রাজা ও রাক্ষুসীর গল্প

মিনহাজ উদ্দীন শরীফ :

বহুদিন আগেকার কথা। চন্দ্রাবতী রাজ্যের রাজা ছিল হরিদাস। সে একদিন শিকার করার জন্য এক গভীর অরণ্যে গেল। শিকার খুঁজতে-খুঁজতে বনের এক প্রান্তে যেতে না যেতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। সে মনে-মনে ভাবল, একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার না হয় শিকার খুঁজতে যাবো। সে একটা বড় বৃক্ষের নিচে বসে ঘুমিয়ে  গেল। হঠাৎ করে একটা রাক্ষুসী এসে বলল, কে গো তুমি আমার দ্বারে ঘুমিয়ে আছো! রাজা হরিদাস গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়েছিল। তাই সে রাক্ষুসীর কথা শুনতে পায়নি। রাক্ষুসী বিরক্ত হয়ে চিৎকার করে বলল, এক্ষুণি আমার রাস্তা থেকে সড়ে দাঁড়াও। রাজা হরিদাস চমকে ওঠে বলে, কে এভাবে চিৎকার করছে? রাক্ষুসী বলল, এদিকে চেয়ে দেখ! সে চেয়ে দেখে আকাশ আর জমিনে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল আকারের রাক্ষুসী। কিন্তু রাক্ষুসী ছিল খুবই সুন্দরী।

সে জানতো রাক্ষুসীরা মানুষের রক্ত চুষে খায়। তাই সে রাক্ষুসীকে মারার জন্য তীর আর ধনুক তার দিকে তাক করে ধরেছিল। রাক্ষুসী বলল, নিজের মরণ নিজেই ডেকে আনছো! রাজা ভয় পেয়ে যায়।  বলে, তাহলে আগে বলো আমার কোনো ক্ষতি করবে না। রাক্ষুসী বলল, আমি কেন তোমার ক্ষতি করবো!  আমরা তোমাদের মানুষের মতো দুষ্ট না। তোমরা মানুষ জাতি বিনা কারণে একে অন্যের ক্ষতি করো। আমরা বিনা কারণে অন্যের ক্ষতি করি না। তুমি আমার রাজ্যের দ্বারে ঘুমিয়ে আছো। তাই তোমাকে জাগাতে চেয়েছি। রাজা হরিদাস বলে, কোথায়  তোমার রাজ্য? সে বলল, এই বৃক্ষের ভিতরে আমার রাজ্য। রাজা হরিদাস বলল, আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমি জানতাম না এই বৃক্ষে তোমার রাজ্য! আমি ছোটোবেলা থেকে জেনে আসছি তোমরা মানুষের রক্ত চুষে খাও। এ জন্যই আমি প্রথমে নিজের জীবনরক্ষা করার জন্য তোমাকে মারার জন্য তীর-ধনুক হাতে নিয়েছিলাম। রাক্ষুসী বলল, তোমার ধারণা ভুল। আমরা বিনা অপরাধে কারো রক্ত চুষে খাই না। যারা দুষ্ট তাদের আমরা শাস্তি দেই।

রাজা বলল, আমার খুব তৃষ্ণা পেয়েছে। আমি এখন আসি।  রাক্ষুসী বলল, তুমি আমার রাজ্যের অতিথি। তোমার তৃষ্ণা  পেয়েছে,  আমি ব্যবস্থা করছি। কোথাও তোমাকে যেতে হবে না। রাক্ষুসী বৃক্ষের সামনে গিয়ে বলল :

‘দ্বার মেলে দাও সবুজপাতা

এসে পড়েছি তোমার মাতা …

এই কথা বলার সাথ সাথে বৃক্ষের বাকল সরে গিয়ে ঝকঝকে একটা সোনার দ্বার এলো। কিন্তু দ্বারটা ছিল বন্ধ। রাক্ষুসী আবারও বলল :

‘দাও মেলে দাও সোনার দ্বার,

হবো আমরা রাস্তা পার …

এ কথা বলায় দ্বারটা ও খুলে গেল। রাজা কথা না বলে শুধু  দেখছে। অবশেষে রাক্ষুসী তার রাজ্যে নিয়ে গেল রাজাকে।

রাজ্যের সব কিছু ছিল সোনার। রাজা এসব দেখ একটুও লোভ করল না। রাক্ষুসী রাজাকে সোনার বিছানায় বসিয়ে পানি এনে দিল। রাজা পানি খেয়ে বলল, রাক্ষুসী  আমি কি এখন যেতে পারি? রাক্ষুসী বলল, একটু বিশ্রাম করে যাও। তুমি তো ক্লান্ত। সত্যিই রাজা ক্লান্ত ছিল। তাই সে রাজি হয়ে গেল। সে সোনার পালঙ্কে  শুয়ে পড়ামাত্র ঘুমের দেশে চলে গেল।

সে স্বপ্নে দেখে রাক্ষুসী তার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুমপাড়ানির গান শুনাচ্ছে। দুজনে মিলে নেচে-গেয়ে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ তার ঘুম  ভেঙে যায়। সে বুঝতে পারল, আগে যা দেখেছে সেটা স্বপ্ন ছিল। কিন্তু রাজা রাক্ষুসীকে  মনের  অজান্তে খুব ভালোবেসে ফেলেছে। তাই সে রাক্ষুসীকে বিয়ের প্রস্তাব দিল। রাক্ষুসী শুনে বলল, আমি রাক্ষুসী জেনেও তুমি আমাকে কেন বিয়ে করতে চাও? সে বলে, তুমি নিজেই বলেছিলে তোমরা কাউকে বিনা কারণে শাস্তি দাও না। কিন্তু মানুষ বিনা কারণে শাস্তি দেয়। এজন্য আমি বিয়ে করতে চাই। রাক্ষুসী বলে, ঠিক আছে, আমি রাজি! তারপর দুজনের বিয়ে হয়।

রাজা রাক্ষুসীর নাম দিল মায়াবতী। রাজা মায়াবতী রানিকে নিয়ে নিজের রাজ্যে ফিরে যায়। চন্দ্রাবতী রাজ্যের প্রজারা নবরানির  রূপ দেখে রাজার প্রশংসা করল। বহু দূর-দূরান্তের মানুষও নবরানিকে দেখে রাজার প্রশংসা করে গেছে। এভাবে চার-পাঁচ বছর কেটে যায়। তারপর তাদের একটা পুত্রসন্তান জন্ম নেয়।  মায়াবতী সেই থেকে তার রাক্ষুসে কর্মত্যাগ করে মানুষের মতো বসবাস করতে থাকে।

রাজা হরিদাস ও পুত্রসন্তানকে নিয়ে তার দিন সুখেই কাটছে।