জারও। অর্ণবের ছোটোবোন ফিমা, যে কিনা ভালোবাসে শুভকে। দুবছরের রিলেশন চলাকালে ফিমা শুভকে প্রত্যাখ্যান করে রাহাত নামের আরেক ছেলের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ফিমার এই আচরণ মানতে পারেনি শুভ। তাই সে তাদের প্রেমের মধু অভিসারের দিনগুলোর কিছু অন্তরঙ্গ ছবি নেট দুনিয়ায় ছেড়ে দিলে মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। পাড়ার সব ছেলেমেয়ে ফিমা আর শুভর সেই অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবিগুলো দেখে আর সমালোচনায় মেতে ওঠে।
বোনের এমন কলংকিত ঘটনায় সমাজে মাথাকাটা পড়ে অর্ণবের। পরদিন সকালে ঘটলো আরেক অচিন্তনীয় ঘটনা। ফিমা সেই ছবিগুলোর লজ্জা সইতে না পেরে ফ্যানের সাথে ওড়না পেঁচিয়ে গলায় দড়ি দেয়।
পুলিশ যখন ফিমার লাশটি গাড়িতে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল পোস্টমর্টেমের জন্য, অর্ণব তখন পুলিশের গাড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবে অহনার কথা। অহনার চেহারা এসিডে ঝলসে দেওয়ার অভিশাপ যেন নেমে এসেছে নিজের বোনের জীবনে। প্রকৃতির বিচার এমন।
আজ একমাস ধরে হাসপাতালের বিছানায় পড়ে আছে অহনা। তার পরিবার মামলা করেছে অর্ণবের নামে। অর্ণব এখন পলাতক। কোথায় আছে, কী অবস্থায় আছে, কেউ জানে না।
হাসপাতালের বাথরুমের আয়নার ভেতরে নিজের কুৎসিত মুখখানা দেখে চিৎকার দেয় অহনা। চেহারা এতটাই ঝলসে বিদঘুটে হয়ে যাবে, ভাবতে পারেনি সে।