করোনার বৈশ্বিক বিস্তার ও রাজনৈতিক প্রভাব

রায়হান আহমেদ তপাদার »

মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাবে সারা বিশ্ব অস্থির। আইএমএফসহ অনেকেরই শঙ্কা আরেক দফা মন্দার কবলে পড়তে যাচ্ছে বিশ্ব। বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতে পরিবর্তনের কারণ হতে পারে করোনা মহামারি। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব হতে পারে সুদূরপ্রসারী ও ব্যাপক। অনেকের ধারণা ছিল করোনা কেবল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এবং চীন হবে এর প্রধান শিকার। কিন্তু করোনার বৈশ্বিক বিস্তার ভাবনায় পরিবর্তন আনতে বাধ্য করছে। ইতিমধ্যেই করোনার রাজনৈতিক প্রভাবও পরিলক্ষিত হতে শুরু করেছে। তবে রাজনৈতিক প্রভাব তাৎক্ষণিক হলেও অর্থনৈতিক প্রভাব হবে ধীর ও দীর্ঘস্থায়ী।দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম ও সবচেয়ে জনবহুল দেশ ভারত এখন বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের নতুন হটস্পট।
সিনহুয়ার অভিযোগ, উহানের অচলাবস্থার মূল্যায়নে যুক্তরাষ্ট্র দ্বিমুখী নীতি গ্রহণ করেছে।করোনা ভাইরাসকে ‘উহান ভাইরাস’ কিংবা ‘চীনা ভাইরাস’ ডাকায় মার্কিন রাজনীতিবিদদের কড়া সমালোচনা করেছে চীনের এই সংবাদমাধ্যম। মহামারি এখনো শেষ হয়ে যায়নি এবং সে কারণেই এটি মোকাবিলা থেকে নিজেদের সরিয়ে আনার সময়ও হয়নি। গোড়াতে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়েছিল, চীনের উহান শহরের একটি সামুদ্রিক মাছ ও প্রাণীর বাজার থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। ধারণা করা হয়েছিল, সেখানকার বাজারে বিক্রি হওয়া বাদুড়ের দেহ থেকে ভাইরাসটি প্রথম মানুষের দেহে প্রবেশ করে।
কিন্তু পরে বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের একটি বড় অংশ বিশ্বাস করতে শুরু করেন, উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি নামের একটি গবেষণাগার থেকে এই ভাইরাস দুর্ঘটনাক্রমে ছড়িয়ে পড়ে। দুর্ঘটনাজনিত কারণে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে-এমনটা সন্দেহ করার অনেকগুলো কারণ আছে। যেমন যেখানে প্রথম মানবদেহে এই ভাইরাস ধরা পড়ে তার খুব কাছেই এই ল্যাবরেটরির অবস্থান; প্রথম সংক্রমণের শিকার হওয়া এলাকাটিতে বাদুড়ের উপস্থিতি ব্যাপক; আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানীদের ওই অঞ্চলে চীন সরকারের ঢুকতে না দেওয়া-ইত্যাদি। মার্কিন প্রশাসন প্রথম থেকেই এসব কারণ ভালোভাবে খতিয়ে দেখার কথা বলে এসেছে। তবে সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কোভিড-১৯-এর উৎপত্তিস্থল খুঁজে বের করতে মার্কিন গোয়েন্দাদের তৎপরতাকে আরও বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। যদি শেষ পর্যন্ত ল্যাব থেকে এই ভাইরাস ছড়ানোর ভাষ্য সর্বমহলে প্রতিষ্ঠা পায়, তাহলে তা বিশ্বদরবারে চীনের ভাবমূর্তির ব্যাপক ক্ষতি করবে এবং চীনের অভ্যন্তরে দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্ব মারাত্মক সমস্যার মুখে পড়বে।
এই মহামারি দেখিয়ে দিয়েছে, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চেয়ে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ইস্যু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই বিষয়টি চীন ও যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি অনুধাবন করতে পেরেছে। বলা হচ্ছে, আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় যত মানুষ মারা গেছে বলে জানানো হচ্ছে, আদতে কোভিডে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা তার চেয়ে তিন থেকে চার গুণ বেশি। অনেক দেশ, বিশেষ করে চীন প্রকৃত সংখ্যা সবচেয়ে বেশি গোপন করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। সবচেয়ে আক্ষেপের বিষয় হলো, করোনাজনিত এই মহামারি এখন যতটা না স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বিষয়, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র এই ইস্যুতে যেন মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। বাইডেন করোনা ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল দ্রুত খুঁজে বের করতে মার্কিন গোয়েন্দাদের নির্দেশ দেওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই চীন যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতার বিষয়ে সন্দিগ্ধ হয়ে পড়েছে। এটি দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়াচ্ছে। এ ছাড়া টিকা নিয়েও পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে চীনের সম্পর্ক বিষিয়ে উঠছে।
কোন দেশ কাকে টিকা দেবে না দেবে, সেটি নিয়ে চলছে রাজনীতি ও কূটনীতি। কিন্তু সেটি দিন শেষে সাধারণ মানুষের জন্য প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে।এই অবস্থা থেকে বিশেষ করে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে বেরিয়ে আসতে হবে। না হলে এশিয়া ও আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলো তাদের বিরোধের শিকার হবে। কোভিড-১৯-এর মহামারি থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী যেকোনো মহামারি মোকাবিলায় চুক্তি চান বিশ্বনেতারা, যাতে সব দেশ আগে থেকে প্রস্তুত থাকতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে ২৩টি দেশের নেতারা গতকাল মঙ্গলবার একটি আন্তর্জাতিক চুক্তির বিষয়ে সম্মতি দিয়েছেন। বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে। করোনাজনিত মহামারির জন্য প্রস্তুত ছিল না বিশ্ব। তাই করোনা যখন দ্রুত ছড়াতে শুরু করল, তখন সব দেশকেই কমেবেশি দিশেহারা মনে হয়েছে। সরকারের যেমন প্রস্তুতি ছিল না, মানুষের ভাবতেও পারেনি এমন পরিস্থিতি আসতে পারে। ফলে, প্রায় প্রতিটি দেশ মহামারি সামলাতে গিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতি যাতে ভবিষ্যতে আর না হয়, তার জন্য প্রস্তুত থাকতে চাইছেন অনেক রাষ্ট্রপ্রধান।
এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ২৩টি দেশের নেতা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) চাইছে, এই প্রস্তুতির জন্য একটি নতুন আন্তর্জাতিক চুক্তি হোক। বিশ্বের প্রধান সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রো, দক্ষিণ কোরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপ্রধানেরা সই করেছেন। সেখানেই এই চুক্তির কথা বলা হয়েছে। আমরা মনে করি, মহামারি নিয়ে প্রস্তুত থাকতে এবং তা মোকাবিলা করতে একটি নতুন আন্তর্জাতিক চুক্তির জন্য দেশগুলোর কাজ করা উচিত। সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়ে যদি মহামারি নিয়ে প্রস্তুতি থাকে, তাহলে তা অনেক ভালোভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। এ ধরনের চুক্তির ধারণা প্রথমে দেন ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মিশেল। তিনি গত নভেম্বরে জি২০ বৈঠকে এই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেখানে মহামারিতে টিকা, ওষুধ ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার সর্বজনীন ও সমান অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যের কথা বলেছিলেন তিনি।
নভেল করোনাভাইরাস বুঝিয়ে দিয়েছে যে, মহামারির মোকাবিলা করতে গেলে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা খুবই জরুরি। করোনার তোপে বিশ্বের অর্থনীতি ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। করোনা মোকাবিলায় নানা ধরণের প্রশ্ন উঠছে। তাই, আন্তর্জাতিক চুক্তি দরকার বলে মনে করছেন অনেক বিশ্বনেতাই। চুক্তি হলে টিকা, ওষুধ এবং রোগ চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে দেশগুলো সহযোগিতা করবে। সবাই সমান সুযোগ পাবে। ভবিষ্যতে মহামারি বা চিকিৎসা ক্ষেত্রে জরুরি পরিস্থিতি আসবে, সেই বিপদকে কোনো একক সরকার বা কয়েকটি সংস্থা মিলে মোকাবিলা করতে পারবে না। তবে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন ও জাপানের রাষ্ট্রনেতাদের সই এই নিবন্ধে নেই। আন্তর্জাতিক কোনো চুক্তি তখনই সফল হতে পারে, যখন তা বাস্তবায়নের পথে কোনো রাজনৈতিক বিরোধ না আসে।করোনার মহামারির সময় দেখা গেছে, বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধান ও নেতারা একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন।
কিন্তু ধনী দেশগুলো বিপুল পরিমাণ ভ্যাকসিন কিনে নিয়েছে। ফলে গরিব দেশগুলো ভ্যাকসিন পাচ্ছে না। অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনার টিকা নিয়ে ইইউ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে বিরোধ প্রকাশ্যে এসেছে। তবে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত নিবন্ধে ইইউ ও যুক্তরাজ্যের সরকার প্রধানেরা সই করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, ‘কোভিড-১৯ আমাদের দুর্বলতা ও বিভাজনের সুবিধা পেয়েছে। আমরা এই মহামারি রুখতে এক হয়ে শান্তিপূর্ণ সহযোগিতা করতে পারিনি।এদিকে গতকাল মঙ্গলবার ভবিষ্যতে মহামারি মোকাবিলায় প্রস্তাবিত চুক্তিতে সম্মতি দেন ২৩ দেশের নেতারা। দেশগুলো হলো- জার্মানি,, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, নরওয়ে, গ্রিস, ফিজি, পর্তুগাল, রোমানিয়া, রুয়ান্ডা, কেনিয়া,দক্ষিণ কোরিয়া, চিলি, কোস্টারিকা, আলবেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো, তিউনিসিয়া, সেনেগাল, সার্বিয়া ও ইউক্রেন। চুক্তি-সংক্রান্ত চিঠিতে এখনও স্বাক্ষর করেনি যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। তবে, দেশ দুটির নেতারা চুক্তিবিষয়ক প্রস্তাবে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন বলে জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেড্রোস আধানম গ্যাব্রিয়েসুস।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম গেব্রিয়াসুস বলেছেন, মহামারির বিরুদ্ধে প্রস্তুতি আরও দৃঢ় করতে হবে। এ জন্য একটি আন্তর্জাতিক চুক্তির বিষয়ে এ বছরই আলোচনা শুরু করার আহ্বান জানান তিনি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা প্রধান বলেন, বর্তমানে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থাকে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে ‘গুরুতর চ্যালেঞ্জ’ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এ ধরনের সংকট মোকাবিলায় নমনীয় এবং টেকসই তহবিল প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক মহামারি চুক্তির বিষয়ে এখনই আলোচনা শুরু করার প্রয়োজন আছে কি-না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আগামী ২৯ নভেম্বর ডব্লিউএইচওর ১৯৪ সদস্য দেশের মন্ত্রীরা বৈঠকে বসবেন বলেও এ দিন সিদ্ধান্ত হয়। গত এক সপ্তাহ ধরে মন্ত্রিপরিষদের সম্মেলন চলছে। এ দিন স্বাস্থ্যমন্ত্রীরা নতুন নতুন ভাইরাস দমনে বিভিন্ন দেশ এবং ডব্লিউএইচও উভয়ের সক্ষমতা বাড়াতে স্বাধীন গবেষকদের দ্বারা আরও বেশি উচ্চাকাক্সক্ষী গবেষণার প্রয়োজনের বিষয়ে একমত হন।
মি: তেদ্রোস বলেন, আমার বিশ্বাস এই একটি সুপারিশ ডব্লিউএইচও এবং বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা উভয়কে আরও বেশি শক্তিশালী করতে সবচেয়ে বেশি কাজ করবে। সেই সুপারিশ হলো, মহামারি মোকাবিলার প্রস্তুতি এবং ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি। এটা এমন একটি পরিকল্পনা, যেটা নিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়ার সময় এসে গেছে। মোটকথা, উদারপন্থী ও রক্ষণশীল উভয় দলই করোনার মহামারিকে ব্যবহার করে নিজেদের অবস্থান সংহত করতে চেষ্টা করবে। এতে আন্তর্জাতিকতাবাদের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের সংঘাত তৈরি হবে। তবে নতুন ব্যবস্থার সূচনা করবে না। পরিস্থিতিকে উল্টেও দেবে না। হার্ভার্ডের রাজনৈতিক অর্থনীতির অধ্যাপক ড্যানি রড্রিক মনে করেন, নয়া উদারতাবাদ, বিশ্বায়নের ধারণা দিন দিন আকর্ষণ হারাবে। লোকরঞ্জনবাদী কর্তৃত্ববাদী শাসকদের অবস্থান আরও পাকাপোক্ত হবে। বিশ্বায়নের নীতিকে জাতীয়তাবাদী ধারণা প্রতিস্থাপিত করবে। রাষ্ট্রের ভেতরে ধনিক শ্রেণি, নব্য ফ্যাসিবাদ এবং বিশ্বায়নবাদী উদারপন্থীদের মধ্যে লড়াই আরও প্রকট হবে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট