নারীর সামাজিক নিরাপত্তা অর্থনৈতিক মুক্তির নিশ্চয়তা

অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ »

নারীর প্রতি সহিংসতা যেন একটি নিয়মিত ঘটনা। গণমাধ্যমে চোখ রাখলেই দেখা যায় দেশের কোথাও না কোথাও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। বাবার কাছ থেকে মেয়েকে কিংবা স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীকে ছিনিয়ে নিয়ে নৈতিকতাহীন কিছু অমানুষ ধর্ষণের মত ঘটনাও ঘটায়। শুধু ধর্ষণই নয়, রীতিমতো গণধর্ষণ হচ্ছে। অনেক সময় ধর্ষণ করার ঘটনা ধর্ষক বা তার সহযোগী কর্তৃক মোবাইলে ভিডিও করে রাখে। পরবর্তীতে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে পুনরায় ধর্ষণ কিংবা টাকা দাবি করা হচ্ছে।
আধুনিক সমাজে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেরই মৌলিক অধিকার সমান ও অভিন্ন। প্রত্যেক নারী পুরুষের স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। একুশ শতকে পদার্পণ করে বর্তমান বিশ্ব যে সমাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক পালাবদলে অংশ নিচ্ছে নারী সেখানে এক অপরিহার্য অংশীদার, জীবনযুদ্ধেও অন্যতম শরিক ও সাথী। আর নারীকে মুক্তি দেওয়ার জন্যে, নারীর উন্নয়নের জন্যে, এক কথায় নারীর ক্ষমতায়নের জন্যে দরকার সব ধরনের প্রতিবন্ধকতার অবসান। প্রয়োজন শিক্ষার প্রসার ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি। মানবাধিকার ও অগ্রগতির এই একুশ শতকে সামাজিক কুসংস্কার কাটিয়ে নারীরা এগিয়ে আসছিল মানুষের ভূমিকায়, আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে। কিন্তু তাদের অগ্রযাত্রায় যৌন নির্যাতন, ইভটিজিং কিংবা ধর্ষণ বিশাল প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে যা নারী শিক্ষা ও তাদের জীবনযাত্রায় প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নের খবর পত্র-পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। দেশবাসী এসব সংবাদ দেখে, যা অপ্রত্যাশিত। অপ্রিয় সত্য যে, এধরণের কুচক্রিলোকদের কবলে শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদ- ভেঙে যাচ্ছে। শিক্ষাঙ্গনকে এদের কবল থেকে মুক্ত করে শিক্ষা এবং জাতির মেরুদ- শক্তিশালী করা আবশ্যক। অপরদিকে ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে যেসব বিষয় সমাজে বহুদিন ধরে অস্তিত্ব বজায় রেখেছে তার মধ্যে ইভটিজিংও রয়েছে। এ অমানবিক বিষয়টি মানুষকে অবমূল্যায়ন করছে। চলার পথে কিংবা কর্মক্ষেত্রে কিশোরী ও তরুণীদের বিরক্ত করা, কুপ্রস্তাব দেওয়া, শ্লীলতাহানির চেষ্টা করা ইত্যাদি অবৈধ ও অনৈতিক কর্মকা-ের প্রস্তাব করা হচ্ছে ইভটিজিং যা আমাদের সমাজে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে এর শিকার কিশোরী তরুণীরা লজ্জা গোপন করার জন্য কত আত্মদান লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যাচ্ছে তারও কোন ইয়ত্তা নেই। ভিকটিমরা এই সম্বন্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে ভয় পান। আইন আছে, সমাজে ঘৃণাও আছে। তবুও দুষ্ট ক্ষতের মত এই বিষয়টি সমাজ জীবনে নিরাময়ের অযোগ্য হয়ে আছে। কত নিরপরাধ কিশোরী-তরুণীর জীবন যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই। আজ আমাদের সমাজটা অবক্ষয়ে নিমজ্জিত হতে যাচ্ছে। এগুলোর জন্য দায়ী আমাদের যুব সমাজের সঠিক মনুষ্যত্ববোধের অভাব। সচেতন পিতামাতাকে অনেক সময় লাঞ্ছিত হতে হয় এই বখাটেদের হাতে। তাছাড়া অনেক সময় আপত্তি করলেও আরো বেশি করার নজিরও আমরা দেখেছি। ছাত্রীদের প্রতি এই ধরণের আচরণ ছাত্রীরা বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার শেষ ভরসাটুকু হারিয়ে ফেলে, অভিভাবকরা পর্যন্ত হতাশ হয়ে পড়ে।
আমাদের দেশে আইন আছে, শাস্তির ব্যবস্থা আছে। তবু এ ধরণের অপরাধ কেন বৃদ্ধি পাচ্ছে? আমাদের বেকারত্ব, হতাশা, উপযুক্ত বিনোদনের অভাব, নৈতিক অবক্ষয়, পারিবারিক শিক্ষার অভাব, আইনের সঠিক প্রয়োগ না করা, সর্বোপরি প্রত্যেক ধর্মের নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসনগুলো সঠিকভাবে পালন না করার জন্য এ ধরণের অপরাধ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে যাচ্ছে। ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে সাম্যবাদী নারীদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘোষণার করা হয়।
১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা, তাঁদের কাজের প্রশংসা এবং ভালোবাসা প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে মহিলাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সাফল্য অর্জনের উৎসব হিসেবেই পালন করা হয়। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘করোনাকালে নারী নেতৃত্ব গড়বে নতুন সমতার বিশ্ব’। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮(২) ও ৩৪(১) অনুযায়ী গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা নেবে এবং সব ধরনের জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ ও আইনত দ-নীয়। ইভটিজিং দ-বিধি ১৮৬০ এর ৫০৯ ধারায় দ-নীয় অপরাধ এবং দ-বিধির ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩) এ শাস্তির বিধান রয়েছে।
এ আইনের ১০ ধারায় যৌনপীড়ন এর শাস্তি হিসেবে অনধিক ১০ বছর কিন্তু অন্যূন ৩ বছর সশ্রম কারাদ-ের বিধান রয়েছে এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদ-ও রয়েছে। আর যদি নারীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে বা অশোভন অঙ্গভঙ্গি করে তাহলে অনধিক ৭ বছর অন্যূন ২ বছর সশ্রম কারাদ- এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদ-। সম্প্রতি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সংশোধন আনা হয়। আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- রাখার পাশাপাশি আরও সংশোধনী আনা হয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো যৌতুকের ঘটনায় মারধরের ক্ষেত্রে (ধারা ১১-এর গ) সাধারণ জখম হলে তা আপসযোগ্য হবে। এ ছাড়া এই আইনের চিলড্রেন অ্যাক্ট-১৯৭৪-এর (ধারা ২০-এর ৭) পরিবর্তে শিশু আইন ২০১৩ প্রতিস্থাপিত হবে। অধ্যাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৮নং আইনের ধারা ৭, ধারা ৯ এর উপধারা (১), (৪), ১৯ এর উপধারা (১), ধারা ২০ ও ধারা ৩২ এ সংশোধনী আনা হয়েছে।
বর্তমান সময়ে ইন্টারনেট, মোবাইল ফোনের যত্রতত্র ব্যবহার বিশেষ করে উঠতি বয়সের ছেলেদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করেছে যা ইভটিজিং এর জন্য অনেকাংশ দায়ী বলে ধরা হচ্ছে। বিদেশি সংস্কৃতির যে অংশটুকু ইতিবাচক তাহাই আমাদের গ্রহণ করতে হবে। নেতিবাচক অংশটুকু বর্জন করা আবশ্যক। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা আবশ্যক। সৎ, আদর্শ ও ন্যায়পরায়ণ মানুষে সমাজ পরিপূর্ণ করে তুলতে পারলেই জাতির প্রকৃত উন্নতি ঘটবে এই ব্যাপারে সকলকে সচেতন হতে হবে। মেয়েদের প্রতি বখাটেদের উৎপাত বা ইভটিজিং বন্ধে অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। ইভটিজিং বন্ধে সামাজিক আন্দোলন বা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ধর্ষণ, ইভটিজিং ও নারী অবমাননার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠু বিনোদন ও খেলাধুলার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরামর্শকেন্দ্র চালু করা এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দ্বারা ক্লাশের ব্যবস্থা করা দরকার। ছাত্রীদের জন্য মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা দরকার। পরিবার-সমাজ, বিদ্যালয়ের মতো জায়গাগুলোতে নৈতিক শিক্ষার বিস্তার করা উচিত। পরিবার প্রধানদের খেয়াল রাখতে হবে- সন্তানকে নৈতিক শিক্ষা প্রদান করার দায়িত্ব প্রথমে পরিবারের।
সমাজ থেকে ধর্মীয় মূল্যবোধ আর নৈতিক শিক্ষাকে দূরে ঠেলে দিয়ে সভ্য ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব হয় না। অধিক কর্মক্ষেত্র তৈরি করে বেকারদের কাজের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। আত্মহত্যার ঘটনা পত্রিকায় বা মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার বন্ধ করা প্রয়োজন। হত্যা ঘটনাকে আত্মহত্যা মামলা হিসেবে রুজু করার প্রবণতা কঠোরভাবে দমন করতে হবে। মেডিকেল পরীক্ষায় মানসম্মত প্রটোকল মেনে চলতে হবে, অভিজ্ঞ চিকিৎসককে দিয়ে পরীক্ষা করতে হবে এবং সবকিছুর ডকুমেন্ট রাখতে হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন ও আধুনিকায়ন করে সঠিক ও যথাযথভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং বিচার দ্রুত সম্পন্ন করতে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে। শাস্তির বিষয়গুলোও প্রচার করা দরকার গণমাধ্যমে যাতে কেউ এই ধরনের হীন কাজ করার সাহস না দেখায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যে বলা হয়েছে স্বামী বা সঙ্গীর হাতে নারী নির্যাতনের ঘটনায় বিশ্বে চতুর্থ স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের ৫০ শতাংশই নির্যাতনের শিকার হন স্বামী কিংবা সঙ্গীর হাতে। বিশ্বের ১৬১ দেশ ও অঞ্চলের ২০০০ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও নারী নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। কখনো তা নৃশংসতার রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এগুচ্ছে, উন্নয়ন ও হচ্ছে ব্যাপকভাবে কিন্তু সমাজ যদি না এগোয়, পেছনে পড়ে থাকে তবে সামগ্রিক অগ্রগতি ব্যাহত হতে বাধ্য। একটি সভ্য সমাজে নারী ও শিশু নির্যাতন সামগ্রিকভাবে সভ্যতা ও মানবতার জন্য কলঙ্কস্বরূপ। নারীর প্রতি নির্যাতন রোধে প্রশাসনের যেমন কঠোর হওয়া প্রয়োজন, তেমনি পুরুষের মধ্যযুগীর মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। উন্নয়ন ও সামাজিক অগ্রগতিতে নারীÑপুরুষের সমান অংশীদারিত্ব স্বীকার করতে কুণ্ঠা থাকা উচিত নয়।
সভ্য সমাজে অসভ্যদের অবাধ বিচরণ রোধে বিচক্ষণতার সঙ্গে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নারীর ঘরের বাইরে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি, সামাজিক সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবক সমিতি ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম সহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের যৌথ উদ্যোগে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি দলমত নির্বিশেষে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে হবে নৈতিক মানের অবক্ষয় প্রতিরোধ করার জন্য। নারী নির্যাতনের দৃষ্টান্তমূলক বিচার করতে না পারলে সমাজে নারী নির্যাতন বেড়ে যায়। বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও সামাজিক মূল্যবোধ ও মানবিকতার অবক্ষয়ের কারণে নারী নির্যাতনসহ সব ধরণের মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটে। নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন প্রতিরোধে আইনের প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতাও প্রয়োজন।

লেখক : আইনজীবী