দাদুর মুখে চাঁদের হাসি

এমরান চৌধুরী

একটা বিশাল ফ্লাটে সাড়ে তিনজন মানুষ। আর সেই সাড়ে তিনজন মানুষের সেবাযতেœর জন্যে আছে দু’জন কাজের লোক। অর্ডার দিলেই টেবিল চলে আসে যা সব ঝটপট। তবু লোকগুলোর মধ্যে শান্তি নেই।
ক’দিন ধরে সুমন খেয়াল করছে মা, কী একটা বিষয় নিয়ে বাবার কান ভারি করে তুলছে।
ঠিক কী বিষয় সুমন তা বুঝতে পারে না। আবার কাছে গিয়ে আড়ি পাতাও সে পছন্দ করে না। তাদের ধর্ম স্যার বলেছেন, বড়রা কথা বলার সময় অনুমতি ছাড়া আশেপাশে থাকতে নেই।
সানরাইজিং স্কুলের ৭ম শ্রেণির ছাত্র সুমন। বড়লোক বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। পড়াশোনায় বেশ মেধাবী ও বন্ধুপ্রিয় । ফলে ক্লাসের সব বন্ধুরা ওকে খুব ভালোবাসে। ওর সঙ্গে যেমন পড়ে বড় বড় লোকের ছেলেরা, তেমনি পড়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরাও। সবার প্রতি ওর গলায় গলায় ভাব। ওর বন্ধুদের দু’একজনের বাবা ফ্লাটবাড়ির মালিক। তবে বেশিরভাগই থাকে ভাড়া বাসাবাড়িতে। কারও বাসা আধাপাকা টিনশেডের। কেউ পাকা ঘরে থাকলেও থাকে গাদাগাদি করে। তাদের অনেকের বাসায় কোনো না কোনো বুড়ো মানুষ আছে। অসুস্থ মানুষ আছে। কারও বাসায় দাদা, কারও বাসায় দাদু, আবার কারও বাসায় নানুও থাকে।
মানুষ থাকলেই তো ভালো। যেখানে মানুষ সেখানে ভালোবাসা। যেখানে মানুষ নেই সেখানে ভালোবাসা নেই। মানুষ থাকলে কথা বলা যায়। সুখদুঃখ ভাগাভাগি করা যায়। কিন্তু ওদের বাসাটা যে কী হলো বুঝতে পারছে না সুমন। কারও মুখে হাসি নেই। মায়ের মুখটা দেখতে মনে হয় তিনি একা এক কেজি তিত করলা খেয়ে বসে আছেন। আর দাদুকে দেখতে মনে হয় বড় অসুখী। আর বাবা! কী করবেন যেন ভেবেই উঠতে পারেন না।
বাবা সারাদিন অফিস সেরে যেই বাসায় ফিরেন অমনি শুরু হয় খটর খটর। লোকটা ভালোমন্দ কিছু খেলো কিনা তা জানার কোনো গরজ নেই। মা দাদুর বিরুদ্ধে এক ঝাঁপি অভিযোগ নিয়ে বসে বলা শুরু করেন, তোমার মা অ্যান করেছে ত্যান করেছে ইত্যাদি।
সুমনের দাদুর বয়স ষাট পেরিয়েছে অনেক আগে। আগে গ্রামে থাকতেন। সুমনের এক ফুফু দেখাশোনা করতেন। ফ্লাট কেনার পর বাবা দাদুকেও নিয়ে আসেন শহরে। ভেবেছিলেন মা দিনের বেলায় একা একা থাকেন, দাদুকে কাছে পেলে ভালো লাগবে। ক’দিন বেশ ভালোই কাটল।কিন্তু দিন কয়েক যেতে না যেতে শুরু হলো খটর মটর।
দাদুর নানা অসুখ। বাতব্যাধি সঙ্গে ডায়াবেটিস। তাও অনেকদিন থেকে। অনেকে বলেন ডায়াবেটিস রোগীদের মেজাজ প্রায়ই খিটখিটে থাকে। তাঁরা বড় বেশি অভিমানী হয়। অল্পতেই রেগে যান। এঁদের ব্যাপারে সতর্ক থেকে সেবা করে যেতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা বয়স্ক লোক কখন কী বলে ফেলেন মুশকিল। ফলে সেবাকারী যে কোনো সময় অসন্তুষ্ট হয়ে যেতে পারে।
বাবা সেদিন অফিস থেকে ফিরেই মা ও দাদুর কী নিয়ে মাতামাতি শুনতে পান। তিনি কাছে গিয়ে সুমনের মায়ের কাছে জানতে চান কি হয়েছে?
কী আর হবে? তোমার মা কখন কি খাবেন সেটাই বুঝতে পারছি না!
তোমার মা বলছ কেন? আমার মা-তো তোমারও মা।
তা ঠিক আছে। কিন্তু ওনার কী খেতে ইচ্ছে করছে তা বলবেন তো!
তা তুমি জানতে চাইলেই হয়।
কি আর জানতে চাইব! এই বললেন তরকারি খাবেন। তরকারি দিলে বলেন মাছ খাবেন। আর দেব যে সে সময়টুকু তো দিচ্ছেন না। আর কথায় কথায় বলছেন উনি গ্রামে চলে যাবেন।
এতক্ষণ বাবার পাশে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনছিল সুমন। এবার তার মুখে সুড়সুড়ি অনুভব করল সে। কিছু একটা বলতে চায় সে। তাই বাবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, বাবা আমি কি কিছু বলতে পারি?
বলো? কী বলতে চাও।
বলছিলাম পরিবেশের কথা। গ্রামের বাড়িতে দাদুর সময়টা কেটেছে ঘরে বাইরে করে।
ঠিক তাই।
আর এখন উনি আছেন অনেকটা খাঁচার পাখির মতো। এখানে ওর বয়সী কেউ নেই যে দু’চারটা কথা বলবে। তাই হয়তো ভালো লাগছে না।
তুমি ঠিক বলেছ সুমন। সাবাস। পিঠ চাপড়ে ছেলেকে উৎসাহ দিলেন সুমনের বাবা।
জানো বাবা! আজ স্কুলে ধর্ম স্যার একটি কথা বার বার বলছিলেন।
কী কথা!
বয়স হলে মানুষ শিশু হয়ে যায়। শিশুদের মতো আচরণ করে। তখন ওদের প্রতি সবার সেবাযতœও তেমন হওয়া উচিত।
সুমনের এই মুরব্বিসুলভ কথায় বাবার মন ভরে ওঠে। তাঁর দু’চোখে ঝিলিক মারে এক ঝলক আলো। তিনি মাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, কাল আমরা সবাই গ্রামের বাড়িতে যাব। কি বলো মা!
বাবার কথা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ার আগেই সুমন দেখতে পেল দাদুর চোখে নেমে এসেছে দুধের বাটির মতো আস্ত চাঁদ।