ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকট এবং পশ্চিমা বিশ্ব

রায়হান আহমেদ তপাদার »

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপে বসবাসকারী ইহুদিরা ব্যাপক বিদ্বেষ-নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। সেখান থেকেই ইহুদিবাদী আন্দোলনের শুরু। তাদের লক্ষ্য ছিল ইউরোপের বাইরে কেবলমাত্র ইহুদিদের জন্য একটি রাষ্ট্র পত্তন করা। সেই সময় প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিন ছিল তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন। এটি মুসলিম, ইহুদি এবং খ্রিস্টান-এই তিন ধর্মের মানুষের কাছেই পবিত্র ভূমি হিসেবে বিবেচিত। অপরদিকে ফিলিস্তিনিদের রক্তাক্ত ইতিহাসে ১৪ মে, ২০১৮ ছিল আরেকটি বিষাদময় দিন। যুক্তরাষ্ট্র সেদিন জেরুসালেমে তাদের দূতাবাস উদ্বোধন করেছিল। আর সেদিন গাজা পরিণত হয়েছিল এক রক্তাক্ত প্রান্তরে। ফিলিস্তিনি কর্মকর্তাদের হিসেব অনুযায়ী ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে সেদিন গাজায় নিহত হয় ৫৮ জন। আহত হয় আরও প্রায় তিন হাজার। ২০১৪ সালের গাজা যুদ্ধের পর এক দিনে এত বেশি ফিলিস্তিনির প্রাণহানির ঘটনা আর ঘটেনি। সেই দিনটি ছিল ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ৭০তম বার্ষিকী। ১৯৪৮ সালের এই দিনটিতে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হয়। আর ফিলিস্তিনিদের কাছে দিনটি হচ্ছে ‘নাকবা’ বা বিপর্যয়ের দিন। লাখ লাখ ফিলিস্তিনি সেদিন ইসরায়েলে তাদের বাড়ি-ঘর থেকে উচ্ছেদ হয়েছিল। প্রতিবছর দিনটিকে তারা ‘নাকবা’ দিবস হিসেবেই পালন করেন।যুক্তরাষ্ট্র যে তাদের দূতাবাস জেরুসালেমে সরিয়ে নিয়ে এসেছে, সেটিও খুবই বিতর্কিত একটি পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়। যুক্তরাষ্ট্র তাদের দীর্ঘদিনের নীতি থেকে সরে এসে এই পদক্ষেপ নেয়ার পর তা ফিলিস্তিনিদের মারাত্মকভাবে ক্ষুব্ধ করে। ইসরায়েলের স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই সেখানকার অধিবাসী লাখ লাখ আরবের ওপর নেমে আসে অনিঃশেষ বিপর্যয়। ইহুদি সশস্ত্র গোষ্ঠী ও সেনারা ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য হত্যা-ধর্ষণ-লুট-অগ্নিসংযোগ শুরু করে। প্রাণভয়ে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি বাড়িঘর, সহায়-সম্পত্তি ছেড়ে পালাতে থাকে। তারা দলে দলে জর্ডান, লেবানন ও সিরিয়ায় গিয়ে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নেয়। হলোকাস্টের নির্মম তাজা স্মৃতিকে পুঁজি করে ইউরোপীয় আশেকনাজি ইন্ডদিদের ষড়যন্ত্র ও কূটচাল সফল হয়।
এমনকি ফিলিস্তিনিদের ভূমিতে জোরপূর্বক দখলদারি নিয়ে যাত্রা শুরু করে ইসরায়েল-হিব্রু বাইবেলের পুরোকথার দোহাই পেড়ে ‘ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত ভূমিতে ফিরে আসা’র মধ্য দিয়ে। সেই থেকে এক অনিঃশেষ অনিহুয়তার মধ্যে পতিত হয় ফিলিস্তিনিরা, যা আজও চলছে। আর তাই প্রতিবছর ১৫ মে ফিলিস্তিনিরা নাকবা দিবস হিসেবে পালন করে। এবারের নাকবা দিবসও এসেছে জায়নবাদী তথা উগ্র ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের ৭৩তম জন্মবার্ষিকীর পাশ ঘেঁষে। এসেছে গাজায় ইসরায়েলের বিমান-বোমা হামলা-নিধনযজ্ঞ আর জেরুজালেমে হারাম-আল-শরিফ প্রাঙ্গণে ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতন-দমন-পীড়নের মধ্য দিয়ে। ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম থেকেই চলছে ফিলিস্তিনিদের ওপর দমন-পীড়ন, চলছে তাদের সহায়-সম্পত্তি চুরি, ডাকাতি ও লুটপাট। কী লুট করা হয়নি এই সময়ে? ফিলিস্তিনিদের ফেলে যাওয়া হাজার হাজার ঘরবাড়ি, দোকানপাট, গুদাম ও কারখানা। সেখান থেকে যন্ত্রপাতি, কৃষিপণ্য, খাদ্যশস্য, গবাদিপশু, কাপড়চোপড়, অলংকার, আসবাবপত্র, পিয়ানো, ইলেকট্রিক সামগ্রী, গাড়ি-যা পাওয়া গেছে, সবই লুটে নিয়েছে ইহুদিরা। ইসরাইল সেই ১৯৪৮ সাল থেকেই ফিলিস্তিনিদের ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালাচ্ছে। বিরামহীনভাবে চলছে সেই হামলা নির্যাতন।
প্রতিদিনই কোনো না কোনো ফিলিস্তিনিকে ঘর থেকে বের করে তার ঘর বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারো ভিটে মাটি কারো বা ফসলের জমি কেড়ে নিচ্ছে ইসরাইল। মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মাদ খুব চমৎকার একটা কথা বলেছিলেন পৃথিবীর সকল সন্ত্রাসের মূলেই হচ্ছে ইসরাইল। ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করে, সেখানের ৯০ ভাগ আরব জনগণকে উৎখাত করে ইসরাইল নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টিই হচ্ছে আধুনিক সন্ত্রাসবাদের শুরু। ইসরাইলকে থামাতে না পারলে সারা দুনিয়াকে সন্ত্রাস মুক্ত করা যাবে না। কারণ ইসরাইল হচ্ছে সারা দুনিয়ার সন্ত্রাসের মূল উৎস। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটা সত্য যে এই বাস্তবতাটা আরব বিশ্বের নেতারা এখনও বুঝলেন না, বা বুঝতে চাইলেন না। যে আরব বিশ্বের প্রতি তাকিয়ে আছে ফিলিস্তিনি মাজলুম জনতা সেই আরবরাই ফিলিস্তিনিদের দিকে মুখ তুলে তাকায় না। আবারও রমজান। আবারও মসজিদে আকসা। আবারও সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্য। ফিলিস্তিনিদের ওপর চলছে ইসরাইলের বর্বর হামলা। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা আরব দেশগুলো থেকে আরো বেশি সহযোগিতা আরো বেশি একশন প্রত্যাশা করে। বিশেষ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র জর্দান, সিরিয়া, লেবানন, মিশর এবং আলজেরিয়া থেকে। এবার ইসরাইলি বোমা হামলায় ২৪০ জনের মতো নিহত হয়েছে, এদের মধ্যে শিশু প্রায় ৭০ জন। আহত দেড় হাজার।
কিন্তু কী করছে এই আরব বিশ্ব? ইসরাইলের সাথে রঙ্গলীলায় ব্যস্ত। অথচ প্রতিদিন জুলুম নির্যাতন হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের ওপর। হত্যা, হামলা, মামলা, উচ্ছেদ, ধরপাকড় সব কিছুই চলে সেখানে। অথচ এই বর্বরোচিত আক্রমণের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করছেন না, কেউ কিছু বলছেন না? মুসলিম বিশ্বের সর্ব বৃহৎ সংস্থা ওআইসি। এটি তো একটি নাম সর্বস্ব সংগঠন। যে ওআইসির জন্মই হয়েছিল মসজিদে আকসা এবং ফিলিস্তিনের জন্য সেই প্রতিষ্ঠানটি গত ৫২ বছরে ফিলিস্তিনের জন্য কিছুই করলো না! লোক দেখানো কিছু মিটিং ফিটিং আর দায়সারা গোছের বিবৃতি দিয়েই নিজের কর্তব্য পালন করলো। আর গত এক দশকে তো নেতৃত্বের লড়াইয়ে আরও অকেজো হয়ে পড়েছে এই সংগঠনটি। অন্যদিকে আরব লিগ তো আরেক নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে পহিুমা বিশ্বের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড, দ্বিমুখীনীতি, মুসলিম বিদ্বেষ এগুলো তো নতুন কিছু না। যেমন হামলা হলো ফিলিস্তিনিদের ওপর, তাদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা হলো। অথচ পশ্চিমা সেই তথাকথিত মানবাধিকারের ফেরিওয়ালারা সুন্দর করে দোষ চাপিয়ে দিলেন ওই নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের ওপর। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কয়েকদিন আগে তথাকথিত সেই আর্মেনীয় গণহত্যার স্বীকৃতিদানকালে কী বলেছিলেন। আমি মানবতার এবং মানবাধিকারের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছি। সুতরাং সারা বিশ্বে মানবাধিকারের পক্ষে অবস্থান নিতেই এই পদক্ষেপ। কিন্তু এখন ফিলিস্তিনে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, কোথায় তার সেই মানবাধিকার?
ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুধু মাত্র ছোট্ট একটি দেশ বা সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ না। ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ মানে পুরো এক পহিুমা বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। অনেক সময় বলা হয়, আরবরা যদি খালি থুতু ফেলে তাতেই ইসরাইল তলিয়ে যাবে। কথাটিতে যুক্তি আছে। খুবই ছোট একটি দেশ ইসরাইল। কিন্তু এখানে ইসরাইল মানে আমেরিকা, ইসরাইল মানে ব্রিটেন, ইসরাইল মানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এমনকি ইসরাইল মানে ভারত। ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ মানে বিশ্বের সব বড় বড় পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যে এমন গলার কাঁটা করে রাখা হয়েছে যাকে না পারছেন তুলতে না পারছেন গিলতে। তাই এই ইসরাইল সমস্যার একমাত্র সমাধান মুসলিম বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। তুরস্ক কয়েকবার এ বিষয়ে পদক্ষেপও নিয়েছিল। কিন্তু সফল হয়নি। এখনও আবার নতুন করে সব মুসলিম বিশ্বের নেতার সাথে পরামর্শ করছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান। কিন্তু খুব একটা ফল আসবে বলে মনে হয় না। বর্তমানে জেরুসালেমের একটি এলাকায় ইসরায়েলি পুলিশ এবং ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষের জেরে কয়েক সপ্তাহ ধরে উত্তেজনা বিরাজ করার পর এই লড়াইয়ের সূত্রপাত হয়েছে। ওই এলাকা মুসলিম এবং ইহুদি দুই ধর্মের মানুষের কাছেই পবিত্র। কিন্তু গাজা ভূখন্ডে ফিলিস্তিনি এবং ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মধ্যে হামলা পাল্টা হামলা তীব্র আকার নিয়েছে। জাতিসংঘ আশঙ্কা করছে পরিস্থিতি একটা পুর্ণাঙ্গ মাত্রার যুদ্ধের দিকে যাচ্ছে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
ৎধরযধহ৫৬৭@ুধযড়ড়.পড়স