করোনা : সংকুচিত হচ্ছে কর্মসংস্থান ও জীবিকার সুযোগ

মোতাহার হোসেন »

বৈশ্বিক মহামারি করোনায় পুরো বিশ^ ব্যবস্থা অনকেটাই ওলট পালট করে দিয়েছে। মানুষের সাথে মানুষের চিরকালীন যে সম্পর্ক তাতেও অনেকটা ভাটা পড়েছে। ঠিক অনুরূপ বিশে^র দেশে দেশে মানুষের কর্মসংস্থান, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শিক্ষা, বিনোদন, সাংস্কৃতিক, আত্মিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ঘটেছে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব। বলতে গেলে সব ক্ষেত্রেই বিরাজ করছে এক বিশাল স্থবিরতা, অনিশ্চয়তা। অন্ধকার সময় যেন মানুষকে, বিশ^ব্যবস্থাকে গ্রাস করেছে। একই সাথে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, আমাদের যাপিত জীবন ব্যবস্থার চিরাচরিত প্রথা ভেঙে দিয়ে এক নতুন বাস্তবতা, কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে মানুষকে।
শহর থেকে গ্রাম, দেশ থেকে বিদেশ, কাল থেকে কালান্তর মানুষের কর্মের সংস্থান, বাসস্থানের সংস্থান, খাদ্যের সংস্থানে পদে পদে, ধাপে ধাপে সমস্যা সংকুল, অনিশ্চয়তার পথে ধাবিত হচ্ছি আমরা। ইতোমধ্যে এর পূর্বাভাস পরিলক্ষিত হয়েছে দেশের সর্বস্তরে। শহর থেকে শহরতলী, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে মহামারি করোনা। ঠিক একইভাবে তা সমভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে বিশে^র তামাম শক্তিধর,প্রভাবশালী সব রাষ্ট্রেও। চাকরিচ্যুতি, কর্মহীন হওয়া, কর্মের পরিধি ছোট হয়ে আসা, পারিশ্রমিক অর্ধেকে নেমে আসাসহ কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশের মতো দেশে এই সংকট আরো প্রকট হওয়ার আশংকা করছেন সংশ্লিষ্ট মহল।
বিশেষ করে বৈশি^ক মহামারি শুরু থেকে বাংলাদেশসহ বিশে^র করোনায় আক্রান্ত সব দেশেই ‘লক ডাউনের’ বা এক ধরনের অলিখিত-অঘোষিত বন্ধ কর্মসূচির কারণে অফিস আদালত, কলকারখানা, বাস, ট্রাক, ট্রেন, বিমান, লঞ্চ, স্টিমার, ব্যবসা কেন্দ্র, বাণিজ্য কেন্দ্র জাহাজ বন্ধসহ ক্ষেত্র বিশেষে মানুষের যাতায়াত, চলা ফেরাও বন্ধ থাকায় চাকরিনির্ভর লক্ষ কোটি মানুষ কর্মহীন ও বেকার হয়ে পড়েছে। এ কারণে শহরের নি¤œ আয়ের মানুষ, শ্রমিক, দিনমজুর, গার্মেন্টসসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্প কারখানায় কর্মরত মনুষকে অনিশ্চয়তার মুখে বাধ্য হয়ে শহর ছেড়ে যেতে হচ্ছে গ্রামে। এই প্রবণতা এখনো অব্যাহত আছে সমভাবে। প্রতি মাসের শেষ অথবা শুরুতে শহর থেকে গ্রামে চলে যাওয়ার দৃশ্য প্রত্যক্ষ হয়।
বিদেশে সাধারণ চাকরিজীবী,শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশায় জড়িত অনেকেই কর্মহীন হয়ে, চাকরিচ্যুত হয়ে খালি হাতে ফিরছে দেশে। এই সংখ্যা ইতোমধ্যে ৪ লাখ ছাড়িয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা আরো কিছু দিন বিশে^র দেশে দেশে অব্যাহত থাকলে কয়েক লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীকে দেশে চলে আসতে হবে। বর্তমানে বিশে^র বিভিন্ন দেশে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ কর্মরত আছেন। এদের মধ্য থেকে যদি আরো প্রবাসী বাংলাদেশিকে দেশে চলে আসতে হয় তখন আগামীতে দেশে নতুন করে বেকারত্ব বাড়বে। বাড়বে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা। তখন এ সব বেকার, কর্মহীন মানুষ এবং তাদের পরিবার, পরিজনকে দৈনন্দিন খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় সহায়তার ভার বহন করতে সরকারকে হিমসিম খেতে হবে।
প্রসঙ্গত; করোনা শুরুর আগে পরে রাজাধানীসহ দেশের সকল বিভাগীয়, জেলা শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে শুরু হয়েছে কর্মসংস্থানের প্রকটতা। শহরে বসবাসরত নি¤œ আয়ের, মধ্যবিত্তদের বিরাট অংশ কর্মহীন হওয়ায় বাসা ভাড়া পরিশোধ করা, তাদের দৈনন্দিন ব্যয় বহন, সন্তানের ভরণ পোষণ, লেখা পড়া,চিকিৎসা ব্যয় বহনের অভাবে তারা শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন। অন্যদিকে বিদেশ থেকে চাকরি হারিয়ে দেশে আসা মানুষও গ্রামে যাচ্ছেন। সব মিলিয়ে শহরের মতো গ্রামেও এখন কর্র্মসংস্থানের সুযোগ কমে আসছে। কাজেই কর্মহীন হয়ে বিদেশ থেকে প্রবাসীদের দেশে ফেরা, আর শহর থেকে কর্মহীন হয়ে গ্রামে যাওয়া মানুষের জীবন, কর্ম, জীবিকা সব কিছুই এক ঘোর অন্ধকারের বৃত্তে বন্দি হচ্ছে। করোনার বিরূপ প্রভাবে উদীয়মান অর্থনীতির দেশ, সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্রযাত্রা, এগিয়ে চলা, অগ্রগতি, উন্নয়ন অভিযাত্রার গতিকে বাধাগ্রস্ত করবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
অভাবেÑঅনটনে থাকা কর্মহীন শহরের নি¤œ আয়ের মানুষ শহর থেকে গ্রামের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এসব মানুষ কর্মসংস্থান ও খাদ্য সমস্যায় পড়ছে। এরকম একটি করুণ কাহিনী সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ‘রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে বসবাস করতেন একজন নি¤œ আয়ের মানুষ। চাকরি না থাকায় খাবারের টাকা জোগাড় করাই মুশকিল তার পক্ষে। লক ডাউন শুরুর দিকে দুই মাসের ঘর ভাড়া বকেয়া পড়ে। ভাড়া পরিশোধের জন্য চাপ বাড়ে বাড়িওয়ালার। বাড়িওয়ালাকে তিনি বলেছিলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই সব ভাড়া পরিশোধ করে দেবেন। কিন্তু বাড়িওয়ালা তা মানেনি। স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ভাড়া বাকি রাখা যাবে না। অগত্যা ধারদেনা করে বকেয়া ভাড়া পরিশোধ করে মে মাসের শেষের দিকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকা ছাড়েন তিনি’। এমন বেদনার গল্প শুধু এই ভদ্রলোকের একার নয়; করোনায় বিভিন্ন শ্রেণি- পেশার অনেক মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার। অনেকে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের ঠিকানায় গিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে আরও অনিশ্চিত সময় পার করছেন। সেখানেও কাজের অভাব। কীভাবে আগামীতে ঘুরে দাঁড়াবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় তারা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) থেকে বলা হয়েছে, দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী যেসব লোক কাজ হারিয়ে গ্রামে চলে গেছেন, তাদের নগদ অর্থ-সহায়তা কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে। রাস্তাঘাট সংস্কার করে গ্রামে সরকারি ভাবে কাজের সুযোগ বাড়ানো জরুরি। এতে সেখানে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও অস্ট্রেলিয়ার ওয়াল্টার এলিজা হল ইনস্টিটিউটের যৌথ গবেষণায় বলা হয়, ‘‘করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে দেওয়া লকডাউনের কারণে ৯৬ শতাংশ পরিবারের গড় মাসিক উপার্জন কমে গেছে। অর্থনৈতিকভাবে নিজেকে অস্থিতিশীল মনে করছেন ৯১ শতাংশ মানুষ।’’ এখন বাংলাদেশে লকডাউন নেই। বিশে^র বিভিন্ন দেশেও লকডাউন অনেকটাই শিথিল। তবুও এর ধাক্কা এবং করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের কর্মসংস্থানের উপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।
করোনাকালে অনুরূপভাবে সমতলের আদিবাসীদের জীবনযাপন নিয়ে জরিপ করে ইনডিজিনাস পিপলস ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস (আইপিডিএস)। সঙ্গে ছিল ইউরোপের মাইনরিটি রাইটস গ্রুপ (এমআরজি-ইউরোপ)। তাদের জরিপে উঠে আসে, ‘‘করোনায় দেশের সমতলের ৯২ শতাংশ আদিবাসীর আয়-রোজগার কমে গেছে। ৭২ শতাংশ চাকরি হারিয়েছে। এতে অন্তত ৫ লাখ আদিবাসী ‘নতুন করে দরিদ্রে’ পরিণত হয়েছে।’’ গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) যৌথ এক গবেষণায় বলা হয়, ‘‘করোনাকালে রাজধানী ছেড়ে চলে গেছে ১৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ মানুষ। বাড়িভাড়া, চিকিৎসা, সন্তানের শিক্ষা এবং যোগাযোগ খরচ বহন করতে না পেরে তারা ঢাকা ছেড়ে বাড়ি চলে গেছে। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের চিত্রও প্রায় অভিন্ন। করোনাকালে কাজ হারিয়ে চট্টগ্রাম থেকে অন্যত্র চলে গেছে ৯ শতাংশ মানুষ।’’
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) এর অভিমত, ‘‘এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সবার জীবিকার ব্যবস্থা করা। শহর বা গ্রাম- সব জায়গার জন্যই এ কথা প্রযোজ্য। চাকরি ও কাজ হারিয়ে অনেকে গ্রামে ফিরে গেছেন। আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে শহরে ফিরে আসার চেষ্টা করবেন। গ্রামে যে কাজের সংকট, এটা সাময়িক। পরিস্থিতি ভালো হলে গ্রামে ফিরে যাওয়া লোকটি আবার শহরে ফেরত আসার চেষ্টা করবে- এটাই সত্য। যে কোনো দেশের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তার জনগোষ্ঠীর গ্রামে বসবাসের প্রবণতা কমে। এখন দেশের ৩৫-৪০ শতাংশ লোক শহরে বসবাস করছে। একটা সময় ৭০-৮০ শতাংশ বা তারও বেশি জনগোষ্ঠী হয়তো শহরে বসবাস করবে।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ৯৮ শতাংশ জনগোষ্ঠী শহরে বসবাস করছে। অথচ সপ্তদশ শতাব্দীতে দেশটির ৯৮ শতাংশ লোক গ্রামে বসবাস করত। ‘করোনাকালে কর্মহীন লোকদের টিকে থাকার ব্যবস্থা করতে দেড় কোটি লোককে খাদ্য ও আর্থিক সহায়তার আওতায় আনা দরকার। মাসে তিন-চার হাজার টাকা করে দিতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। গ্রামে কর্মসংস্থান বাড়াতে হলে কৃষিকাজের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট সবকিছুতে প্রযুক্তির ছোঁয়া আনতে হবে। দেশে অনেক আগেই অনেক এলাকা থেকে লাঙল ও গরু দিয়ে চাষ করা প্রায় উঠে গেছে। কৃষিতে শতভাগ প্রযুক্তির ব্যবহার করা জরুরি। যেখানে সব কাজ যন্ত্রচালিত হবে।
এতে শিক্ষিত তরুণরাও কৃষিতে ঝুঁকবে। তবে সামগ্রিক অবস্থার বিবেচনায় করোনা অর্থনীতিসহ মানুষের মনোজগতেও যে আঘাত দিয়েছে, সেখান থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে হয়তো আরো অনেক সময় লাগবে।’’
তবে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিকে আগের জায়গায় নিয়ে আসতে হলে কলকারখানাসহ সব প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি সচল করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সেটা সচল রাখাও চ্যালেঞ্জ। তবে অর্থনীতি আগের জায়গায় নিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এই চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হবে। এটা করা গেলে কাজ হারানো লোকগুলো আবার কাজ ফেরত পাবেন। করোনাকালে সরকার ১৯টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল। প্রত্যাশা থাকবে এই প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। তখন কারখানাসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আবার সচল হবে। তবে কর্মহীন মানুষের অনিশ্চয়তা, বেকারত্বের অবসান হবে। একই সাথে শহর ও গ্রামের মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ ফিরে আসবে।

লেখক : সাংবাদিক