তমার শখ

শাহারুল ইসলাম সুজন :

তমা এবার ষষ্ঠ শ্রেণি উঠেছে। তার বয়স ১২ বছর। পরিবারে রয়েছে মা-বাবা, দাদা দাদি ও চার বছরের ছোটভাই। পরিবারের সবার অনেক আদরের মেয়ে তমা। লেখাপড়ায় অনেক ভালো সে। শিক্ষকেরা তাকে অনেক আদর-যতœ করেন। প্রতি শ্রেণিতেই তমা প্রথম- দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। তমার অনেকগুলো গুণ রয়েছে। ছবি আঁকা, গান গাওয়া, বক্তৃতা দেওয়াসহ প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রে সে অনেক চালু। এগুলোর মধ্যে তমার সবচেয়ে প্রিয় হলো বইপড়া। সে বই পড়তে খুবই ভালোবাসে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে সে পুরস্কার পেয়েছে অনেক, বই জমিয়েছে। তার পড়ার টেবিলে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার বই।

ছোট ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইও তার নজরে থাকে। সে শ্রেণির পড়ালেখার পাশাপাশি গল্পের বই পড়ে। পড়তে-পড়তে পড়ার মাঝে যে চিত্রগুলো থাকে সেগুলো খাতায় এঁকে রাখতে ভুল করে না। তার পরিবারও তার প্রতি অনেক দায়িত্ববান। সবাই তাকে নিয়ে অনেক আশাবাদী। এজন্য তমা কোনো আবদার করলে  সেটা রাখতে বাধ্য হয়। মামার কাছ থেকেও বই নিতে ভুল হয় না তার। তার মামা ঢাকায় থাকে। প্রতিবার বাসায় আসার আগে তার জন্য বই নিয়ে আসাটা বাধ্যতামূলক। একদিন তমা তার বান্ধবীদের সাথে স্কুলের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে সকাল-সকাল চলে গেল।

আর এই ফাঁকে তার ছোটভাই তার পড়ার টেবিলে বসে খাতা-কলম, গল্পের বই, শ্রেণির বই সব এলোমেলো করে ফেলল। ইচ্ছামত যা খুশি তাই করতে লাগলো। কলম দিয়ে বইয়ের ওপর দাগাদাগি করে বিশ্রী একটা অবস্থা করে ফেলল। তমার আম্মু এ বিষয়ে অবগত ছিল না। মা রান্নার কাজে ব্যস্ত। ছিল এজন্য বুঝে উঠতে পারেনি। হঠাৎ করে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে দেখে ছেলে তার এই অবস্থা করে রেখেছে। আম্মু হতবাক হয়ে গেল। মেয়ে যেমন একগুঁয়ে এবং বইপ্রেমী। সে যদি এসব দেখে তাহলে তার কান্না থামানো যাবে না।

এজন্য আম্মু তাড়াতাড়ি করে পাশের বাড়ির তমার শ্রেণিতে পড়ছে এক বান্ধবীর মায়ের কাছে এ ঘটনা বলে সেখান থেকে পাঠ্যবইসহ কিছু গল্পের বই নিয়ে আসে। সেগুলো তমার টেবিল পরিষ্কার করে সেখানে  রেখে দেয়। বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠান শেষ হলে তমা বাসায় ফিরে আসে দুইটা গল্পের বই এবং একটা ছবি আঁকার রঙের বাক্স নিয়ে। এগুলো সে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা এবং অন্য খেলাধুলা করে পুরস্কার হিসেবে পেয়েছে। আনন্দের সাথে আম্মুকে সেসব কথা বলতে লাগল। তারপর সে তার পড়ার টেবিলে বইগুলো রাখতে যায়।

হঠাৎ তার চোখে পড়ে তার টেবিলের রাখা বইগুলো আগের মত নেই। বইগুলো অন্যরকম দেখাচ্ছে। সে আম্মুকে দেখে জিজ্ঞেস করল, এগুলো কার বই? আমার বইগুলো কোথায়? তার আম্মু একটু নিম্নস্বরে বলল, এগুলোই তোমার বই। তমা কিছুতেই বিশ্বাস করল না। বাধ্য হয়ে আম্মু সবকিছু খুলে বলল। ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে তমার সে কি কান্না! দুপুরের খাবার পর্যন্ত খেলো না। দাদা-দাদি এত করে বুঝাতে চেষ্টা করল। কিন্তু  কে শোনে কার কথা। বিকেলের দিকে তার বাবা বাসায় ফিরে। তমা বাবার সাথে কান্না করতে করতে এসব বলে।

তার বাবা আদরমাখা কন্ঠে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করল এবং বলল  তোমার মামা কিছুদিন পর বাসায় আসবে। তাকে তোমার জন্য অনেক নতুন বই কিনে আনতে বলবো। তখন একটু শান্ত হলো তমা। কিন্তু মামা কখন আসবে, কখন আসবে এটা বলে তোলপাড় শুরু করে দিল। তখন বাবা তার মামার সাথে কথা বলে দুইদিনের মধ্যে চলে আসতে বলল। সঙ্গে কিছু পাঠ্যবই, গল্পের বই ও রং পেনসিলের বক্স নিয়ে আসতে বলল। এটা শুনে তমা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল! তখন বাবা তাকে আদর করে খাইয়ে দিল। এভাবে একদিন চলে গেল। তমা অপেক্ষা সহ্য করতে পারছে না। মামাকে কল দিয়ে নিজেও একবার আবদারের কথা জানালো।

মামা বলল, তোমার জন্য সবকিছুই নিয়ে আসব। এই তো কালই চলে আসব। তমা খুশি মনে বাইরে চলে গেল খেলা করতে। তখন সামনে যাকে পায় তাকে এ কথা বলতে লাগল। তার বন্ধুদের কেউ কেউ বলল, কয়েকটা বই আমাকে ধার দিস।

তমা সাদামনের হলেও নিজে সবগুলো বই শেষ না করার আগে কাউকে  দেবে না, একথা বলে দিল। সবার সাথে একটু মনোমালিন্য হলেও আবার খেলায় মেতে ওঠে তারা। সবাই একসাথে যার যার বাসায় ফিরে গেল। সন্ধ্যা নেমে এলো। তমা হাতমুখ ধুয়ে ছোটভাইকে নিয়ে  খেলতে বসল। আজ সে আর পড়বে না। শুধু বলতে থাকলো, এই রাতটুকু যায় না কেন।

রাত পেরোলেই সকালে চলে আসবে মামা। নতুনবই দেখার আনন্দে নাচতে শুরু করে দিল সে। ছোটভাইকে কোলে নিয়ে কত কি বোঝাতে থাকলো। এমন কাজ করতে নেই, সবাই খারাপ বলবে, দুষ্টু বলবে, পাপ হবেÑ এসব কিছু বলতে লাগলো। ছোটভাই আধো আধো কন্ঠে বলল, সে এমন আর করবে না। রাত দশটা বাজল। রাতের খাবার খেয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। তমার মনে  শুধু বই নিয়ে কল্পনা। কোন বই কখন পড়বে, কোনটা কোথায় রাখবে, কতদিনের মধ্যে পড়া শেষ করবে। সে এসব নিয়ে ভাবতে থাকল।

চোখে ঘুম এসে যায় তার। পরদিন সকালে মামা এলো তাদের বাসায়। মামা ব্যাগ থেকে তার আবদারের জিনিসগুলো বের করে দিল। এগুলো  দেখে খুশিতে মামাকে জড়িয়ে ধরলো সে। মামা তাকে বলল, তুমি একদিন অনেক বড় হবে। তোমার মধ্যে সেটা দেখতে পাচ্ছি আমি। বইপড়া একটা ভালো অভ্যাস। বই পড়লে অনেক জ্ঞান বাড়বে। সবকিছু জানতে পারবে। আরো বেশি বেশি বই পড়বে। এখন থেকে তোমার যখন যে বই লাগে, আমাকে বলবা। আমি সেগুলো নিয়ে আসবো।

মামার কথা শুনে সে খুশি মনে মাথা কাত করে সায় দিল।