চলচ্চিত্র ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্ট কিন্তু ইন্ডিভিজুয়াল নয় : রফিকুল আনোয়ার রাসেল

২০২০ সালের ২৭ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রযোজিত রফিকুল আনোয়ার রাসেল নির্মিত ফিচার ডকুমেন্টারি ‘আ ম্যান্ডোলিন ইন এক্সাইল’-এর ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয়। তিনি চলচ্চিত্র সংসদকর্মী, সংগঠক, নির্মাতা এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যকলা বিভাগে চলচ্চিত্রের খ-কালীন শিক্ষক। এছাড়া টেলিভিশন, ওয়েব প্লাটফর্মের জন্য কাহিনি ও চিত্রনাট্যরচক। তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্র অস্ট্রেলিয়া, ইউকেসহ বিভিন্ন অনলাইন ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণ  করেছে। রেইনবো চলচ্চিত্রসংসদ আয়োজিত দেশের সর্ববৃহৎ চলচ্চিত্র আয়োজন ‘১৯তম বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, ঢাকা ২০২১’ এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত ‘নবম আন্তর্জাতিক মুক্তি ও মানবাধিকার চলচ্চিত্র উৎসব, ২০২১’-এ প্রদর্শিত হতে যাচ্ছে ‘আ ম্যান্ডোলিন ইন এক্সাইল’ চলচ্চিত্রটি। রফিকুল আনোয়ার রাসেল-এর দীর্ঘ চলচ্চিত্রযাত্রার উত্থান-পতনের নানাদিক এবং রাজধানীর বাইরে থেকে দেশের একজন সফল নির্মাতা হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে আলাপচাতিায় অংশ নেন আলম খোরশেদ

 

চট্টগ্রামের চলচ্চিত্রচর্চার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আপনার অভিমত জানতে আগ্রহী। সেই সঙ্গে এখানকার নতুন প্রজন্মের চলচ্চিত্রকারদের প্রতি আপনার পরামর্শও

রাসেল : নির্মোহভাবে বলতে গেলে যা আসে তা হলো হতাশা, অভিমান আর কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা। আমি প্রথম থেকেই বিশ্বাস করতাম, বাংলাদেশের মধ্যে খুব ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণের সুযোগ চট্টগ্রামেই আছে। বিশেষ করে আমরা যদি কমার্শিয়াল বা রেভেনিউ জেনারেটিং সিনেমা বাদ দিয়ে আর্টহাউস বা কন্টেন্ট নির্ভর সিনেমানির্মাণ নিয়ে ভাবতে চাই। সেক্ষেত্রে চট্টগ্রাম আদর্শ স্থান। তবে তরুণদের সেদিকে মনোযোগ নেই। এর কারণ আছে। প্রথমত জাতীয় সব অনুদান, ফান্ড বা প্রাইভেট সুবিধা সবই ঢাকাকেন্দ্রিক।

চট্টগ্রমে প্রফেশনাল কাজের ক্ষেত্র কম। একমাত্র সিটিভি’র বাইরে অডিও-ভিজুয়াল নিয়ে কাজ করার সুযোগ নেই। নিউজ চ্যানেলগুলো তাদের লোকাল কর্মীদের নিউজের বাইরে কোনো কাজ দেয় না। ডকুমেন্টারি বা স্পেশাল ফিচারধর্মী কাজে ঢাকা থেকে প্রফেশনালদের পাঠিয়ে দেয়। ফলে চট্টগ্রামের তরুণদের এই অবস্থায় কোনো সুযোগ নেই। এটি বিস্ময়কর যে, ২০১৯ সালে আমিই প্রথম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তথ্যচিত্র নির্মাণের ফান্ড জিতেছি। ভারতের গোয়ার ফিল্মবাজারেও সুযোগ পেয়েছি। ঢাকা থাকলে এসব সুযোগ পেতে অনেক রেফারেন্স থাকে, যেমন একটি ‘রোড টু কান প্রোগ্রাম’ বা অন্যকিছু। কিন্তু চট্টগ্রামের ফিল্মমেকারের এসব জায়গায় কোনো সুযোগ পাওয়া হয় না। অনুদান, পুরস্কার বা সম্মানের ক্ষেত্রে পরিচিতরাই সচরাচর প্রাধান্য পান।

অনেকের মধ্যে বিভ্রান্তিও আছে। যেমন, চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের আর দরকার  নেই। এটা ঠিক, সবার হাতে হাতে এখন ডিভিডি, সিনেমা। যে যার মতো করে দেখছে কিন্তু নির্দেশনা নেই, পাঠ নেই। অথচ, আমরা সবাই কমবেশি চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ফসল, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। প্রতিষ্ঠিতদের মধ্যে খুব কম আছেন যারা বলতে পারবেন, ফিল্ম সোসাইটি মুভমেন্ট তাদের তৈরি হতে সাহায্য করেনি। এই যে আমরা হাটে-মাঠে-ঘাটে গিয়ে সিনেমা দেখতাম- দেখাতাম, এটার সবচেয়ে বড় উপকার হলো প্রথমত আমরা শিখলাম,  সিনেমা কি? পথের পাঁচালি আর অন্য বাণিজ্যিক সিনেমার মধ্যে উন্নত কোনটা ? এই বিভ্রান্তি পুরো ব্যাপারটাকেই ভিন্নপথে নিয়ে গেলো। এনজিওভিত্তিক তথ্যচিত্র নির্মাণ, বিজ্ঞাপন জগতের লোকজন ফিল্ম নিয়ে নিজেদের মতো একটা ভাষা তৈরি করলো, অথচ এর শৈল্পিক বা বৈপ্লবিক কোনো প্রভাব নাই। এমন কি এসব চলচ্চিত্র উৎসবে খুব ভালো কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। এর বাইরে একটি বিশাল অংশ মিডিয়া আর টেলিভিশন নাটকের দিকে চলে গেল। অনেকদিন সেখানে ভালো কাজ হলেও পরে সেটা বাজারি মানুষে ভরে গেল। টিভি নাটক থেকে দর্শক চোখ ফিরিয়ে নিল। তবে ইদানীং অনেক ভালো কাজ হচ্ছে। এর মাঝে বিচ্ছিন্নভাবে মনপুরা, ব্যাচেলর, শুনতে কি পাও, টেলিভিশনসহ অনেক সিনেমা তরুণদের কাছ থেকে এল। আমাদের চলচ্চিত্রের এখন কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। কেউ  ফেস্টিভ্যালে ছুটছে, কেউ বিদেশি ফান্ড চাচ্ছে। সব ফান্ড এখন শেষ হয়ে শুধু সরকারি অনুদানের দিকে সবাই ঝুঁকছে। মানে কোথাও অর্থ নাই, অথচ ফিল্ম বানাতে সবচেয়ে বেশি যেটা লাগে সেটা হল অর্থ। আর সেখানেই আমাদের সব আশা-ভরসা এখন শেষের দিকে। এই ঢেউ চট্টগ্রামে নয় শুধু, সারাদেশেই আছড়ে পড়েছে। ফলে  চলচ্চিত্রপাঠ, অনুধাবন বা তার নান্দনিকতা  নিয়ে ভাবছে না কেউ। যে কেউ যা কিছু বানিয়ে বলছে – এটাই সিনেমা। চট্টগ্রামে এসবের ধাক্কা লাগেনি বলা যাবে না। ২০১৪ সালে সেই  ফ্রেমস অফ লাইফের সফল প্রদর্শনীর পর চট্টগ্রামের পটভূমিতে কাজ শুরু হয় ওয়াহিদ তারেকের ‘আলগানগর’, যা এখনও মুক্তি পায়নি।

চট্টগ্রামের আরও একটি সমস্যা হচ্ছে অদক্ষতা আর কর্মসংস্থানের অভাব।  কেউ একটু শিক্ষিত হলে ঢাকার দিকে চলে যাচ্ছে কাজের খোঁজে। এখানে যারা আছে, তারা কাজ না পেয়ে যা পাচ্ছে ছোটখাটো, তা নিয়েই ব্যস্ত। ২০১৪-২০১৫ সালের পরে অনেক কাজ হয়েছে, কিন্তু এখানে নির্মাতাদের মধ্যে সমন্বয়  নেই। সবাই যার-যার মতোকরে গন্তব্যে পৌঁছাতে উদগ্রীব। অথচ একটি পিছিয়ে পড়া এলাকায়, কম সুবিধাপ্রাপ্তির জায়গায় সম্মিলিতভাবে কাজ না করে উপায় নেই। চট্টগ্রামে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে নিজেদের মতো করে একটি নতুন কাজের ক্ষেত্র বা সম্ভাবনা তৈরি করছে – এমনটা এখন পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি। আমি কয়েকবার চেষ্টা করে এখন শারীরিক বা মানসিক কোনোভাবে আর উৎসাহ পাই না।

সামনের দিনগুলোতে চলচ্চিত্রকে ঘিরে নিজের স্বপ্ন ও পরিকল্পনা সম্পর্কে বলুন …

রাসেল : নিজের কাজ নিয়ে আমি খুব আশাবাদী বলতে চাই না। তবে এটাও বুঝি,  আমার কাজ করে যাওয়া বাদে আর উপায় নেই। আমি ঢাকা-চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কলকাতাÑ কাজের স্থান হিসেবে ফিক্সড কিছুই ভাবছি না। যেখানে ফিল্ম নিয়ে কাজ করার সুযোগ পাবো সেখানেই আছি। তবে, বেসমেন্ট এড্রেস যদি বলেন তাহলে চট্টগ্রামে আছি। এখানে কাজের প্রচুর সুযোগ আছে, কন্টেন্ট আছে, নির্মাণ বা ভাবনার সুযোগ আছে। সারা পৃথিবীতেই এখন টেকনিকেল  যোগাযোগ বলুন, কারিগরি সহযোগিতা বলুনন, খুব সহজলভ্য। প্রয়োজন শুধু  মেধা, শিক্ষা আর প্রয়োগ। আমরা সেদিকে মনোযোগ দিচ্ছি না। আবার গল্প বলার কন্টেন্টও বদলে যাচ্ছে। বর্তমান দর্শক বিশাল হিরোর কাহিনি শুনতে চায়, তা সব সময় না। ফিকশন বা ডকুমেন্টারিতে সাধারণ মানুষের গল্পই ওঠে আসছে। আমি গল্প বলার মানুষ। যেকোনো প্লাটফর্মে আমি গল্প বলতে চাই।  এখন আমার এক বন্ধুকে নিয়ে ফিল্ম করছি, যার স্ট্রাগলের কাহিনি পৃথিবী শুনতে চায়। কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রোডাকশন মার্কেটে সাবমিট করেছি, তারা আগ্রহ দেখাচ্ছে। ইন্টারনেট প্রযুক্তির কারণে পৃথিবীর সাথে একইতালে চলতে পারছি। এতদিন আমরা কমপ্লেইন করেছি যন্ত্রপাতি নাই, প্রতিনিধি নাই, সুযোগ নাই বলে আমরা আন্তর্জাতিক হতে পারছি না। এখন সেটা ভাঙছে। কিন্তু আমরা আটকে যাচ্ছি ভাবনা, একাগ্রতা আর কিউরেটিংয়ের জায়গায়। আমরা কান-বার্লিন-ভেনিস-সানডান্স সবখানে যাচ্ছি, কিন্তু আমাদের সিনেমা কি যাচ্ছে  তেমন ?

ফান্ড, ফেস্টিভ্যাল বা পুরস্কার হয়তো উৎসাহ দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের শিল্পকাজই কালের তালিকায় যুক্ত হয়। মানুষ কিন্তু কাজটাকেই মনে রাখে। অনেক সিনেমা আমাদের দেশের মানুষ দেখে না। সিনেমা যেন মানুষের কাছে  পৌঁছায়, নির্মাতাদের উচিত সেদিকটা অনুধাবন করা।

এটা ভুলে গেলে চলবে না, চলচ্চিত্র একটি যৌগিক মাধ্যম। এটি ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্ট কিন্তু ইন্ডিভিজুয়াল নয়। তাই একটি সম্মিলিত ফোর্স কাজ করতেই হবে। একজন লোক একটি ফিল্ম বানাতে পারে একক চেষ্টায়, কিন্তু অনেকে একসাথে সামগ্রিক ভাবনায় কাজ না করলে একটি ফিল্ম মুভমেন্ট হয় না। সবাই নিজের মতো একা প্রথম হতে চাইছে স্কুলের ফার্স্টবয়ের মত। আর বাকিরা যদি সব শূন্য পেয়ে ফেল করে তাতে সামগ্রিকভাবে স্কুলের কোনো লাভ নেই। ইদানীং আমরা কয়েকজন একসাথে কাজ করে শুরু করেছি। সেই কনসেপ্ট থেকেই  আমি স্ক্রিপ্ট লিখছি, আরেকজন সম্পাদনা করছে, নির্দেশনা দিচ্ছে, আরেকজন আমার কাজে সম্পাদনা করছে।