কবিতার রাজনীতি ও রাজনৈতিক কবিতা

আরিফুল হাসান »

ভুয়া ডাক্তারের হাতে পড়লে যেমন রোগীর প্রাণ সংশয়ের আশংকা থাকে, তেমনি ভুয়াকবির হাতে নন্দনতত্ত্ব মারা যেতে পারে। কবিতার যে-শিল্পসৌকর্য তা যতটা না আঙ্গিকের, তারও চেয়ে বেশি হৃদয়ঘটিত। তাই কবিতায় কবির হৃদয়গত সত্যের উদগীরণ হবে, এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। লেখক তার মৌলিক সত্তায় যে দর্শন ধারণ করেন, তার প্রতিফলিত চিত্র তিনি তার সৃষ্টিতে রাখতে সক্ষম হন। মনে কলুষ রেখে বাইরে ঝকঝকে জীবনযাপন করলেও সাহিত্যের বেলায় তা বেরিয়ে পড়ে। এখানে ছদ্মবেশের কোনো স্থান নেই, নেই ছলনার কোনো আশ্রয়। সুতরাং কবির সেই পক্ষই অবলম্বন করা উচিত যা তিনি কবিতায় বিবৃত করেছেন। অর্থাৎ কবিতার শ্রমিক না হয়ে নিজেই এক আশ্চর্য কবিতা হয়ে যাওয়াই কবিজীবনের সার্থকতা। অন্যথায় দ্বিমুখী ব্যথা একদিকে যেমন লেখককে কুরে-কুরে খাবে, তেমনি সমাজেও ছড়াবে বিষবাষ্প। আর এই বিষবাষ্প থেকে বাঁচার জন্য পাঠক দিন-দিন সাহিত্যবিমুখ হয়ে গেলেও কবিরা পাঠককে দোষ দিতে পারবেন না। কারণ এ অপপদ্ধতি তাদেরই স্বনির্মিত। আর আপন নির্মিত খাঁচায় যদি আপনার চেয়ে আপন কোনো জন গুমরে মরে, তার দায়ভার লেখককুলকেই তো নিতে হবে!

বলছিলাম কবিতার রাজনীতি ও রাজনৈতিক কবিতা নিয়ে। আমাদের সমাজে এখন লেখক এমন একটি শব্দ যা সমাজের উঁচু থেকে নিচু, প্রান্তিক থেকে নগরকেন্দ্রিক প্রায় নাগরিকেরাই গ্রহণ করতে চায়। ফলে ‘কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা বেশি’ এ রকম ক্লিশে বাক্যগুলো ছড়িয়ে যায় সাংস্কৃতিক পরিম-লে। আমার কথা হচ্ছে, কবির সংখ্যা বেশি হলে সমাজের অপকার নয়, বরঞ্চ কবিতার মতো নিটোল নমিত জীবনের সংখ্যা যতো বৃদ্ধি পাবে, সমাজ ততটা কুলীন, মার্জিত হবে। কিন্তু ঘটনা দেখা যাচ্ছে ওল্টো। কবিতার নাম করে কবিতারাজ্যে প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তার কিংবা আধিপত্যবাদের চাষাবাদ যখন শুরু হয়ে যায় তখন বুঝতে হবে একটি সমাজের একেবারে গোড়ার দিকে পচন ধরেছে। এবং এই পচন দ্রুত নিরাময় করা না হলে সমাজের আর অবশিষ্ট পত্রপল্লব বলে কিছু থাকে না, এ কথা বলাও বাহুল্য। কেনো একটি সমাজের গোড়ার দিকের পচনের সাথে কবিতার নষ্টামি উপমেয়, তা সাধারণ চোখে বোঝা সম্ভব নয়। মনে হতে পারে, বহু আলোকবর্ষ দূরে থেকে কবিতা যে সুরের-সৌন্দর্যের কথা বলে তা এমন কি প্রয়োজনীয় সমাজ বিনির্মাণে? হ্যাঁ, প্রয়োজন আছে। মানুষের সুরের যে ধর্ম, তা বহু আগে থেকেই কবিতার পংক্তিতে-পংক্তিতে ধরা হয়ে আছে। সুতরাং মানবমনের যে গীতল অংশটি, হ্যাঁ, যে অংশ মানবিকÑ সেই মানবিক অংশের অবকাঠামো নির্মাণ করে কবিতা। একটি কবিতা হয়তো অনেক সময় পাঠক যথাযথ আক্ষরিক অনুধাবন করতে সক্ষম হয় না, কিন্তু এর ধ্বনি-দ্যোতনা থেকে যায় তার ভেতর থেকে ভেতরে। আর সে দ্যোতনাই চলার ছন্দ ঠিক করে দেয়। ফলে যে ধ্বনি-দ্যোতনা পাঠকমনে ঠাঁই করে নেয়, তারই বহির্প্রকাশ সে যাপিত জীবনে করে থাকে, এর ব্যত্যয় করার সুযোগ নেই।

মানুষের মন বলে একটি অলীক অথচ শক্তিশালী ব্যাপার আছে। এই মন নিয়ে কত কিছু হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীতে। অতীতেও মনের মতো মন খুঁজতে কত রাজ্য ধ্বংস হয়েছে, কতো রাজ্যপাট লোপাট হয়েছে, ইতিহাস তার সাক্ষী আছে। তাহলে দেখা গেল, এই মন ব্যাপারটা কখনো-কখনো সাম্রাজ্যের চেয়েও দামি হয়ে ধরা দিয়েছে যাপনের কালচিত্রে। তাহলে এই মনের নিয়ন্তা কে বা কারা?

মানুষ তার মনের ব্যাপারে নিজের নিয়ন্ত্রণ যে সবসময় রাখতে পেরেছে, তার কোনো হদিস নেই। নানা কারণে এই মনঘোড়া লাগাম ছিঁড়েছে, নিজেকে করেছে নিজস্বতার অবাধ্য। তাহলে এই অবাধ্য মনের নিয়ন্তা কে? আর কার ইশারায়বা এই মনের রদবদল ঘটে? এ সমস্ত মনোবিজ্ঞানের কথাবার্তায়ও একজন লেখক নিজের অস্তিত্বের অনুভব অস্বীকার করেন না। কারণ তার কাজও মূলত ওই মানসভূমিতেই। মানুষের অনুভূতির দরজাগুলো খুলে দেয়াই লেখকের কাজ। ফলে দেখা যায় যে, একজন লেখক মানুষের মনে বসে কাজ করেন। তার যে সুর, তার যে ধ্বনি তা পাঠকের অবচেতনায় একটি স্থায়ী ভিত গড়ে তুলতে সক্ষম হয় অগোচরে। ফলে একজন লেখক সরাসরি পাঠকের মনের ভেতর পৌঁছে যান। আর সেখানে, সেই নিরিবিলি আবাসস্থলে তার নন্দনকানন ফুটিয়ে তুলেন। এটি অনেকটা এ রকম যে বাতাসের ভেতর থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড ও অক্সিজেনকে আলাদা করে মানুষকে সুস্থ নিশ্বাস নেবার পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়া। যেমনটি দেখা যায় যে, একজন হার্মাদ ও একজন চিকিৎসকের ছুরি চালানোর তফাতটার মধ্যে। বলা হয়ে থাকে যে, দুজনই তো ছুরি চালায়। তাহলে একটি পাশবিক আর অপরটি মানবিক হয় কীভাবে? এখানেই লেখকের তথা সাহিত্যিকের সারবত্তা। লেখক যখন লেখেন তখন তার কালিতে যে মানবিকবোধের স্ফুরণ ঘটে তা সাহিত্য, পাঠের মাধ্যমে পাঠকের ভেতর ক্রিয়া করে। আর অন্যদিকে হার্মাদÑ যার ভেতর সাহিত্যের পাঠরস কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি যা তাকে মানুষ থেকে পশুতে রূপান্তরিত করে আর অস্ত্রপরিচালনায় হয়ে ওঠে মানবতাবিধ্বংসী।

একজন লেখক সচেতনভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ কামনা করে থাকেন। সমাজ, রাষ্ট্র তথা বিশ্বসৃষ্টির কল্যাণ সাধনাই লেখকের মৌলিক উপাসনা। এছাড়া লেখক সভ্যতার ভেতর আর কি অবদান রাখতে পারে নিজের কর্ম দ্বারা? তাই লেখককে লিখতে হয় সমস্ত অসুন্দরের বিরুদ্ধে, লেখককে লিখতে হয় সমস্ত অনিয়মের বিরুদ্ধে। এই অনিয়ম-অসুন্দরের বিকল্পরূপে সুস্থ ও সৌন্দর্যম-িত জীবনের নেশা মানবমনে প্রবেশ করিয়ে দেয়াই লেখকের মূল কাজ। ফলে সচেতনভাবে একজন লেখক কখনোই রাজনীতিবিমুখ হতে পারেন না। তাকে তার আদর্শের জায়গা থেকে লড়ে যেতে হয় সময় ও শাসনের বিরুদ্ধে। এর জন্য অতীতেও অনেক বিশ্বমানের কবিকে কারাবাস বা প্রাণদান করতে হয়েছে। ক্ষমতার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করাই লেখকের দুর্দমনীয় সংকল্পের বহির্প্রকাশ। কিন্তু হতাশ হয়ে দেখতে হয় যে, আমাদের সমাজে তথা বর্তমান পৃথিবীতে রাজনীতি ও কবিতাÑ দুটোর সংজ্ঞাই উল্টে গেছে যেন।

কবিদের রাজনৈতিক কবিতা লেখার মধ্যে দোষের কিছু নেই, বরং কখনো-কখনো তা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক কবিতা বলতে আমরা বুঝি যে কবিতার বিষয়বস্তু রাজনীতি, রাজনৈতিক চিন্তা, ধারণা, মতবাদ, সংঘাত, প্রতিবাদ, বিদ্রোহ ইত্যাদি। কিন্তু অধুনাকালে এ সংজ্ঞা পাল্টে গিয়ে নতুন একটি পরিভাষা যুক্ত হয়েছে আর তা হলো কবিতার রাজনীতি।

কবিতার রাজনীতিই মূলত বর্তমান বিশ্বের কবিতাকে বদলে দিচ্ছে। ফলে পাঠক হারাচ্ছে কবিতা থেকে সেই অমৃতোপম মধু আর কবি হারাচ্ছেন তার যোগ্য মর্যাদা, সম্মান। ফলে কবিকে এখন রাজনীতিমুখিন হয়ে থাকতে হচ্ছে। একজন কবির কাঠামো ও কার্যকারণ যেন নির্ধারণ করে দিচ্ছে রাষ্ট্রকিংবা কোনো চাপপ্রয়োগকারী সংস্থা। অথচ কবিদের চাপ প্রয়োগের কথা ছিল রাষ্ট্রকাঠামোতে, যেন এর ভারসাম্য মানবিক হয় ও জনদরদি হয়। কিন্তু কতিপয় কবিনামধারী ও বিকৃত প্রতিভা তাদের মূল্যমানের অধিক পাবার লোভে নিজেদের ‘উন্নত শির’ বিক্রি করে দেয় অবলীলায়। আর এর থেকেই তৈরি হয় সংকট। এ সংকট আপাত অর্থে তেমন কোনো বড় ধরনের সংকট মনে না হলেও এক সময় তা মহিরুহরূপ ধারণ করে। কারণ পূর্বেই বলেছি যে, কবিতা বা সাংস্কৃতিক ইঙ্গিত পাঠক তথা মানবমনে এক সূক্ষ্ম অথচ শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করে। এটি একেবারে একদিন-দুদিন বা এক দশক-দু’দশকের ব্যাপার নয়। কখনো-কখনো শত শত বছর সময় লেগে যায় সেই মনোলৌকিক ক্রিয়াদি সমাপনে। এই যে শত-সহস্র জীবনের পথে মানুষ তার মৌলিক চিন্তার মধ্যে একটি নান্দনিক স্তর স্থাপন করেছে, কবিতার রাজনীতির কারণে সে স্তর ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে থাকে। এটি হতে পারে ওজোনস্তর ভাঙার চেয়েও ধীরগতিতে, কিংবা হিমালয়ের বরফগলে শেষ হবার মতো সময় নিয়ে। কিন্তু যে বীজটি রোপিত হয়ে গেছে তা একদিন পত্রপল্লবে জঙ্গল করে তুলবে, এ কথা নিশ্চিত না বলে উপায় নেই।

রাজনৈতিক কবিতায় ফুটে ওঠে একটি এলাকা, দেশ অথবা বিশ্বের প্রকৃত রাজনৈতিক পরিস্থিতি, পর্যবেক্ষণ, আচরণ, ক্ষমতা ইত্যাদি। এর মাধ্যমে জনগণ যেমন তাদের অধিকারের ব্যাপারে আরও বেশি সচেতন হতে পারে তেমনি শাসকগোষ্ঠীও নিজেদের শুধরে নেবার অবকাশ পায়। এখানে কবি একই সাথে জনতা ও নেতৃত্বের প্রতিনিধিত্ব করেন। বলা যায় যে, কবি সকল সময় জনতারই প্রতিনিধিত্ব করেন। তার কাজ করা শাসন নয়, তার কাজ আনন্দযাপন। আর এই আনন্দে ব্যাঘাতের কারণগুলো তিনি তার লেখার মাধ্যমে স্পষ্ট করবেন, এটাই জনতার দাবি থেকে থাকে। কিন্তু লেখক এই জনদাবিকে অগ্রাহ্য করে যখন তার অন্তরাত্মার অভিশাপ নিয়ে শাসককুলের সাথে আপোস করে তখন আর তাকে লেখক বলে মেনে নেয়া যায় না। নিজের অজান্তেই তিনি তখন হয়ে ওঠেন দলের কিংবা ব্যক্তিবিশেষের কথক। এই কথক-অপরাজ্যে তাই এখন কাজ ও কোকিল যেমন সমাবর্তনশীল, তেমনি কাক ও কবিও হয়ে ওঠেন তাচ্ছিল্যের উপমেয়।

আমার বক্তব্য ছিল সেখানে যে, লেখক তার মৌলিক সত্তাকে ধারণ করে সমাজের অসঙ্গতিগুলো চিহ্নিত করুন আর তার যা দায়িত্ব তা তিনি নিষ্ঠার সাথে পালন করুন। কিন্তু না, লেখক হয়ে গেছে বর্তমানে একেবারে বাজারের পণ্যের মতো সহজলভ্য আর মোড়লিপনার প্রেত-ভূত।

আরেক শ্রেণির রাজনীতি এই কবিতার অঙ্গনে প্রত্যক্ষ করা যায় যে শুধু রাজনীতি বলতে রাষ্ট্রকাঠামোর পরিচালন নীতিই নয়, কবিদের স্থান, সম্মান আর প্রাপ্তি-স্বীকৃতির এই অপরাজনীতি। এখানে কবিদের দেখা যায় বিভিন্ন সংগঠনে ভাগ হয়ে এ-কবি সে-কবির বিরুদ্ধে, এ লেখক সে লেখকের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে চলছে। এও একটি অবস্থার পতন। সামগ্রিকভাবে যা সাহিত্য তা সকল লেখকেরই সাহিত্য হওয়া উচিত। কিন্তু না। সেখানে আমার ভালো লাগা, তোমার ভালো লাগার মতো ব্যাপারগুলোও চলে এসেছে খুব বিশ্রীভাবে। ফলে কে যে প্রকৃত লেখক আর কে যে লেখক নয়, তা নিরূপণ করা পাঠকের জন্য হয়ে পড়ছে দুঃসাধ্য। কবিদের মধ্যে এ ঘৃণ্য দলবাজি আমাদের সাহিত্যের সর্বনাশ তো করছেই উপরন্তু ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে মনোকাঠামোর মানবিক নক্ষত্রহরফ। আর এর ফলে রাজনৈতিক কবিতা আর কবিতার রাজনীতি নিয়ে দেখা দিয়েছে এক গভীর পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ। না মানবিক, না উদার রাজনৈতিক আমাদের কবিতা এখন জনগণের কথা তো বলেই না, ওল্টো কী যে বলে সে বিষয়ে স্বয়ং কবিই হয়তো সন্দেহে ভোগেন!

এই ভোগবাদী কবিতাচর্চা থেকে আমাদের কাব্যজগত মুক্ত হোক, ফিরে আসুক আমাদের সাহিত্যের সুদিন।