জীবন কখনও গল্প

জুয়েল আশরাফ

দ্রুতগামী ট্রেনটি হঠাৎ থেমে গেল। একটা ঝাঁকুনি পড়ল আর মাশহুদ ঘুম থেকে ছিটকে এলো। হয়তো কোনো স্টেশন এসে গেছে। মনের ওপর বুদবুদের মতো ওঠা প্রশ্নগুলো থামিয়ে দিল। চোখ মুছতে মুছতে ভারী পায়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে এদিক-ওদিক তাকালো। ট্রেনটি দেশের দক্ষিণাঞ্চল অতিক্রম করে উত্তরাঞ্চলের সীমান্তে প্রবেশ করেছে। গরমের দিন। জ্বলন্ত পৃথিবী। কিছুক্ষণ চুপচাপ সব দেখতে থাকে সে। সামনে থেকে চাওয়ালা আসছে, ওকে ডেকে চায়ে চুমুক দিয়ে নিজের সিটে গিয়ে বসল। বাঁশি ও দোলা দিয়ে ট্রেন চলতে শুরু করল আবার।
আবার ডুব দিল মাশহুদ স্মৃতির সাগরে। ভেতরের আত্মা বেরিয়ে এলো। সেই দৃশ্য তার চোখের সামনে ভেসে উঠল যখন তাকে ব্যাংকের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে।
ব্যাংকের হেড অফিসের সেই বিলাসবহুল আকাশচুম্বী ভবন। সেদিন লিফট থেকে পঁচিশ তলায় উঠতেই তার চোখে পানি এসে গেল। আজ মাশহুদকে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কর্তৃক সংবর্ধিত করার কথা। পঁচিশতলার সাজসজ্জা ও জাঁকজমক দেখে সে স্তব্ধ হয়ে গেল। সবকিছু ফাইভ স্টার হোটেলের মতো জমকালো, সুন্দর এবং সুবিন্যস্ত। সামনে সেই ছবি, যেখানে মন্ত্রীর হাতে বিপুল অঙ্কের চেক হস্তান্তরের সময় হাসছেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান। দেশের অর্থমন্ত্রী অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে তা গ্রহণ করছেন। হলঘরে শোভিত এই ছবিটি মানুষকে আকৃষ্ট করছে। ব্যাংক যে মুনাফা অর্জন করে তার একটি অংশ সরকারকে দেয়া হয়, যাতে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মজবুত হয়। যদিও মাশহুদরা বোনাস পায় না, যা তারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে পায়, কিন্তু তারা দেশের উন্নয়নে অবদান রাখে। দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় তাদেরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এজন্য সে গর্বিত।
এই ছবিটা যতটা পরিষ্কার মনে হয়েছে, বাস্তবে সে রকম নয়, তার বিবেক তা সাক্ষ্য দিচ্ছে। চেকের পরিমাণ ঠিক করে কোথায়, এবং কোন পোস্টে পরবর্তী পোস্টিং হবে। উষ্ণ হ্যান্ডশেক এবং হাসির পেছনে রয়েছে দীর্ঘ রাজনীতি। দেশের উন্নয়নে তারা শ্রম দিয়ে কত অবদান রাখে, তার অস্তিত্ব শুধু কথায় সীমাবদ্ধ। বসদের করতালিতে তারা খুশি হয়ে যায়। তবে এর মধ্যেও একটা কঠোরতা আছে। সর্বোপরি, এত সহজে কোথায় পাওয়া যায়!
ব্যস, ছবির মধ্যে চেয়ারম্যানের হাসির সঙ্গে মাশহুদের খুশি মিশিয়ে এগিয়ে গেল। কদম কিছুদূর এগোতেই চোখ পড়ল সামনের রিসিপশনের বারান্দায় লাগানো টিভির পরদায়। তাদের সামনে মিডিয়ার শিরোনাম চলছে। রেললাইনের অব্যবস্থাপনার প্রতিবাদে একাই প্ল্যাকার্ড হাতে যুবক। টিভিতে দেশে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ারর খবর তুলে ধরা হচ্ছে। রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি ও দালালিতে লিপ্ত হওয়ার খবর মনের মধ্যে অপরাধবোধ তৈরি করছে। দেশসেবার নামে নির্বাচিত নেতারা কীভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে সংসদে পারস্পরিক বিভেদ-বিদ্বেষ মুছে দিয়ে তাদের বেতন-ভাতা, পেনশন, বাসস্থানসহ সব সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন, জানান এই প্রতিবেদক। এ জন্য তাদের ধর্মঘট ও বেতন কাটার দরকার নেই।
সভ্য সমাজের এসব অসভ্য ছবি। কঠিন বাস্তবতা। মাশহুদের ভেতরের একজন আবেগপ্রবণ মানুষ হিসাব-নিকাশ করছে। একদিকে তারা লাখ লাখ টাকা বোনাস-ভাতা পাচ্ছে, অন্যদিকে তার অর্ধেকও পায় না, এমন মানুষের ভিড়। সরকারি-বেসরকারি উভয় শ্রেণির লোকই এখানে অন্তর্ভুক্ত। এক বন্ধুকে মনে পড়ল তার, একটি সেক্টরে সে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করলে তাকে আলাদাভাবে বেতন ও পদোন্নতির সমান লাখ টাকা বোনাস দেয়া হয়। মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে সে কোম্পানির এক্সিকিউটিভ, লাখ টাকা বেতন পাচ্ছে। আর মাশহুদ …
রিসিপশনে তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়। কিছু সুন্দরী মহিলা খুব আদর করে মাশহুদকে ফুল দিয়েছে এবং মঞ্চে নিয়ে গেছে। আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে চেয়ারম্যান একটি সুন্দর প্রশংসাপত্র, একটি সম্মাননাপত্র এবং একটি স্বর্ণপদক দিয়ে সম্মানিত করলেন। শ্রদ্ধার জবাবে মাশহুদের চোখ ভিজে উঠল। এমন সম্মানের কথা কখনও ভাবেনি সে। সীমান্তে শহীদ হওয়া সৈন্যদের জীবন স্মরণ করা হয়, সংবাদপত্রের শিরোনামও হয়।
মাশহুদ এই সম্মানে সত্যিই খুশি, কিন্তু তার হৃদয়ে একটি নিবিড় বেদনাও আছে। জীবনের স্কুল অনেক কিছু শিখেছে স্।ে সে অনুভব করছে, তার দৃষ্টিকোণ থেকে, এই সম্মান গ্রামবাসীর জন্য যারা তার কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বারুয়াখালি শাখার টার্গেট পূরণ করেছে। এখন টার্গেটের সময়। টার্গেটের খেলায় পারদর্শী শিকদার, না হলে বছরের পর বছর পরিশ্রম নষ্ট হয়। মাশহুদও টার্গেটের পতাকা উত্তোলন করেছে, যা গত দশ বছরে কখনও হয়নি।
মঞ্চে বসে পরিবারের কথা মনে পড়ল তার। এই সম্মান তার স্ত্রীর, যিনি একা একা ঘরের দায়ি সামলেছে। পাঁচ বছর ধরে একাকিত্ব ছিল। জীবনের বিস্ময়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ছেলেমেয়েরা কচি বয়স পেরিয়ে যৌবনের দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছিল। এই বয়সেই ছেলেমেয়েদের যতœ নেয়ারর প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। তার জীবন দাঁড়িয়ে আছে জীবনের সেই মোড়ে, যেখানে থাকে অবনতি, প্রতারণা ও পিছলে যাওয়ার বিধিলিপি। একদিকে পদোন্নতির পতাকা অন্যদিকে পরিবারের দুশ্চিন্তা। মনে আছে পঁচিশ বছর পর স্কেল ওয়ােেন পদোন্নতি পেয়েছে। ট্রানসফারের শক নিয়ে সবসময় চিন্তিত। বিশ-পঁচিশ বছর পর প্রথম পদোন্নতি এবং তাও গ্রামে! এটি ছিল চার বছর পর দ্বিতীয় পদোন্নতি। এক মাসও পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারেনি। হঠাৎ একদিন বদলির আদেশ আবার বন্ধ হয়ে যায়। শহর থেকে গ্রামে, উত্তর থেকে দক্ষিণে যেতে হয়েছে, তাও পরিবার ছাড়া। স্ত্রীর চাকরি ও সন্তানদের লেখাপড়ার কারণে সঙ্গে নেয়া সম্ভব হয়নি। তাই ওঠাবসা, থাকা-খাওয়া ইত্যাদি সব ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে।
মাশহুদ পরিবার এবং শহরকে বিদায় দিলো।
চূড়াইন শাখায় নতুন ইনিংস শুরু করল। একদিকে সব সমস্যা, অন্যদিকে পদোন্নতির উত্তাপও ছিল। পরিবেশ সমস্যা, গ্রামীণ উপায়, গ্রামীণ ব্যাংকিং, স্থানীয় জনগণের আধিপত্য ইত্যাদি সমস্যার কারণে লোকেরা তাকে দেখে হাসতো। পাঁচ বছর ধরে সে এই শাখায় ম্যানেজার হিসাবে কাজ করেছে।
মাশহুদ ভাবল, এই সাফল্যের পেছনে একটি গোপন রহস্য আছে। কোনোভাবে সে তিন বছর গ্রামীণ সেবা শেষ করে শহরে ফিরে যাবে, কিন্তু বিপরীত ঘটল। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ায় একই শাখায় তার মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো ানো হয়। ভয় হলো এবারও যদি লক্ষ্যপূরণ না হয়! কোনোভাবে তাকে পরিবারের কাছে ফিরে যেতে হয়েছে। তবে হ্যাঁ, সে ব্যাংকের দায়িত্ব থেকে পালাতে চায়নি। সে তখন করো বা মরো পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
জীবন কতই না বিরক্তিকর! সে কখনই নিজেকে পুরোপুরি প্রকাশ করে না। এমন হতাশার মুহূর্তে, প্রায়ই ভেতর থেকে কেউ বলতে থাকে চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। উচ্চমন কখনও কখনও এ ধরনের অনুভবের সঙ্গে শান্তি খুঁজে পায়।
পুরস্কারের পর মাশহুদ বক্তৃতায় বলল, বন্ধুরা, আজকের এই অনুষ্ঠানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আমি এই সম্মান সারওয়াতকে উৎসর্গ করছি।
লোকে ভাবল, কে এই সারওয়াত! ব্যস, পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শেষ। অনুষ্ঠানের পরের দিনই মাশহুদ তার শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। ট্রেন এখন পূর্ণগতিতে ছুটছে। একের পর এক টক-মিষ্টি স্মৃতি মনের পিঠে চেপে আসছে।
দীর্ঘ জীবনে কিছু জিনিসই মনে থাকে। আসলে মাশহুদের যে জেলায় শাখা ছিল সেখানে একটি নদী বয়ে যেতো। নদীটি ছিল অস্পৃশ্য। একদিকে বর, অন্যদিকে অভিশাপ। যে অঞ্চল দিয়ে এটি প্রবাহিত হয়, সেখানে ফসল ভালো জন্মে। তবে কখনও কখনও এটি বন্যাও নিয়ে আসে, যা সর্বনাশ ঘটায়। এর ওপর বাঁধ নির্মাণ করে পানি বন্ধ করা দরকার, যাতে পানি সহজে খেতে নিয়ে যাওয়া যায় এবং বন্যা বন্ধ করা যায়।
যে এলাকায় তার ব্যাংকের শাখা ছিল সেখানে গত কয়েক বছর ধরে খরা চলছিল। খরার কারণে মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিল। ওই এলাকায় অনেক ধরনের কৃষিঋণ বিতরণ করা হলেও ঋণ আদায় করা সম্ভব হয়নি। ঋণ মওকুফ করা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন স্থানীয় নেতারা। এতে মানুষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হলেও কিছু মানুষ সৎও ছিল। তারা ঋণ পরিশোধ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়েছিলেন। তার সাহসিকতাকে সম্মান করতে চাইল হৃদয়।
লক্ষ্যপূরণের পৈশাচিক ধারণা মাশহুদকে কঠিন করে তুলেছিল। নীতি অবলম্বন করে সে ব্যাংক লোন, যা আদায়যোগ্য নয় তা আদায় শুরু করে। টাইপ ঋণ পুনরুদ্ধার তার লক্ষ্য তৈরি করেছে। এই অনগ্রসর এলাকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সচেতনতা, অংশগ্রহণ এবং সুযোগ-সুবিধা অর্জনের ধারণা তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। মানুষের অভিযোগ শুনে তার কান জ্বলে ওঠে। সে সহ শাখায় মোট পাঁচজন কর্মচারী ছিল, একজন বা দুজন প্রতিদিন ছুটিতে থাকতো। প্রধান হিসাবে, গেট পরিষ্কার এবং বন্ধ করার জন্য নিরাপত্তার চাবি রাখার সমস্ত দায়িত্বও তার।
কয়েকদিন পর তাকে জেলা পর্যায়ে সরকারি সংস্থার বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এলাকার উন্নয়ন ও সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয় ওখানে। তার জন্য এটা ছিল নিছক একটা রসিকতা, কিন্তু তার জন্য এটা একটা মিশনও ছিল। নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ ও খাল তোলার পরিকল্পনা সরকারি কর্মকর্তাদের সামনে তুলে ধরা হলো। সেখানকার জীবন ও খেতের উৎপাদিত ফসল সম্পর্কে মানুষকে বোঝালো। যেখানে বাঁধ নির্মাণ করা দরকার সেই পয়েন্টটা বললো। এতে করে তাদের শাখা এলাকার মানুষ বন্যা থেকে ত্রাণ পেতে যাচ্ছিল। অন্যদিকে ভালো ফসলও হয়েছে। মাশহুদ স্কিমের খরচ মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাংক লোনের প্রস্তাব তৈরির দায়িত্ব নিল। তার ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে এটি অনুমোদিত করার আশ্বাস দিল। এলাকার প্রধান তাকে এই প্রকল্প সম্পর্কে আগেই বলেছিল, তাই সে প্রধান কার্যালয়ের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করেছে।
এর আগেও বন্যার সমস্যা সমাধানে এলাকার মানুষ বহুবার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের সঙ্গে দেখা করেছেন। প্রতি বছর একটি বড় সভা আয়োজন করা হতো এবং বন্যার ক্ষেত্রে কীভাবে ত্রাণ কাজ করা হবে তা নিয়ে আলোচনা করা হতো। কীভাবে সাহায্য পাবেন! ক্ষতিপূরণের পরিমাণ কীভাবে বিতরণ করা হবে? কোথায় ত্রাণশিবির হবে? রোগের ওষুধ কীভাবে পৌঁছে দেয়া হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এসব বৈঠকে এর আশেপাশে সেচের জন্য বাঁধ ও খালনির্মাণ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। এর পেছনে নিশ্চয়ই অনেক কারণ থাকতে পারে, হয়তো স্বার্থপরতা বা অন্য কিছু।
আজ অবধি আর্থিক সমস্যা তার মাথাব্যথা হয়ে আছে। হেড অফিসে প্রস্তাব পাঠিয়েছে, এর সঙ্গে জেলাশাসক ও এলাকার মন্ত্রীর সুপারিশপত্রও যুক্ত করা হয়েছে। এই প্রকল্পটি ছিল একটি বিশাল ঋণ প্রস্তাব, যা অত্যন্ত্য স্পর্শকাতরও ছিল। ব্যাংকটি এই প্রস্তাবে আগ্রহী। ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং ঘন ঘন বৈঠক বসে। মানুষের মধ্যে আনন্দের জোয়ার বইছে।
মাশহুদের খ্যাতি সারা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। তার কারণেই নদীর ওপর বাঁধ তৈরি হচ্ছে বলে মানুষের মনে বিশ্বাস জন্মেছে। লোন পাশ হয়ে যাচ্ছে, তাই উন্নয়নেরনর খাল তাদের ঘরে পৌছানোর কথা। তারা ধরে নিয়েছল যে মাশহুদ এই অঞ্চলে যে বিপ্লব ঘটতে চলেছে তার সূচনাকারী। মাশহুদও এর সুফল পেল।
দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন দেখা করতে আসতে থাকে। শুরু করে তার ব্যাংকিং ব্যবসা। ধীরে ধীরে ব্যাংকের কাজ গতি পেতে থাকে। ব্যবসা বাড়তে থাকে। নতুন অ্যাকাউন্ট খুলতে শুরু করেছে লোকজন। পুরানো ঋণ আদায় হতে থাকে। নতুন ঋণ দেয়া শুরু হয়েছে। শাখার আমানতের অংকও বেড়েছে, যা মাশহুদ কখনই আশা করেনি। এসব গ্রাহকদের সহায়তায় পুরানো ঋণ আদাায়ে কঠোর পদক্ষেণপ নিয়েছে।
টার্গেট পূরণ করার সময়ও একদিন ঘনিয়ে এলো। মাশহুদ খুব খুশি। তার মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে। তাই সে এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে লোকজনের সঙ্গে দেখা করতে। হঠাৎ সেই দ্বারে পৌঁছে গেল, যার ঋণ সে মীমাংসার প্রস্তাবে মওকুফ করেছিল। ওটা ছিল সারওয়াতের বাড়ি। সেখানে অনেক দুঃখ ছিল। এই ঘটনা মাশহুদের হৃদয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। সে জীবনেও যা ভুলতে পারবে না।
তাকে দেখে সারওয়াত পায়ের কাছে পড়ে কেঁদে ফেললো, স্যার! আমি খুব গরিব হতে চাই, কিন্তু আমার সম্মান খুব প্রিয়। কারো ঘৃণা রেখে যাওয়াাটা আমাদের জন্য লজ্জার বিষয় হওয়া উচিত। আপনি যদি আমার বাড়িতে পুনরুদ্ধারের জন্য আসেন, তাহলে ঋণ পরিশোধের জন্য আমি মেয়ের বিয়ের টাকা আপনার ব্যাংকে জমা দেবো। কিন্তু পরে হঠাৎ করে আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে আমি তাকে সুস্থ করার জন্য সোনা-গয়না বিক্রি করি। আমি বাধ্য, আমার কাছে টাকা নেই। কীভাবে মেয়ের বিয়ে করাবো? তারপর মেয়ের বিয়েও ভেঙে যায়। আমার মেয়ের জন্য বড় ধাক্কা। ঘরের লজ্জা বাঁচাতে একদিন গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করল। আমার স্ত্রী মর্মাহত হলো, সেও আল্লাহর কাছে চলে গেল। আমি ছিনতাই করেছি স্যার। এখন আমার খাওয়রও কিছু নেই। কার সাহায্যে বাঁচি! হয়তো একদিন আমাকে আমিও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবো স্যার …
সারওয়াতের দুঃখের গল্প মাশহুদকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। সে কান্না আটকাতে পারেনি। তার জিব অসাড় হয়ে এলো। সে সারওয়াতকে ধৈর্য ধরতে বললো। কাঁধে হাত রেখে কিছুক্ষণ আদর করে ভারী পায়ে এগিয়ে গেল। মনে মনে নিজেকে দোষারোপ করতে লাগলো।
মাশহুদের মনে আছে, সে যখন ঋণ আদায়ের জন্য গ্রামে-গ্রামে ঘুরছে, একদিন এই কৃষক সারওয়াতের বাড়িতেও পৌঁছে। তাকে ঋণ পরিশোধের জন্য চাপ দেয়। প্রথমে সে তার দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষের জন্য কাঁদতে লাগলো। কিন্তু মাশহুদ তাকে মীমাংসার প্রস্তাবে ঋণের কিছু অংশ মওকুফের কথা বললে এবং কিছু চাপ দিলে সে রাজি হলো। বন্যার কারণে কৃষিকাজ করা সম্ভব হয়নি। তবে কঠোর পরিশ্রম করে সে তার পরিবারের ভরণপোষণ করতে পেরেছে। কিছু ঋণ মাফ হবে, এই লোভে সে নির্দিষ্ট সময়ে ব্যাংকে বাকি ঋণের টাকা জমা দেয়। মীমাংসা প্রস্তাবের আওতায় মাশহুদ তাকে ঋণমুক্ত করে। এভাবে মাশহুদ সেই সময়ে অনেক অ্যাকাউন্ট উদ্ধার করেছে। তার এই ছলচাতুরীতে হাইকমান্ড খুব খুশি, সবাই তার প্রশংসা করল। এর ফলশ্রুতিতে হেড অফিসে ফোন করে তাকে সম্মানিত করা হয়।
ছুটে চলা ট্রেনটি হঠাৎ থেমে গেল। একটা ঝাঁকুনি লাগলো। বাইরে তাকালো মাশহুদ। প্রবল বাতাস বইছে। কিছু গুঁড়িগুঁড়ি। তারপর হঠাৎ প্রবল সূর্যালোক, জ্বলন্ত পৃথিবী, ঝলসে যাওয়া স্বপ্ন। তার সামনে একজন পরিচিত লোক হাজির।
মাশহুদের মনে হলো একটা কালো অর্ধনগ্ন, লুঙ্গি জড়ানো সারওয়াত সামনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। স্মৃতির ঢিবির ওপর দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে মাশহুদ বলল, সম্ভব হলে ক্ষমা করে দিও। আমার তোমার ওপর চাপ দেয়া উচিত হয়িিন। কিন্তু কি করবো, ভাই? আমি আমার দায়িত্ব পালন করছিলাম। আর তুমি সম্মানের জন্য আমার দায়িত্ব পালন করেছো। এরপর যা হলো তা নিয়তির খেলা। পারস্পরিক যোগসাজশে কোটি কোটি টাকার ঋণ ঠেকানো সেসব ধনকুবের ও রাজনীতিবিদদের মধ্যেও তোমার মতো সততা পাওয়া যাবে না। তাদের জন্য এটা লজ্জার বিষয়ও না। বরং গর্বের বিষয়। অসংখ্য কোটি টাকার এই নিমজ্জিত পুঁজিতে দেশের বহু জীবন জনবহুল হতে পারে। অনেক নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে সেচের জন্য খাল বের করা যায়। শিক্ষা, বিদ্যুৎ, পানি, হাটবাজার, পাকাঘরের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অর্থের বদলে মেয়ের পুতুল সাজানো যায় … আমাকে মাফ করে দাও ভাই … মাফ করে দাও …।
হয়তো এটা মাশহুদের মায়াকান্না! সে এখনও সেই ছায়া থেকে বের হতে পারেনি। দূর দিগন্তে পাহাড়ের চূড়ায় সূর্য মরার প্রস্ততি নিচ্ছে। ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠল। বাকরুদ্ধ হয়ে নিজের সিটে ফিরে এসে বসলো মাশহুদ। তার ভেতরের আয়না থেকে এক লোক উঁকি দেয়ার চেষ্টা করছে। সাদা লুঙ্গিপরা, কালো অর্ধনগ্ন একলোক বেপরোয়াভাবে দৌড়াচ্ছে। মাশহুদ ভেতরের বেদনার জোয়ারকে চাপা দিতে চাইল।