‘ইনোসেন্ট মিলিয়নস’ : প্রামাণ্যচিত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ

ড. মো. মোরশেদুল আলম »

সিনেমার যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রামাণ্যচিত্রের আদলেই। চলচ্চিত্র দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে বেড়ে উঠেছে; একটি ধারা বাস্তবতাকে সরাসরি সেলুলয়েডের ফিতায় তুলে ধরতে সচেষ্ট হয় এবং অন্যটি তার অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনে কল্পিত বাস্তবতা তৈরি করে নেয়। এ দুই ধারার চলচ্চিত্রের মধ্যে প্রথম ধারাটিকে প্রামাণ্যচিত্র বলে অভিহিত করা হয়। ১৯২৬ সালে ব্রিটিশ চলচ্চিত্রকার জন গ্রিয়ারসন নিউইয়র্ক সান পত্রিকায় রবার্ট ফ্লাহার্টি-এর মোয়ানা চলচ্চিত্রটির সমালোচনা প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম ‘ডকুমেন্টারি’ শব্দটি ব্যবহার করেন। তখন থেকে ডকুমেন্টারি শব্দটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের পরিভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ল্যাটিন শব্দ ‘ডকুমেন্টাম’ থেকে ‘ডকুমেন্টারি’ শব্দের উদ্ভব। ফরাসি পরিভাষা ‘documentaire’ থেকে ডকুমেন্টারি শব্দটি এসেছে, যেখানে ভ্রমণচিত্র বুঝাতে এ পরিভাষাটি ব্যবহৃত হত। জন গ্রিয়ারসন প্রামাণ্য চলচ্চিত্রকে ‘The Creative Treatment of Actuality’ বা ‘অবিকলময়তার সৃজনশীল গ্রন্থনা’ বলেছেন। চলচ্চিত্র সমালোচক অজয় সরকারের মতে, বিভিন্ন তত্ত্ব অনুযায়ী প্রামাণ্যচিত্র হলো সহজ সরলভাবে তোলা বাস্তব জীবনের প্রতিরূপ।
১৮৯৫ সালে ফ্রান্সে লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় যে ছবিগুলো নির্মাণ করেছিলেন, সেগুলো ছিল প্রামাণ্যচিত্র। লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়ের তৈরি পৃথিবীর সর্বপ্রথম ছবির পর ১৯২২ সালে রবার্ট ফ্লাহার্টির সুমেরু অঞ্চলের এস্কিমোদের জীবন নিয়ে নির্মিত নানুক অব দি নর্থ (১৯২০-১৯২২ খ্রি.) পর্যন্ত চলচ্চিত্রশিল্পের নান্দনিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সম্ভাবনা সম্পর্কে চিত্রকার বা দর্শক কারোর মধ্যে সঠিক ধারণা দানা বেঁধে উঠতে পারেনি। সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইতালি, ফ্রান্স, পোল্যাণ্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, জাপান, ব্রিটেন প্রভৃতি দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিবর্তনে সিনেমার দান অতুলনীয় এবং তাতে প্রামাণ্যচিত্রের প্রাপ্য কৃতিত্ব অনেকখানি। তাঁদের পথ ধরে বিশ শতকের শুরুতে আমাদের এ বাংলায় হীরালাল সেন যে ছবিগুলো ধারণ করেছিলেন; সেগুলো সবই ছিল প্রামাণ্যচিত্র। বিশ্বময় দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কালে প্রামাণ্যচিত্র শিল্প হিসেবে তার অবস্থানকে একটি মীমাংসিত স্থানে নিয়ে যেতে পেরেছিল। গত শতকের ষাট ও সত্তরের দশকে নানারকম র‌্যাডিক্যাল রাজনৈতিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রামাণ্যচিত্র এই অবস্থানকে আরো দৃঢ় করেছে। প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের রয়েছে জীবনের নিকটস্থ হওয়ার, তাকে পর্যবেক্ষণ করার এবং বাস্তব থেকে নির্বাচনের ক্ষমতা। বর্তমান পরিস্থিতির সঠিক চিত্রায়ণ এবং ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র তার ভূমিকা পালন করে। প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতারা ইতিহাসনির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে ইতিহাসবেত্তাদের সাথে নিয়েই তা করেন। তবে এটি অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য উৎস ও তথ্যের ভিত্তিতে হতে হবে।
প্রামাণ্য চলচ্চিত্র হচ্ছে সহজ-সরলভাবে তোলা বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি। বিষয়বস্তুগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নির্মিত বাস্তবের শৈল্পিক উপস্থাপন যা দর্শকের মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে, তাই হচ্ছে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। এর মধ্যে দর্শকদের জন্য বিভিন্ন বার্তা থাকে। নির্মাতা অত্যন্ত সচেতনভাবে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে এ বার্তাগুলো দিয়ে দেন।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মোট ৪টি বিশ মিনিটের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করা হয়। এগুলো হল : Stop Genocide(1971), A State is Born(1971), Liberation Fighters (1971), Innocent Millions (1971)। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রগুলোর কিছু কিছু সরাসরি যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিকে তুলে ধরার মাধ্যমে নির্মিত হয়েছে। অন্যান্যগুলো মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধকালীন নির্যাতিত মানুষ এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে নির্মিত হয়েছে। ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের চলচ্চিত্র’ কথাটা নতুন কোনো ধারণা নয়। আধুনিককালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শক্তিশালী মাধ্যম চলচ্চিত্র হাতিয়ার হিসেবে সাম্রাজ্যবাদী শাসক-শোষকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশের সংগ্রামীরা ব্যবহার করেছেন। এসব চলচ্চিত্র প্রতিকূল পরিবেশে, গোপন আস্তানায় অথবা মুক্তাঞ্চলে নির্মিত হয়েছে। শোষকশ্রেণিকে উৎখাত করে জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠাই এসব চলচ্চিত্রের মূল লক্ষ্য। এগুলো তৃতীয় চলচ্চিত্র নামেও পরিচিত। বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার ও তাত্ত্বিক আইজেনস্টাইন চলচ্চিত্রকে গ্রেনেডের মতো শক্তিশালী মনে করতেন। আবার কারো মতে ক্যামেরা হচ্ছে রাইফেল।
জহির রায়হানের চিত্রনাট্যের ওপর বাবুল চৌধুরী Innocent Millions প্রামাণ্যচিত্রটি পরিচালনা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতায় গিয়ে জহির রায়হানের চলচ্চিত্র ইউনিটে যোগদান করেন। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের চলচ্চিত্র সিরিজের চতুর্থ পর্ব হচ্ছে Innocent Millions . এ ছবির চিত্রগ্রাহক ছিলেন সাধন রায়। মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী লক্ষ লক্ষ বাঙালি নারী ও শিশুকে জন্মভূমি ছেড়ে পালাতে বাধ্য করেছিল। ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়ে যারা অহরহ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়েছে, তাদের সকরুণ কাহিনীর আলেখ্য এটি। শাহরিয়ার কবির বলেন, প্রামাণ্যচিত্রটির জন্য শিশুদের গণহত্যা, অত্যাচার, যুদ্ধক্ষেত্র এবং শরণার্থী আশ্রয় কেন্দ্রগুলো ঘুরে ঘুরে ছবিগুলো নেওয়া হয়েছিল। Innocent Millions -এ সেক্টর কমাণ্ডারদের সভার একটি দুর্লভ ছবি আছে। নির্মাতা বাবুল চৌধুরী দৈনিক মুক্তকণ্ঠ পত্রিকায় প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, ইনোসেন্ট মিলিয়নস-এর জন্য ভারতীয় কর্মকর্তাদের বাধার ফলে অনেক দৃশ্য শুট করা যায়নি। যেমন একটি রিফিউজি ক্যাম্পের হাসপাতালে ডায়রিয়া আক্রান্ত একটি ছেলে পায়খানার ওপর বসে আছে। তার পাশেই একটা কুকুর ওই পায়খানা খাচ্ছে। মানুষ আর কুকুরের এমন সহাবস্থানের দৃশ্য ধারণ করার সময় ভারতীয় একজন ডাক্তার এসে বাধা প্রদান করেন। নানা ফুটেজের মাধ্যমে নিষ্পাপ শিশুদের জীবনযুদ্ধের বিভৎসতাকে তিনি তুলে ধরেছেন। তবে তাঁর নির্মাণশৈলীতে তেমন কোন বিশেষত্ব নেই। বরং রক্তঝরা চাকু হাতে শিশুদের দিকে ইয়াহিয়া খানের এগিয়ে আসার ড্রইং ব্যবহার করে প্রামাণ্যচিত্রটিকে অতি নাটকীয় করে তোলা হয়েছে। এ ছবিতে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারে দেশত্যাগী উদ্বাস্তু হিসেবে ভারতের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে অংশগ্রহণকারী বাঙালিদের বিশেষ করে নারী ও শিশুদের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের মর্মান্তিক দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে; যে বিষয়গুলো মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে সংরক্ষিত রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন অর্থাৎ মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের হিসাব মতে মোট ৯৮,৯৯,৩০৫ জন শরণার্থী ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। অক্সফার্মের স্বেচ্ছাসেবক জুলিয়ান ফ্রান্সিস ভারতে গমনকারী শরণার্থীদের সংখ্যা গুনতে চেষ্টা করেন। তাঁর দেয়া হিসাব অনুযায়ী এ শরণার্থী সংখ্যা মিনিটে প্রায় ১০০ জন। অনেক শরণার্থী ক্যাম্পে জায়গা না পেয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রায় ১৩ লাখের মতো শরণার্থী খোলা আকাশের নিচে বসবাস করত। এ সময় ভারতের পশ্চিবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয় প্রভৃতি রাজ্যে শরণার্থীরা আশ্রয় গ্রহণ করে। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শরণার্থী আশ্রয় গ্রহণ করে পশ্চিমবঙ্গে, তারপরে ত্রিপুরায়। ভারতে শরণার্থীদের অস্বাভাবিক আগমনের ফলে সেখানকার পরিস্থিতি নাজুক হয়ে উঠে। সীমান্তের শিবিরগুলোতে আশ্রয় না পেয়ে শরণার্থীদের অনেকেই খোলা আকাশের নিচে, রাস্তায়, ফুটপাতে এবং রেল স্টেশনে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। এ সকল শরণার্থীদের দুর্দশা ছিল বর্ণনাতীত। এ প্রসঙ্গে আনিসুজ্জামান বলেন, ‘স্রোতের মত লোক আসছে, রামগড় পেরিয়ে চলে যাচ্ছে সাব্রুমে। এখানেও থাকছে না আশ্রয়ের খোঁজে চলছে আগরতলার দিকে।’ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ভারতের ক্ষুদ্র রাজ্য ত্রিপুরায় যেখানে জনসংখ্যা ছিল ১৫ লক্ষ, সেখানে ১৪ লক্ষ শরণার্থীকে তাদের আশ্রয় দিতে হয়েছিল। বিভিন্ন শহরে বিদ্যমান জনসংখ্যার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি শরণার্থীর আসার কারণে সেখানকার বাজারঘাট থেকে শুরু করে সুপেয় পানি এবং যত্রতত্র মলমূত্রের চাপ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, খাদ্যাভাবÑসব মিলিয়ে এসব অঞ্চলে এক অসহনীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়। পরিবেশের ভারসাম্যে ব্যাপক বিরূপ পরিবর্তনের ফলে সংক্রামক রোগব্যাধির দ্রুত বিস্তার ঘটে।
শরণার্থী ক্যাম্পসমূহে ওষুধ, চিকিৎসক বা সেবাপ্রদানকারী লোকবলের অভাবে অসংখ্য মানুষ ডায়রিয়া, জ¦র, আমাশয়, চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ক্যাম্পগুলোতে শিশুরা ভীষণভাবে অপুষ্টি, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের শিকার হয়। প্রতিটি ক্যাম্পে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এতটাই দুর্বল ছিল যে, হাজার হাজার লোক কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। মে এবং জুন মাসের শুরুতে কলেরা রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৫০০ জনে এবং সেপ্টেম্বরে ৪৬০০ জনে। ভয়াবহ এ শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় খাদ্য, পানীয়, ঔষধপত্রের সমস্যা, আশ্রয়স্থল, মহামারী প্রভৃতি বিষয় জটিল রূপ পরিগ্রহ করে। মৃতদেহ বালুচরে সামান্য বালু খুঁড়ে চাপা দিয়ে আসা হয়েছে, যাদের খেয়েছে শিয়াল-কুকুর। অনেকে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে লাশ, যা হয়েছে শকুনের খাদ্য। বব ডিলান, জর্জ হ্যারিসন, রবি শংকর ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠান করে তা থেকে প্রাপ্ত অর্থ শরণার্থীদের কল্যাণে ব্যয় করেন। প্রখ্যাত মার্কিন কবি অ্যালেন গিনসবার্গ রচিত ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতায় শরণার্থীদের অন্নহীন মানবেতর জীবনযাপন, জীর্ণ-শীর্ণ দেহ, মহামারী রোগ ও মৃত্যুর ছবি প্রতিফলিত হয়েছে। ‘লক্ষ প্রাণের ঊনিশ শত একাত্তর/ উদ্বাস্তু যশোর রোডে সব ধূসর/ সূর্য জ¦লে ধূসর রঙে মৃত প্রায়/ হাটছে মানুষ বাংলা ছেড়ে কোলকাতায়।/ সব্জিবিহীন অন্ন খেয়েই কাটছে দিন/ সপ্তাহেতে ৩টি দিনই অন্নহীন,/ দুধের ছেলে করছে উপোস মৃত প্রায়।/ যা কিছু খায় করছে বমি যন্ত্রণায়।’ হাজার হাজার মানুষের অসহায় মৃত্যু এবং শরণার্থীসমস্যা আন্তর্জাতিক জনমতকে প্রভাবিত করে।

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়