পাশার দান ও প্রেমিকারা

আরিফুল হাসান »

প্রেমকে সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবে ফেলতে নারাজ নাইম। তবু প্রেম করতে তার ভালো লাগে। এ অফিসে তিনটে প্রেম সে করেছে এই চার-পাঁচ মাসেই। প্রেম মানে তার কাছে আরও এক বিপন্ন বিস্ময়। বাস্তবতাকে ডিঙিয়ে, কোথায় যেন অতিক্রান্ত স্বদেশের ভাষা পায় সে। দেশ তার কাছে প্রেমিকার মতোই।
প্রেমিকা তার এসেছিল একাত্তরে। আমার প্রেমিকার জন্য পৃথিবীর সমস্ত প্রেমিক সেদিন সে লিখেছিল। না, সেদিন লেখেনি। সেদিন থেকে বহু বছর পর, বহু বহু দিনমাস পর, ২০২৪ তার দুনিয়া প্রেমের জন্য অবারিত হয়। অবারিত আকাশের বুকে তার উড়াল-ডানা বিস্তৃত হতে থাকে যতক্ষণ না তা পতনের দিকে নিয়ে যায়। তার স্বপ্নের ভেতর দোয়েলের শিস ঢুকে যেতে পারে, কোকিলের সুর ঢুকে যেতে পারে, নববসন্তের স্বপ্ন ঢুকে যেতে পারে। তবু কিছুই ঢুকে না, না বিদ্যে না বুদ্ধি। তাই প্রেমিক হিসেবে সে খাঁটি গাড়ল।
প্রেমে পড়তে যে বয়েস লাগে তা সে ভুলে গেছে। ভুলে গেছে কীভাবে কখন তার ঘুম ভেঙেছিল পৌষে কি চৈত্রে। আবার ঘুমিয়ে যাবার আগে এবার তার হিসেব করে চলতে হবে দেনা। প্রেমের পথে লেনাদেনা থেকে যায়। তাই সে প্রেম দিয়ে পুষিয়ে দেয়, দিতে চায় সকল কিছু।
এ অফিসে আসার ক্রিয়েটিভ ওয়ে খুব সফট। চমৎকার একটি ভালোবাসার পরিবেশ আছে। এখানে ভালোবেসে অন্ধ হওয়া যায়। মাতাল হওয়া যায় নিষিদ্ধ লোবানে। তবু, ভালোবাসার, বলি, একটু বিশ্রাম আছে। বিশ্রাম নাও, শরীর-মন ভালো ভালো রাখো, সুতরাং সব শেষ এমনটি ভেবো না। কিন্তু প্রেমে সে যে পাগল। এসব সে মানবে কেনো। তাকে প্রেমে পড়তে হবে। তারপর গল্পাকারে পড়তে হবে সেসব, নিজের পড়াশোনা হয়ে গেলে লিখতে হবে। এসব লিখতে তার ভালো লাগে। তবু সে লেখে না। কারণ, লিখলেই হারিয়ে যায় সেসব, কর্পূরের মতো উড়ে যায়। কোথায় হারায় তা সে নিজেও জানে না। কারণ, প্রেমে সে কল্পনাবিলাসী।
ঘুমে কিংবা অটুটে, এখন সে জ্ঞানহারা। এখন যে নারীর প্রেমে পড়েছে সে আধুনিকা। এ অফিসের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন অফিসার। নিখুঁত, চকচকে। নাকে কি নাকফুল আছে? না, নেই, বাহ! হলো তো। এই তার প্রেমে পড়া শুরু হলো আবার। এর আগেও দু-দুটো প্রেম করেছে সে। নাছিয়া নাজমুন ছিল একজনের নাম, দুনম্বর জনের নাম ছিল ফ্লিহা।
ফ্লিহা পাখির মতো উড়াল দিল। যেদিন সে ফ্লিহাকে নিয়ে লিখলো, যেদিন, ঠিক সেদিনই উড়াল দিল ফ্লিহা। এ জগতে ভালোবাসা প্রকাশ করে দিলে থাকে না, এই সত্য সে মর্মমূলে বিদ্ধ করেছে। সেই সত্যকে ধারণ করেই এখন লিখতে বসেছে তৃতীয় প্রেমের কথা। জানে, এ প্রেমটিও সে হারাবে, না হলে নিজেই ছেড়ে দেবে কদিন পর, তবু তাকে প্রেমে পড়তেই হবে, সে যে প্রেমিক।
প্রেমিকের এ অপবাদ নিয়ে সে আবার লেখকও। এবার লিখতে বসে তার আঙুল থরোথরো। সে লিখছে, মেয়েটির রূপলাবণ্য লিখছে। আহা, কী অপরূপ, দেখলেই প্রেমে পড়তে ইচ্ছে হয়। অফিসে পা রেখেই কোন খেয়ালে তার দিকে চোখ গিয়েছিল নাইমের। নাইম চোখ নামিয়ে রেখেছে। এত রূপের সামনে সে টিকতে পারে না। তার প্রথম প্রেমটি বলা যাবে না। তবু প্রথম প্রেমটি স্মরণ করে সে কিছুক্ষণ কাঁদলো, লজ্জিত হলো, প্রেম না কাম ছিল কিছুই তার মনে নেই।
এবার সে নিসার চোখের বর্ণনায় ভেসে যাবে। সে দেখবে, কাজলকালো আকাশেকালো মেঘ বর্ষা ডেকে আনবে। পাথরের পাহাড় ভেঙে, সারিবদ্ধ চোখের মমিগুলো উড়িয়ে নিয়ে যাবে আরও দূর অন্ধকারে। নিবিড় অন্ধকারের ভেতর ব্ল্যাকহোল চোখে সে তো প্রেমে পড়বেই, তার কী দোষ?
সে নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করে না। সে চোখের বর্ণনা দেয়। তারপর নাকের বর্ণনা দেয়, নাক যেন বাঁশি। যাদু বিনা বাঁশি, ঈষৎ ঘামে লজ্জিত হলে। সে খেয়াল করে দেখেছে। তখন গোলাপি হয়ে ওঠে গাল দুটো। এতই মিষ্টি যে, দেখলেই আদর করে দিতে ইচ্ছে করে। যেন রেশম বিছানার বারবি ডল, স্পর্শেই সুখ। কিন্তু অফিস তো অচেনা। নতুন এসেছে। এখনই স্পর্শসুখ! সে কি করে হয়, তাই আজকাল তার দেখেও সুখ। উজ্জ্বল দুটি কান, রেশমি চুলের ভেতর ওড়ে, তার মুখ মনে পড়ে। মনে পড়ে আর লেখে সে। জানে, লিখলেই হারিয়ে যাবে। তবু লেখে, কারণ লেখার জন্যই করেছে এ প্রেম।
সে প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকে। এখন সে সকাল-সকাল অফিসের দিকে রওনা হয়। যায়ও আজকাল তাড়াতাড়ি। তার চোখে চোখ পড়ে। মেয়েটি হাসে। সেও হেসে নেয় এক পলক। তার এ হাসি অমলিন থাকে। স্বপ্ন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। সে স্বপ্নে দেখে, দিগন্ত উন্মোচিত কোনো উদ্যানে সে ও নিসা হেঁটে বেড়াচ্ছে। নিসার ঠোঁট দুটো লাল, পলাশফুলের মতো। এশীয় বিপ্লবে বাংলাদেশের অভ্যুত্থান, বাঙালির জাগরণ, একাত্তর, এ দেশটা তার প্রেমিকার মতো।
২.
নিসার সাথে ইদানীং তার দেখা হয় না। সে-ই দেখা করতে ভুলে যায়। কেন ভুলে যায় সে বুঝতে পারে না। মাসখানেক আগেও সে যেমন দৌড়ে যেতো অফিসে, সবার আগে, এখন তেমন যায় না। বইমেলা, চাপে, সে কেমন ভুলে যেতে বসেছে জ্বালা। কিন্তু জ্বালা ভোলেনি নিসা। তীব্র চোখের চাহনি তাকেও যে বিদ্ধ করেছে, এখন সে আহত হরিণী। এবার কই যাবে নাইম। তীব্র এক বিষে পড়ে সবচে লেটের অফিসার হিসেবে তার তাহলে বদনাম ছড়াবে? ছড়ালে ছড়াক। না, তা হতে দেয়া যায় না। নাইম অফিসে যায়, তবে সবচে লেটে না। তার ডিপার্টমেন্টের সবচে আগে, কিন্তু নিসার ডিপার্টমেন্ট থেকে তিন ঘণ্টা লেটে।
নিসারও অফিসের টাইম এলোমেলো হতে থাকে। সেও কেমন দেরিতে ওঠে ঘুম থেকে। নাইমের ভূত যেন লেগে আছে পাছে। নিছা লজ্জা পেয়ে হাসে। ধুর, নাইম কি এরকম? নাইম কাজে এক্টিভ। দেখেছে, মেলায় সে কীভাবে একটানা আঠারো ঘণ্টাও কাজ করেছে। খুব কাজ-পাগল, তাই ইদানিং নেশা ধরে বেশি। নেশা শব্দটা মনে আসায় নিসা আবার হাসে। শুনেছে নাইম নেশা-ভাঙ করে। খাক, লেখক মানুষেরা ওসব খায়ই। সে তার জন্য দোয়া করে, খেয়ে সে সুস্থ থাকুক।
কিন্তু নাইমের মতিগতি ইদানীং নিসা বুঝে না। কেমন যেন তার চোখে চোখ পড়তেই সরিয়ে নেয়। সে অফিসের বস পর্যায়ের। নাইমের এমনটি আগে ছিল না। বস না হোক, সে যে নাইমের চেয়ে দুবছর আগে এখানে জয়েন করেছে তা নাইম জানবে না কি? জেনে থাকবে হয়তো। না হলে প্রথম প্রথম বিনয়ী ভঙ্গিতে পথ ছেড়ে দিতো কেন? নাইমকে আমার ভালো লাগেÑ ভাবে লিসা।
সে গিয়ে সহকর্মী জালালা ভাবিকে ধরে। টেবিলের সামনে বসে বসে কাজু বাদামে হালকা কামড় বসাতে বসাতে বলে, ভাব কী ইদানীং, যেন চেনেই না। চিনবে চিনবেÑ জালালা ভাবি হাসে। আপনাদের জালাল সাহেবও আমাকে প্রথম প্রথম এমন চিনতো না। অবশ্য আমি ছিলাম তার জুনিয়র। আপনার ক্ষেত্রে হয়েছে তার উল্টোটা।
নাইম আর লিখতে পারে না। যদি তার কলম ভেঙে যায়! যদি হারিয়ে যায় নাজমুন আর ফ্লিহার মতো নিসাও? না, এত তাড়াতাড়ি সে নিসাকে হারাতে চায় না। তার সাথে আরও দুচার দান জুয়াখেলা বাকি আছে।