সোহানের মুক্তিযোদ্ধা দাদু

শেলীনা আকতার খানম

আজমল সাহেব একজন মুক্তিযোদ্ধা। সরকারি চাকুরিজীবী ছিলেন। অবসর জীবন যাপন করছেন এখন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা। ডান পা’তে গুলি লাগাতে পা একটু খুড়িয়ে হাঁটেন। বয়সের ভারে শরীরটা নুয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে শরীর বেশ খারাপ হয়ে যায়। আজো ভালো লাগছিলো না বলে বিছানায় শুয়েছিলেন।
এসময় সোহান দৌড়ে আসে। আজমল সাহেবের নাতি। আজমল সাহেবকে বললো,
জানো দাদু, আজ আমার স্কুল বন্ধ।
তাই নাকি! তাহলে তো খুব খুশির খবর!
চঞ্চল স্বভাবের সোহান কথাটা বলেই বাড়ির পাশের খেলার মাঠে খেলতে চলে যায়।
সোহান! বাবা সোহান! ক্ষিদে পেয়েছে না তোর? জলদি খেতে আয়। কিছুক্ষণ পর মায়ের ডাক।
মায়ের কথা শুনেও খেলায় মেতে থাকে সে। এবার দাদু আজমল সাহেব বিছানা ছেড়ে উঠে সোহানকে ডাক দেয়। দাদুর ডাক শুনে দৌড়ে সোহান বাসায় আসে। গিয়ে দেখে দাদু নাস্তার টেবিলে তার অপেক্ষা করছে।
সোহান চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। একে তো ভালো ছাত্র। আবার কথায়ও খুব পটু। স্যারেরা তাকে বেশ পছন্দ করে। নাস্তা খেতে বসে সে দাদুকে প্রশ্ন করে।
আচ্ছা দাদু শোনো। তোমাকে বলেছি না আজ আমাদের স্কুল বন্ধ! আসলে স্কুল ঠিক বন্ধ নয়, খোলা। আজ কোনো ক্লাস হবে না স্কুলে। স্যারেরা বলেছেন স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান হবে। তাই স্কুলে সবাইকে যেতেই হবে।
দাদু মুচকি হেসে বললেন, ‘আজ স্বাধীনতা দিবস’তো। তাই এ সব আয়োজন।
আচ্ছা দাদু, স্বাধীনতা দিবস কী? স্বাধীনতা দিবস কেনো হলো? সোহানের হঠাৎ এমন প্রশ্নে দাদু রীতিমতো নড়ে চড়ে বসেন। বুঝতেই পারেনি দাদু, সোহান এমন প্রশ্ন করবে! তবে সোহানের জানার আগ্রহ দেখে মনে মনে দাদু খুব খুশি হলেন।
-স্বাধীনতা কি জানো না দাদু?
জানি জানি! বলছি শোনো
মানুষের জীবনে প্রথমত সাধারণ কিছু চাহিদা থাকে। প্রতিটা মানুষ সবকিছুই সে তার নিজের মতো করে করতে চায়। এতে বাইরের কারো হস্তক্ষেপ আশা করে না। সবাই নিজস্ব বিষয়াদি নিয়ে নিজের মতো করে চলতে চায়, থাকতে চায়। স্বাধীনতার বিষয়টি আপন-পর ধারণার সাথে সম্পর্কিত। স্বাধীনতা শব্দকে ভাঙলে আমরা পাই স্ব+অধীনতা। স্ব মানে নিজ বা আপন। অর্থাৎ নিজের অধীনে বা নিজ অধীনতা। যে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজের অধীন এবং আর কারো অধীন নয়। সে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী হলো স্বাধীন। বুঝলে দাদুভাই!
সোহান দাদুর দিকে তাকিয়ে থেকে আলতো করে
‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ে। সব কথা যে সোহান বুঝতে পারেনি, দাদু তা বুঝতে পারলেন।
দাদু সোহানকে আরেকটু কাছে ডেকে বসান। সহজ করে বলার চেষ্টা করেন। শোনো, একটা পাখি যদি খাঁচায় বন্দি থাকে, সে কি তার ইচ্ছে মতো খোলা আকাশে উড়ে বেড়াতে পারবে! ইচ্ছে মতো কোথাও যেতে পারবে? খেতে পারবে? খেলতে পারবে? পারবে না। ঠিক তেমনি, বন্দি খাঁচায় কারো নজরে থাকার মতো অবস্থায় ছিলাম আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের অধীনে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আহবানে তা থেকে মুক্তি পাবার জন্য আমরা সে সময়ের এই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলাম। যুদ্ধে জয়লাভ হয় আমাদের। এই জয়ের মাধ্যমেই আমাদের স্বাধীনতা অর্জন হলো। আমরা পেলাম লাল সবুজের একটা পতাকা। দেখো দাদু, তুমি এখনো অনেক ছোটো। বড় হলে সব বুঝতে পারবে, আরো অনেক জানতে পারবে আস্তে আস্তে।
আচ্ছা দাদু, একুশে ফেব্রুয়ারি, বিজয় দিবস এগুলোও কি—?
সোহানের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে দাদু বলেন,
হ্যাঁ, দাদু এসব কিছুই কিন্তু আমাদের এই স্বাধীনতার সংগ্রামের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
এ সব কিছুই কিন্তু তোমাকে জানাবো। তুমি জানতে পারবে।
আচ্ছা দাদু, আমার আব্বু যুদ্ধ করেনি?
না, রে দাদু! তখন তো আমি বিয়েই করিনি। তোমার আব্বু তো ছিলই না।
কথা বলতে বলতে দাদু ও সোহান একসময় ঘর থেকে বের হয়ে উঠোনে চলে আসে।
দাদু বলেন, শোনো আজ বিকেলে আমাদের গ্রামের সংগঠনে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে আমি অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখবো । তুমি আমার সাথে যাবে। স্বাধীনতা দিবসসহ সব বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও বলার চেষ্টা করবো। আমিসহ অন্যান্য বক্তার কাছ থেকে আরো অনেক কিছু জানতে পারবে।
দাদুর সাথে বিকেলে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে যাবে শুনে সোহানের মনে খুশির বন্যা বয়ে যায়।
সোহান খুশিতে আব্বু আম্মুকে গিয়ে তার আনন্দের কথা জানায়। আর অপেক্ষার সময় গুনতে লাগলো কখন বিকেল হবে! কখন দাদুসহ অন্যদের মুখে অনুষ্ঠানে স্বাধীনতা দিবসের কথা শুনবে!