কাকের উদারতা

সানজিদা আকতার আইরিন :

কাক আর বুলবুলির বাসাবাড়ি পাশাপাশি দুটি গাছে। বুলবুলির রোজ ঘুম ভাঙে কাকের কর্কশ ঝগড়ায়। মনে মনে বুলবুলি দম্পতি খুব বিরক্ত হয় এ আচরণে।এমন অসভ্য অসামাজিক পাখির সাথে বাস করা দায়। কাক দেখতেও যেমন অসুন্দর তেমনি কণ্ঠেও কর্কশতা।স্বভাবেও খুব নোংরা। এলাকার সব ডাস্টবিনে কাকের আনাগোনা বলে ওদের দেখেও মেজাজ খারাপ হয় বুলবুলি পাখি দুটির। সহজে ওর মুখদর্শন করে না তারা। সেই কোন সকালে ওঠেই কলহ-কোন্দল শুরু করে দেয়। এজন্যই তো সবে বলে কাকডাকা ভোর। কাকের বাসায় ছানাপুনা আছে। তাদের খানাপিনা জোগাড় করা কম কথা নয় বলে সারাদিন খেটে মরে। তার ওপরে আত্মীয়-প্রতিবেশীর অভাব নেই। কিছু হলেই কাকের পাল ভরে যায় তার বাড়িতে। তাদের উপলক্ষের শেষ নেই। যখন-তখন যা তা নিয়ে লড়াই-ঝগড়া । সৌখিন বুলবুলির পরিবার বেশ ছিমছাম। কোনো মতে পেটটা ভরে গেলে দুজন ইচ্ছেমতো ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় আকাশে। যেমন ইচ্ছা ছোটে এদিক-ওদিক। কাকের পরিবারে কোলাহল লেগেই থাকে বলে কারো কান সুস্থ থাকার জো নেই। ছেলে কাকটি মাঝে মাঝে কোথায় যেন পালিয়ে যায়। ফিরে এলে খুব তাদের ঝগড়ায় কান পাতা দায়। তাদের আসহ্য সংলাপ বুলবুলির পরিবারের শান্তির ব্যাঘাত ঘটায়। কাক সম্মেলনের নেতারা তাদের গাছে প্রায়ই মিটিংয়ে বসে। কোন্ এলাকা কোন্ কাকের দখলে থাকবে সে এজেন্ডায় তারা আলোচনা চালায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। নির্বাচনের সময় কাকের উপস্থিতিতে সয়লাব হয়ে যায় গাছটি। তখন তাদের বিকট শোরগোলে কানকে সহ্য করতে হয় চরম অত্যাচার। বুলবুলিরা তখন নিজেদের সুস্থ রাখতে দু-তিন দিন অন্য কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসে। এর-ওর বাড়ির সাবান, জুতা, রুটি, সেদ্ধ ডিম, মুরগির নাড়িভুঁড়ি ছিনতাই করে লোকের দুশমন হয়ে যায় কাকের গোষ্ঠী। এতে কাকের প্রতি মানুষের এত বিরক্তি আসে যে তারা কাকের বাসা ভেঙে দেয় মাঝে-মাঝে। এতে করে বুলবুলির ক্ষতির পরিমাণও কম হয় না। ভুল করে কাকের বাসা ভাঙতে গিয়ে বালবুলির বাসাও ভেঙে দেয় ক্ষিপ্ত লোকেরা। আবার নতুন করে বাসা বানানোর কষ্টে কাকের প্রতি বিরক্তির শেষ থাকে না বুলবুলিদের। আবার কষ্ট করে নিজের বাসা বানাতে মনে মনে অভিশাপ দিয়ে যায় অসামাজিক পাখি কাককে। এই পাখিটি এমন এক পাখি যে-পাখিকে সমাজের উচ্চমানের পাখিরা এড়িয়ে চলে। আবার কেউ-কেউ বর্জনও করে তাদের। তাদের বুদ্ধির বহর নিয়েও পাখিসমাজে রমরমা গল্প কম নয়। তাদের বুদ্ধিহীনতার জন্য কোকিল কৌশল করে বাচ্চা ফুটিয়ে নিয়ে যায়, তা প্রায় সব পাখিদেরই জানা। শুধু তাদের একতাটাই সবার অনুকরণীয়।

কিছুদিন হলো খাবার খুঁজতে গিয়ে বুলবুলির দেখা মেলে সৌখিন টিয়া, শিল্পী বাবুই, সদালাপী ময়না, সুন্দরী টুনটুনি, মিষ্টিফিঙে আর জাতপাখি দোয়েলের সাথে। বুলবুলি এদের নিয়ে একটা সুন্দর পাখিসমাজ গড়ার প্রস্তাব করে। তার গাছে বাসা বানাতে অনুরোধ করে সবাইকে। যাতে অন্তত পাখির সামাজিক পরিবেশটা ছানাগুলো উপভোগ করতে পারে। তার অনুরোধে এসব সামাজিক পাখিরাও এ গাছে বাসা করে বসবাস করতে রাজি হয়ে যায়।সবাইকে নিয়ে তৈরি হয় সুন্দর একটা সুশীল সমাজ। অন্তত কাকের সাথে বসবাস করার দুঃখটা ঘোচে বুলবুলির। বাগানের পাশের বাড়িতে থাকে একঝাঁক মিশুক চড়ুই। তারাও ইদানিং বুলবুলিদের গাছে সময় কাটিয়ে যায়। কোকিল, শ্যামারাও সপ্তাহ অন্তর এই গাছে আড্ডা মেরে যায় এই সভ্য পাখিদের কাছে এসে। গত কদিন আগে বুলবুলির বাচ্চা ফুটিয়েছে। নরম ঠোঁটে নতুন শাবকের মায়াভরা ছানাগুলো বুলবুলিকে নতুন করে বেঁচে থাকার আনন্দ জোগায়। বেশ কিছু ডিম নষ্ট হওয়ার পর বহু কষ্টে এবার বাচ্চা ফোটার আনন্দে প্রতিবেশী পাখিদের নিয়ে একটা ভোজের আয়োজনও করলো গত কয়েকদিন আগে। বক, সারস, আর মাছরাঙা ঠোঁটভর্তি করে মাছ নিয়ে আসে। কাকাতুয়া আনে অনেক বড় একটা পাকা আম। ময়না আনে লিচুর রস আর টিয়ারসংগ্রহ  মস্ত আতা।এছাড়াও যে যেমন পেরেছে জাম, কলা, কিম্বা ছোটপোকার সংগ্রহে সে দিনটি ছিল ভোজনবিলাসের সুন্দর আয়োজন। কাককে যদিও তারা দাওয়াত করেনি তবুও নির্লজ্জের মতো একখানা কাঁঠালের ভূতি নিয়ে হাজির। ডাস্টবিনের আধপচা ভূতি দেখে সভ্যপাখিরা বিরক্তিতে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। শেষমেষ অভাগা কাক সবার কথায় কষ্ট পেয়ে নিজের বাসার ডালে গিয়ে একাই তার সংগ্রহের ভূতির স্বাদ গ্রহণ করতে থাকে।

 

মা বুলবুলি পাখিটা যখন খাবার খুঁজতে বাইরে যায় বাবা পাখিটা তখন ছানা পাহারায় থাকে। কিন্তু বর্তমানে খাদ্যসংকট থাকায় খাবার খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাই গত কয়েকদিন ধরে বাবা-মা দুজনই খাবারের সন্ধানে বের হয় তাদের ছানাগুলোর জন্য। কয়েকদিন পর ওরা নিজেরাই উড়তে পারবে। তখন আর খাবার সংগ্রহের প্রয়োজন হবে না।

এক সন্ধ্যায় হঠাৎ দমকা হাওয়ার সাথে শুরু হয় ঝমঝম বৃষ্টি। সব পাখি বিপদ দেখে আগেভাগেই নীড়ে ফিরে আসে। এ সময় কি করে যে বুলবুলির বাসাটা ছিঁড়ে মাটিতে পড়ে তা পাখিগুলো বুঝতে পারে না। খারাপ আবহাওয়ায় সব পাখিরা নিজের বাসায় দুরু-দুরু মনে নিরাপদে থাকার চেষ্টা করে। বাইরে বের হবার সাহস নেই তাদের। তারা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে আর ছানাগুলোর করুণ পরিণতি নিয়ে চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। যে-যার বাসায় নিরাপদে থাকলেও ছোট্ট ছানাগুলো বৃষ্টির কবলে পড়ে ঠান্ডা লেগে যাবার ভয়ে অস্থির সভ্যগোষ্ঠীর পাখিরা। যেকোনো অঘটন ঘটার আশঙ্কায় সময় পার করতে থাকে পাখিগুলো। কাক পরিবার মাত্র বাসায় ফিরে। ছোট্ট ছানার দুর্দশা তাদের চোখ এড়ায়নি। ছেলে কাকটি বাসায় ঢুকে পড়লেও মেয়ে কাকটি ছোঁ মেরে ঠোঁটে আর পায়ে বাচ্চা দুটোকে নিয়ে বাসায় লুকায়। সব পাখি আতংকিত হয়ে কাকের নিন্দা-মন্দ করে অনুভূতি প্রকাশ করে। বুলবুলি পাখি দুটি আজ খানিক দূরে খাবার খুৃঁজতে যায় বলে ঝড়ের মধ্যে বাড়ি ফিরতে বেশি সময় লেগে যায়। ঝড় থেমে গেলেও বেশ ঠান্ডা পড়েছে। তাই সব পাখি মন খারাপ করে নিজ বাসায় বসে কাকের এমন কা-ের আলোচনায় মশগুল থাকে। তার এ কুকর্মকে তারা মেনে নিতে না পেরে বুলবুলির সাথে তারাও এর একটা বিহিত করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়।

আজ বুলবুলির বাচ্চা কেড়ে নিল, কাল অন্যদের বাচ্চা কেড়ে নেবে লোভী কাক। ওকে এগাছ থেকে বিতাড়িত করতেই হবে। পাখিসমাজে ওর নামে নালিশ ঠুকতে হবে। যেন চিরদিনের জন্য ওকে বয়কট করা যায়। সভ্যসমাজে এমন অসভ্য আচরণ কিছুতেই মানবে না অন্য পাখিরা। এমন চাপা গুঞ্জনের মধ্যে বুলবুলি পাখি ফিরে এলো গাছে। কিন্তু তাদের নীড়ের দুরবস্থা দেখে তাদের পিলে চমকে যায়। কান্নায় ভেঙে পড়ে। তাদের সন্তানের হদিস না পেয়ে অস্থির হয়ে ওঠে। কান্নার আওয়াজ শুনে যে যার বাসা থেকে শুধু মাথাটুকু বের করে বিষয়-বৃত্তান্ত ব্যাখ্যা করতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে বুলবুলি। মা পাখিটা দিশেহারা হয়ে প্রতিশোধের ক্রোধে বকতে থাকে কাকের উদ্দেশ্যে। এবার ওকে দেখে নিতে চায় সে। এতদিন ওর অনেক অসভ্যতা মেনে নিয়েছে বুলবুলি। আজ এর দফারফা করেই ছাড়বে। হয় কাক থাকবে, না-হয় বুলবুলি থাকবে, এমন সাবধান বাণী করতে-করতে বুলবুলি কাকের বাড়ির ডালে উড়ে যায়। সাথে যায় বাবা পাখিটিও। আজ শান্ত ও ভদ্রপাখি বুলবুলির মুখেও অনেক বুলি। কাকের নামধরে ডাকতে থাকা অনবরত ডাকগুলোতে বিচলিত না হয়ে কাক তখন শান্ত সুরে সুধায়, কেমন মা গো তুমি? এত ছোট ছানা রেখে অত দূরে ঘুরে বেড়াও? আমি না থাকলে তোমার ছানারা শীতে মরেই যেত।

এই দেখো, আমি তোমার ছান গুলো ওমে রেখেছি। ওরা খুব আরাম পাচ্ছে। তোমার বাসা ভেঙে গেছে। নাও আজ তোমরা আমার বাসার অতিথি। ছানাগুলো নিয়ে আমার বাসায় থাকো। দেখো আমি ওদের অযতেœ রাখিনি। আমরা দুজন অন্য কোথাও ব্যবস্থা করে নেবো। ছেলে কাকটিও সম্মতি দিয়ে বলে, জানোই তো কদিন আগে ওর ডিম ফেলে কোকিল ডিম পেড়ে রেখে গেছে। সেই ডিমের বাচ্চা হলো ঠিকই, তবে তা আমাদের ছানা হলো না। কি নিষ্ঠুরভাবে কেড়ে নিল ছানাগুলো। আমার বউকাকটি মাতৃত্বের কষ্টে আছে খুব। তোমরা কিছু মনে করো না ভাই। বুলবুলি দুটি মেয়ে কাককে জড়িয়ে ধরে ডাকাডাকি করে কাঁদতে থাকে। অন্যসব পাখিরা ঠান্ডায় যখন নিজ বাসায় আরামে ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন কাকদম্পতি মগডালের পাতার আড়ালে জড়াজড়ি করে রাত কাটিয়েও সুখ পায়। তীব্র ঠান্ডা তাদের উদারতার কাছে হার মেনে যায় তখন।

বুলবুলি দুটি সারারাত ঘুমায়নি। তারা খুব কৃতজ্ঞ ও লজ্জিত। অন্যসব সভ্যনামের ভদ্রপাখিরা কেউ বাসা থেকে বেড়িয়ে দেখেওনি কি হলো। অথচ কাক নিজের বাসাটাই ছেড়ে দিল ছানাগুলোর জন্য। তাদের মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে উদার পাখি কাক। লোকে যতই তাদের নিন্দা করুক। কাকের এই উদারতার জন্য বুলবুলি সারাজীবন কাকের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে বলে প্রতিজ্ঞা করলো।

সেই থেকে কাক হলো বুলবুলির বড় বুবু।