জনতার অকৃত্রিম বন্ধু অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ

রেজাউল করিম »

সমকালীন শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতির ইতিহাসে অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ এই জনপদের এক কীর্তিমান পুরুষের নাম। বহুমাত্রিক পরিচয়ে সমুজ্জ্বল তাঁর জীবন। ১৯১৪ সালেরএপ্রিল মাসে তিনি উপনিবেশিক বৃটিশ-ভারতের চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালি থানার সাধনপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মুন্সি সফর আলী ইংরেজ শাসনাধীন টি-এস্টেটের ম্যানেজার। পিতৃব্য আব্দুল জব্বার চৌধুরী পোস্টমাস্টার ও ইউনিয়ন বোর্ডের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এই বংশ পরিচয় নির্দেশ করে যে, তিনি তৎকালীন সময়ের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান ছিলেন। ১৯৯৪ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি যে বছর জন্মগ্রহণ করেন, সে বছরই প্রথম মহাযুদ্ধের সূত্রপাত হয়। এর পর আশি বছরের তাঁর জীবৎকালে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে নানা ঘটনা প্রবাহ, তৎকালীন সামন্তÑপুঁজিবাদী সমাজ কাঠামোর গভীর অভিঘাত তাঁর জীবন মানসকে প্রচ- প্রভাবিত করে। একজন আদর্শবাদী শিক্ষক, রাজনীতিক ও সংস্কৃতি সংগঠক হিসেবে তাঁর কীর্তিময় জীবন বর্তমান প্রজন্মের কাছে স্মরণযোগ্য নিঃসন্দেহে।
আসহাবউদ্দীন বাল্যকাল থেকে স্বীয় মেধা, সাংগঠনিক যোগ্যতা,জনকল্যাণমুখী চিন্তার স্বাক্ষর রাখেন। তাঁর গ্রামের অদূরে পাশ্ববর্তী বাণীগ্রাম হাই স্কুল থেকে তিনি ১৯৩২ সালে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পাশ করেন। স্কুল জীবন থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও গ্রন্থপাঠের মধ্যদিয়ে তাঁর সাহিত্য চর্চার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
এ সময় পশ্চাদপদ গ্রামীণ মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে সমমনা বালকদের নিয়ে তিনি ‘সাধনপুর পল্লীমঙ্গল সমিতি’ ও ‘পল্লী মঙ্গল পাঠাগার’ গঠন করেন। ১৯৩৪ খ্রি.চট্টগ্রাম কলেজ থেকে মাসিক বিশ টাকা বৃত্তিসহ আইএ এবং একই কলেজ থেকে ১৯৩৬ সালে ডিস্টিংশনসহ বি.এ পাশ করেন। ১৯৩৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
শিক্ষাজীবন শেষে তিনি অধ্যাপনাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। ১৯৩৯-১৯৪১ পর্যন্ত চট্টগ্রাম কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন।
১৯৪১-১৯৫০ এর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে চট্টগ্রাম আইআই কলেজ (বর্তমান মহসীন কলেজ), লাকসাম নবাব ফয়িজুন্নেসা কলেজ ও ফেনী কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৫৩ সালে পর্যন্ত তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে অধ্যাপনা করেন। অধ্যাপনাকালীন দুজন সহকর্মী তাঁর জীবনে প্রগতিশীল রাজনৈতিক ভাবনাকে শাণিত করেন। একজন চট্টগ্রাম কলেজে তাঁর সরাসরি ছাত্র ও পরবর্তীতে ফয়িজুন্নেসা ও ফেনী কলেজের সহকর্মী অধ্যাপক আহমদ শরীফ ও অন্যজন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অধ্যাপক আবুল খায়ের। তিনি একজন সফল শিক্ষক ছিলেন। এ প্রসঙ্গে আইআই কলেজে তাঁর ছাত্র ও পরবর্তীতে খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ ড.আবদুল করিম এক স্মৃতিচারণায় লেখেন, ‘আসহাবউদ্দীন সাহেব ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে এই কলেজে যোগদান করেন সম্ভবত ১৯৪১ সালে। এখানে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় এবং ক্রমে ক্রমে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়।
তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন, উপদেশ ছাড়াও বইপত্র দিয়ে এবং আর্থিকভাবে সাহায্য করতেন।… প্রবন্ধ বা কবিতা যাই হোক, আমি তাঁর বক্তৃতা শুনেই পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতাম এবং এখনও তাঁর বক্তৃতার রেশ ভুলিনি। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে শিক্ষকতাকালীন পূর্ব বাংলার মানুষের গণজাগরণ তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এ সময় তিনি পূর্ব পাকিস্তান কলেজ শিক্ষকদের মুখপত্র ‘টিচার’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫২ সালে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ বছর। তিনি ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করেন ও সফল নেতৃত্ব দেন।
এই আন্দোলনের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় তখন থেকে তিনি মানুষের সার্বিক মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন। এসময় তিনি কুমিল্লা ভিক্টেরিয়া কলেজের মতন মর্যাদাশীল প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপনার পদ থেকে পদত্যাগ করে ঝুঁকিপূর্ণ সার্বক্ষণিক রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক নির্বাচনে তাঁর এলাকা বাঁশখালির মানুষের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনীত যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে এম.এল.এ নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালে নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সহসভাপতির পদ লাভ করেন। একই সাথে অপ্রকাশ্যে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সাথেও তিনি গভীর সম্পর্ক রক্ষা করতেন। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হওয়ার পর থেকে তিনি জনগণের সেবায় গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর অসাধারণ সাংগঠনিক তৎপরতায় নিজ গ্রামে সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয়, বাঁশখালি কলেজ, সিটি কলেজ চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো তখন থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিস্তারে ব্যাপক অবদান রেখে চলেছে।
১৯৫৭ সালে পূর্ব বাংলার আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও আওয়ামী লীগের মধ্যে অভ্যন্তরীণ আদর্শিক বিরোধ তীব্র হলে দলের মধ্যে ভাঙন ধরে। আসহাবউদ্দীন মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ গঠিত হলে তার কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন। ৩ এপ্রিল, ১৯৫৭ প্রাদেশিক পরিষদের সভায় তিনি বলেন, ‘মি. স্পিকার স্যার,.. একথা যে কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে, পাকিস্তানের দুঅংশ পরস্পর থেকে পনের শত মাইল দূরে অবস্থিত। এই বাস্তব সত্যের উপর ভিত্তি করে আমাদের রাষ্ট্রের সমস্ত নীতি নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি অস্বাভাবিক কিছু নয়। সমাজ বিপ্লব, শোষণমুক্তি ছিলো তাঁর মূল রাজনৈতিক দর্শন। উল্লেখ্য, তিনি আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের ব্যানারে প্রকাশ্য রাজনীতি করলেও গোপনে কমিউনিস্ট পার্টির ধারার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানি সামরিক শাসন জারি হলে তিনি আতœগোপনে চলে যান। দীর্ঘ পনের বছর আত্মগোপন অবস্থায় নানাদুর্ভোগ, দুর্যোগ মোকাবিলা করেও তিনি আইয়ুবের সামরিক শাসনবিরোধী ঊনসত্তরের গণআন্দোলনসহ কৃষক শ্রমিকের মুক্তির লক্ষ্যে অপ্রকাশ্য ও প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মকা- অব্যাহত রাখেন।একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধেও তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
স্বাধীনতার পর তিনি মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের কৃষক ফ্রন্টের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৮০ সালে তিনি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে চীন সফর করেন। পরের বছর ১৯৮১ সালে সাম্যবাদী দলের মূল নেতৃত্বের সুবিধাবাদ, অবিপ্লবী কর্মকা-ে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে দলীয় রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তবে সাম্যবাদী নীতি ও আদর্শের প্রতি তাঁর অঙ্গীকারে অটল ছিলেন। অতঃপর সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শে লালিত সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির’ এ যোগ দেন।মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ও চট্টগ্রাম জেলার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
আসহাবউদ্দীনের অন্যতম উজ্জ্বল দিক হচ্ছে তাঁর সাহিত্যিক জীবন। তিনি মনে করতেন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলো রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের সাফল্য অর্জনের পূর্বশর্ত। সেই লক্ষ্যে তিনি শিক্ষকতা ও রাজনীতির পাশাপাশি ১৯টি গ্রন্থ রচনা করেন। পত্রপত্রিকায় কলাম লিখে সমাজ, রাষ্ট্রের অসঙ্গতি, শোষণ-বঞ্চনার কথা অত্যন্ত তীর্যক, খোলামেলা ও হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিতে তুলে ধরেন। সকল ধরনের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিদ্রোহই ছিলো তাঁর লেখার মূল উদ্দেশ্য। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ, বাদলের ধারা ঝরে ঝর ঝর, ধার, উদ্ধার, জান ও মান, সের এক আনা, পথ চলিতে, বন্দে ভোটরম, হাতের পাঁচ আঙ্গুল, দাড়ি সমাচার, বাঁশ সমাচার, বিপ্লব বনাম অতিবিপ্লব, আমার সাহিত্য জীবন, ঘুষ,উজান ¯্রােতে জীবনের ভেলা, দাম শাসন দেশ শাসন, ভূমিহীন কৃষক কড়িহীন লেখক, বোকা মিয়ার ইতিকথা প্রভৃতি। গ্রন্থগুলোর শিরোনাম দেখে বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা করা যায়। বর্তমান প্রজন্মের তাঁর বইগুলো পাঠ ও উপলব্ধি খুবই জরুরি মনে হয়। তিনি আমৃত্যু বিপ্লবী ছিলেন। একটি শোষণহীন, মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা তাঁর আজীবন স্বপ্ন ও সংগ্রাম ছিলো তাঁর সংগ্রাম সফল না হলেও পরিত্যক্ত হয়নি। তিনি আপসোস করে বলেন, ‘বিদায়লগ্নে আমি সাফল্যের তৃপ্তি থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছি। তবে বুকভরা আশা নিয়ে যাচ্ছি যে, যোগ্য পরবর্তীরা অযোগ্যের কাজকে এগিয়ে নেবেন এবং তাকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছিয়ে দেবেন।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অত্যন্ত সৎ, সত্যবাদী, বিবেকবান, প্রতিবাদী, পরোপকারী ও সতত মানবকল্যাণকামী ছিলেন। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত তিনি পরার্থে সময় ও শ্রম দিয়ে যান। আদর্শের প্রশ্নে তিনি বরাবর আপসহীন ছিলেন । ড.আবদুল করিম বলেন, ‘তাঁর অনেক সহকর্মী ক্ষমতার মোহে, মন্ত্রীত্বের লোভে, সম্পদের লালসায় আদর্শ ও নীতিচ্যুত হয়েছেন, এইসব তাঁর চোখের সামনে ঘটেছে। সারা জাতির চোখের সামনে হয়েছে। কিন্তু তিনি তাঁর নীতিতে অটুট ছিলেন। ইহাই তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি। এ জন্যই তিনি যুগ যুগ ধরে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
তাঁর ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকীর প্রাক্কালে মেহনতী জনতার বন্ধু এই বিপ্লবী রাজনীতিকের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

লেখক : বিভাগীয় প্রধান,
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি,
চট্টগ্রাম কলেজ, চট্টগ্রাম