অন্যবেলা

জুয়েল আশরাফ :

আশ্বিন মাস। বিকেলে ভয়ঙ্কর বৃষ্টি হয়ে গেল। কিন্তু সন্ধ্যা হতেই ফুটফুটে  জোছনা। কালোমেঘেরা জোছনার অমলিন আলোর স্পর্শেই বুঝিবা লুকিয়ে পড়েছে! আশ্বিনের সন্ধ্যাগুলো কেমন স্যাঁতসেঁতে। অথবা মনটাই আজ ভেজা। এমন মন নিয়ে রাত বেড়ে ওঠার সঙ্গে ঘুমের জোর চেষ্টা চলল। যার ঘরে সকাল হলেই সতীন আসবে, সেই নারীর কি ঘুম নিরবচ্ছিন্ন হতে পারে? নায়লা ঘুমিয়েছিল। নিরবচ্ছিন্ন ঘুম। সকাল না হওয়া পর্যন্ত ঘুম ভাঙবে না, এমন ধারণাই ছিল। রাতে খাওয়ার পর পাশের বাড়ির বিলকিস ভাবির কাছ থেকে কী এক ওষুধ চেয়ে নিয়ে খেলো। একটা খেলেই নাকি সারারাত ঘুম ভাঙবে না। দুটি খেলে তো কথাই নেই। নায়লা তিনটাই খেয়ে দেখল। জীবনে ঘুম  থেকে আর জেগে না উঠুক, এমন ইচ্ছা নিয়েই হয়তো খেয়েছিল। কিসের কী! আজকাল ঘুমের ওষুধেও দুই নম্বরী।

রাত কত প্রহর কে বলে দেয়! আজ রাতের স্বপ্নগুলো বিচ্ছিন্ন আর ঝঞ্ঝাবাহী। নায়লা একটু আগেও স্বপ্ন দেখছিল যেন চরের তীব্র নির্জন কোনো এলাকা।  সেই এলাকায় প্রচ- ঝড় উঠেছে। সেই ঝড়ের মাঝে সে একা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে। তাকে বাঁচাবার কেউ নেই। ভয়ঙ্কর ঝড় চরটাকে গ্রাস করল কিন্তু তার কোনো ক্ষতি হলো না। তাকে মারবারও কেউ নেই! তারপর অচেনা যুবতী মেয়ে দেখল স্বপ্নে। মেয়েটি এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলছে, সাত মাসের বাচ্চা তোমার পেটে… বাচ্চাটাকে মরতে দিও না… বোন।

খোলা জানালা দিয়ে চৈতালি হাওয়া। তবু ঘেমেনেয়ে একশেষ নায়লা। ঘুম  ভেঙে গিয়েছে। পাশেই ঘুমে কাতর স্বামী। বিছানায় ওঠে বসল। জানালা দিয়ে চরাচর আর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কী স্বপ্ন দেখল সে। বুঝে উঠতে পারছে না যে। চরাচরজুড়ে এমন জোছনা যেন এ জীবনে দেখেনি সে।  জোছনার তীব্র আলো। বালিপথ চকমক করছে। কেন যেন সবকিছু শুভ মনে হতে লাগল তার। বাতাসে শুভবার্তা। আপনমনে গুনগুন করল, অন্তঃসত্ত্বা … অন্তঃসত্ত্বা … সন্তান … এ তো জীবন জুড়ে প্রার্থনা।’

স্মৃতি চঞ্চল হলো তার। আবর্জনার স্তূপ সরিয়ে মণিমাণিক্যের সন্ধান করছে  যেন স্মৃতি। কী যেন জেগে উঠেও হারিয়ে যাচ্ছে স্মৃতিকোণ থেকে। কী যেন। আরও গভীরে ডুব দিল মন। আরও অতলে। ভেসে উঠছে অতীতের একেকটা দিন… ছয় বছরের সংসারে একটি সন্তান দিতে পারেনি স্বামী ওসমানকে। দুজনই ডাক্তারমুখী হয়। ডাক্তারি পরীক্ষায় ধরা পড়ে অক্ষম স্ত্রী নিজেই, অর্থাৎ নায়লার ক্ষমতা নেই সন্তানধারণের। চরাচরের বালুর মতো হাতের মুঠোয় ঝরে পড়ে স্বপ্নগুলো। ওসমান দ্বিতীয়বার বিয়ে কোনোদিন করবে না। আজও বিয়েতে অমত। অঘোরে ঘুমাচ্ছে সে। শুধু একজন সন্তানের আশায় তার পাশে নিয়ে শুয়ে থাকবে কাল থেকে অন্য এক নারী। মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করছে নায়লার। মনে মনে ভাবতে থাকে, পঁচিশ বছর সংসারের পর সন্তানধারণের ক্ষমতা পেয়েছে এক গৃহবধূ। এই ধারা অমূলক নয়, হতেই পারে। সৃষ্টিকর্তা কাউকে আগে-পরে করে দেন। স্বপ্নে নায়লা নিজেকে অন্তঃসত্ত্বা দেখতে পেল। তবে কী ওসমানের দ্বিতীয় বিয়ের পর সে মা হওয়ার ক্ষমতা লাভ করবে? এরকম ঘটনা পুরানো দিনের হিন্দি সিনেমাতে দেখেছে। আর ভাবতে পারে না নায়লা। এ যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া। শাশুড়ির চাপে ওসমান বিয়ে হয়তো করবে না … না, না, স্বপ্ন-কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের পরিণতির যে আকাশ-পাতাল প্রভেদ। বিয়েটা হয়তো হয়েই যাবে কাল।

ধবধবে জোছনামাখা চরাচরের দিকে তাকিয়ে শুয়ে পড়ল নায়লা। বড় শ্রান্ত  সে। নিয়তির ওপর অনেক ভরসা তার। ঘুমিয়ে পড়ল নায়লা কিছুক্ষণের মধ্যেই। তবু ঘুম নিস্তরঙ্গ নয়। কোথাও একটা শুভবার্তা যেন ছড়িয়ে রয়েছে আজ এই জোছনার মধ্যে।

কাঁদছ কেন বউ? কাঁদছ কেন? তুমি যা চেয়েছ তাই তো হতে চলেছে। যা হবে ভালোই হবে। আহ! কেন যে অকারণ কাঁদো  তোমরা মেয়েমানুষরা!

মিহি সুরে কাঁদছে নায়লা। ওসমান সান্ত¡না দিচ্ছে। অদূরেই চরাচরে তীব্র  জোছনা আর নির্জনতা। স্বপ্নের সেই মেয়েটি যেন এখনও বলছে- পেটের বাচ্চাটিকে মরতে দিও না।

হৃৎপি-টি এত সহস্র তরঙ্গে ধাক্কা মারছে নায়লার  যে মনে হল এইবার সে সত্যি সত্যি অন্তঃসত্ত্বা হতে চলেছে। চোখ খুলল যখন, তখন চরাচরজুড়ে কলকাকলি। রাতের নৈঃশব্দ্য ভেঙে দিয়ে ভোরের বার্তা ঘোষণা করছে।

আজও খুব ভোরে ঘুম ভেঙেছে শিরিনের। আজ একটি-দুটি নয়, দেখতে  দেখতে কতগুলো বছর কেটে গেল। সময় বয়ে যায় সময়ের মতো।

বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করে। এখনও কাকপক্ষী ডাকেনি। অথচ তার ঘুম  ভেঙে যায় ঘড়ির কাঁটা ধরে। শুয়ে শুয়ে সতীনের কথা মনে পড়ছে তার। সেই ঊনিশ বছর বয়সে শাশুড়ি তাকে নিজের বাড়ি থেকে পছন্দ করে নিয়ে এলো। ঊনিশ বছর বয়সের নিজেকে আজও দেখতে পায় সে। শরীরভরা গহনা সাজিয়ে দিল শাশুড়ি। আর দুচোখ ভরে পানি এনে বলল, ‘আমার ছেলে কখনও বাবা হতে পারেনি, তাকে একটি সন্তান দিও। শাশুড়ির মুখের দিকে অবাক  চোখ নিয়ে তাকিয়ে ছিল সেদিন। যেন সন্তান দেওয়া-না দেওয়া প্রতিটি মেয়ের ইচ্ছা। যেকোনো মেয়ে চাইলেই স্বামীকে সন্তান দিতে পারে!

পাশে ঘুমন্ত স্বামী ওসমানের দিকে একবার তাকাল শিরিন। এই মানুষটিকে সে কি কোনোদিন সুখ দিতে পেরেছে, না কি পারবে? বিয়ের সময়ে কবুল বলবে না, এমনই হাবভাব তার। পরিশেষে নায়লা সাধাসাধি করে কবুল বলিয়েছিল। ঘটনা শুনে শিরিনের মনে আজও হাসি পায়।কোনো পুরুষকে দ্বিতীয়বার বিয়েতে রাজি করাতে প্রথম স্ত্রীর যারপরনাই অনুরোধের ঘটনা বুঝি জীবনে প্রথম শুনেছে শিরিন! সেই লাজুক স্বভাবের পুরুষ আজ তারই স্বামী।

হি হি হি। হাসল শিরিন ঘুমন্ত স্বামী ওসমানের মুখের দিকে তাকিয়ে। দেখতে  দেখতে তিন তিনটি সন্তানের বাবা ওসমান আজ। বড় মেয়েরই বিয়ের বয়স হয়ে গেল। ভালো পাত্রের খোঁজখবর চলছে। ছোট দুজন পড়াশোনায় ভালো। একজন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। মঈন নাম তার। শোনা যাচ্ছে পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে একজন মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক আছে। ছোট মেয়েটি পড়ছে এবার ইন্টারমিডিয়েট। সে দেখতে অদ্ভুত সুন্দর হয়েছে। ঠিক যেন তার মায়ের আদলে গড়া। এ পরিবারের মেয়েরা প্রত্যেকে রূপবতী। অবশ্য শিরিন নিজেও সুন্দর, সতীনের রূপ ছাড়িয়ে গিয়েছে সে। বউ হয়ে যখন এই বাড়িতে আসে, পাড়ায় তার রূপের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। রূপগুণ দিয়ে আর কী হয়, যদি মা হওয়ার যোগ্যতাই না থাকে!

ছোট মা, আমার চুলটা বেঁধে দাও।’

শিখা এসে ঢুকল ঘরে। শিরিন এক ঝটকায় উঠে বসল। বাসিমুখে হাসি টেনে এনে বলল, এই সকালে এত সাজগোজ করে যাবি কোথা শিখা?’

শিখা বিছানায় বসে বলল, স্বাস্থ্য সচেতন করতে আমাদের টিম আজ গ্রামে কাজ করবে। সকাল সকাল যেতে হবে।

চুল বাঁধা শেষ হলে শিখা ওঠে চলে গেল। শিরিন নামল বিছানা ছেড়ে। এলো সতীনের ঘরে। নায়লা শুয়ে আছে কাঁথা জড়িয়ে। শিরিন বিছানায় বসে কপালে হাত রাখে।

কে?

আপা আমি শিরিন। ডাকোনি কেন আমাকে? শিখার কাছে শুনলাম, সারারাত জ্বর তোমার।

পানি খাব, পানি এনে দে।

এক গ্লাস পানি এনে দেয় শিরিন। নায়লা ওঠে বসে পানি খেতে গিয়ে বিতৃষ্ণায় মুখ সরিয়ে নেয়।

তিতা লাগে পানি।

তোমার অসম্ভব জ্বর শরীরে। উনাকে ডাকি। তোমাকে এখনই হাসপাতালে  নেওয়া দরকার।’

শিরিন চলে যাওয়ার জন্য দাঁড়াতেই নায়লা বাধা দিল। হাত ধরে পাশে বসাল। বলল, ভয় পাস না। আমার করোনা হবে না। সাধারণ জ্বর। একদিন পরেই  সেরে যাবে। তুই একটু থাক আমার পাশে। তোর সঙ্গে কথা বলি।

কথা হলো না। জ্বর শরীরে শুতেই নায়লা ঘুমিয়ে পড়ল। এই ঘুম সারাদিন চলল। মাঝে মাঝে শিরিন এসে দেখে গেল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল যায়, নায়লার ঘুম ভাঙে না। একসময় শিরিন সতীনকে জাগায়।

আপা সন্ধ্যা হয়েছে। সারাদিন না খেয়ে ঘুমিয়েছ। ওঠে খেয়ে নাও।

নায়লা ওঠে ঝিম মেরে বসে থাকে। কিন্তু শিরিনের মনে হতে লাগল জ্বরের  ঘোরে বিড় বিড় করে সতীন কী সব বলছে। শিরিন বাইরে এলো। সন্ধ্যার আকাশে একখ- মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। আশ্বিন মাস। ভারীবর্ষণ হবে। হলোও তাই। চরাচরে প্রচ- বর্ষণ হলো আর চোখে পড়ল শাশুড়ির কবরের কাঁচা মাটিতে কিছু ঘাসফুল জন্মেছিল, বৃষ্টির পানি পেয়ে সেগুলো তরতর করে বেড়ে উঠেছে। সন্তানের আশায় ছেলের বউ করে শাশুড়ি শিরিনকে এনেছিল এই বাড়িতে। তিন বছর যেতেই ডাক্তারি পরীক্ষায় যখন নিশ্চিত জানা গেল শিরিনেরও কোনোদিন মা হওয়ার সম্ভাবনা নেই তখনই শাশুড়ির আসল রূপ  দেখতে পেল। তৃতীয়বার ছেলেকে বিয়ে করানোর জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। এক তো বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে শিরিনের অমতে বিয়ে, তার ওপর স্বামীর তৃতীয় বিয়ে মেনে  নেওয়া তার পক্ষে কোনোদিন সম্ভব ছিল না। বিয়ে হওয়ার পর স্বামী আর নায়লার কাছ থেকে কোনোদিন কষ্ট পায়নি। এখানে এসে সে সতীন না, যেন একজন বড়বোন পেয়েছে। নায়লার আচরণে সেটাই সব সময় প্রকাশ পেতো। কিন্তু এখন শাশুড়ির অত্যাচার সহ্যসীমার বাইরে। নায়লা খুবই ভালো মানুষ, শাশুড়ির কটু কথা সারাজীবন মুখ বুজে সহ্য করেছে। শিরিন ঠিক তার উল্টো স্বভাবের। শাশুড়ির সঙ্গে বাক-বিত-ায় লেগে থাকত। এরপর ওসমানের তৃতীয় বিয়ের কথাবার্তা যখন চূড়ান্ত হয়, ঠিক আগের দিন শিরিন জীবনের বড় পাপ কাজটা করল। দিনটি ছিল আশ্বিন মাসের সন্ধ্যা। তীব্র বৃষ্টি ছিল সেদিন। শাশুড়ি ঘুমিয়েছিল নিজের বিছানায়। শিরিন আস্তে পায়ে কাছে গিয়ে তার মুখের ওপর বালিশ চেপে ধরল। সেই ঘুমই শাশুড়ির জীবনের শেষ ঘুম। মিনিট দশ মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর সে এলো শান্ত ভঙ্গিতে নায়লার ঘরে। অকপটে বলল, আমি শাশুড়িকে খুন করে এলাম। নায়লা অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল। ওসমান জানলো। ঘণ্টা দুই বাদেই এলাকায় জানাজানি হলো।  লোকজনে গিজগিজ করতে থাকে বাড়ি। রাত দশটার দিকে পুলিশের গাড়ি আসে। মায়ের মৃত্যুর শুরু থেকেই ওসমান ছিল নির্বাক। অল্পভাষী মানুষটি জীবনে প্রথম মনে হয় একটি ভালো কাজ করল। পুলিশের কাছে নিজের মায়ের মৃত্যুর ঘটনা বলল মায়ের কথামতো তৃতীয়বার বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় মা আত্মহত্যা করেছে। পুলিশও মেনে নিল। পুলিশকে সামলালো  নেতৃস্থানীয় কিছু লোক। এই ঘটনার দুই বছর বাদেই আশ্চর্য ঘটনা ঘটে, আল্লাহর কী অসীম লীলা! নায়লা প্রথমবার সন্তানের মা হয়। জ্বরের ঘোরে নায়লা তখন বারবার সে কথাই বলছিল, আশ্বিনের সন্ধ্যার বৃষ্টি বড় ভয় লাগে। মনে হয় কেউ আমার গলা টিপে ধরেছে। শাশুড়িকে গলা টিপে আমি আগেই  মেরে ফেলেছিলাম। এরপর তুই গিয়ে মুখে বালিশ চেপে ধরেছিস। এই সত্যটা আমি কোনোদিন কাউকে বলিনি।