তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর…

সুপ্রিয় দেবরায় »

দেখতে পায় আমাদের বৌমা নেহা এক মনোরম সকালে ঘরের দরজায় ঝোলানো পর্দার ফাঁক দিয়ে, অজস্র ছোট্ট  ছোট্ট পাখি কুটুস-কুটুস করে খুঁটে খাচ্ছে শস্যের দানা। বারান্দায় পাটাতনের ওপর রাখা পাখির খাবার রাখার পাত্র থেকে। আবার মাঝে-মাঝে এসে খেয়ে যাচ্ছে জল পাশে রাখা এক বাটির থেকে। কাল রাত্রেই এসেছে  ছেলে আর বৌমা বেঙ্গালুরু থেকে।

সকালে জলখাবার খাওয়ার সময় নেহার প্রশ্ন, ‘বাবা, এখানে এতো ছোট্ট  ছোট্ট পাখি দেখা যায়- কিন্তু আমরা  তো একটাও দেখতে পাই না বেঙ্গালুুতে।’

‘কি করে দেখবে মা। তোমরা তো থাকো পনেরো তলার টঙে। আশপাশ ঘিরে আছে লম্বা লম্বা ৩০/ ৪০ তলার টাওয়ার। কোনো বড় ঝাঁকড়া-ঝাঁকড়া গাছ নেই আশে পাশে, নেই কোনো জলাশয়। তোমাদের বিল্ডিং কমপ্লেক্সে আছে কিছু ছোট-ছোট ফুলের গাছ আর সুন্দর করে ছাঁটা সবুজ ঘাসের মখমলে পাপোশ। হয়তো  দেখতে পাবে রঙবেরঙের প্রজাপতি, ফড়িং। আর আমাদের বাড়ির আশেপাশে দেখো কত বৃক্ষÑ আম, কাঁঠাল, খেজুর, নারকেল, নিম, আরও কত। গাছে পাখিগুলির খড়কুটো দিয়ে বানানো বাসা থেকে এরা সব সকালে পাখা মেলে উড়ে যায় মাইলের পর মাইল দূরের শস্যখেতে। সারাদিন খেলে নেচে বেড়ায় সোনালি ধানের আগায়, ফসলের  শীষে। সন্ধ্যার প্রাকমুহূর্তে  দেখতে পাবে দলে-দলে ফিরছে সব তাদের পাখা মেলে তাদের নীড়ে। আজ দেখাবো তোমাকে, কী অপূর্ব দৃশ্য! বারান্দায় যে পাখিগুলো দেখলেÑ বেশির ভাগই মুনিয়া। মাঝে-মাঝে চড়ুই, টুনটুনি আসে তবে খুব কম। আমরা  ছোটবেলায় যত চড়ুইপাখি দেখতে পেতাম, এখন আর পাওয়া যায় না দেখতে। কেন জানো? গ্রামবাংলা ছেড়ে দাও, ষাট-সত্তর বছর আগেও শহরতলিতে আজকের মতো ফ্ল্যাট-কালচার ছিল না। আগেকার বাড়িগুলোতে থাকত নানা ধরনের ফাঁক-ফোকর, ঘুলঘুলি, কড়িবড়গা, চিলেকোঠা, দেয়ালের গায়ে কাঠের তাক। সেই জায়গাগুলোই চড়ুই পাখিরা বেছে নিত বাসা করার জন্য। সেখানে ডিম পাড়ত, ছানারা বড় হতো। একটু বড় হলেই ছড়িয়ে পড়ত চারদিকে। মনে আছে আমার  ছোটবেলায় যখন কোনো ছোট্ট পাখি জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়তো মা সাথে সাথে বলতেনÑ পাখা বন্ধ কর, না হলে ছানাটা যে মরে যাবে।

গাছের এবং বড় বড় অট্টালিকার অভাবের জন্য, শুধু বাসা বানানোর জায়গার অভাব নয়, খাবারেও টান পড়ে। যেখানে আমাদের হার্ট ধুকপুক করে ষাট থেকে একশোবার, সেখানে পাখিদের তিনশো থেকে ছয়শোবার। তার জন্য ওদের প্রচুর  পোটিনের দরকার হয়, আর তা আসে পোকামাকড় থেকে। যার জন্য পাখির ছানাদের প্রচুর প্রোটিনের দরকার হয় এবং সেটা পায় ওরা পোকামাকড় থেকে। আর গাছ যেখানে কমে আসছে, পোকামাকড় আসবে কোথা থেকে! প্রোটিনের অভাবে চারটে ছানা জন্মালেও খুব বেশি হলে আলোর মুখ দেখতে পায় একটি কি দুটি। বিভিন্ন দেশের গণনা অনুযায়ী পাখির সংখ্যা প্রায় ষাট-সত্তর শতাংশ কমে  গেছে। কোনো উদ্যোগ না নিলে হয়তো ভবিষ্যতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এই পাখিরা।’

একটু দম নিয়ে বলি, ‘হাতটা ধুয়ে আসি, তোমরাও ধুয়ে এসোÑ তারপর তোমাদের আজ শোনাই  এক হৃদয়বিদারক সত্যিকাহিনি। শুনলে ভিতর থেকে অন্তরটা  কেঁদে উঠবে।’

হাত-মুখ সবাই ধুয়ে আসার পর বলতে থাকি Ñ ‘একটি সত্যিকাহিনি বলি তোমাদের। আমিও জেনেছি কিছুদিন আগে। দেশে খাদ্যশস্যে কেন টান পড়ছে সমীক্ষা করতে গিয়ে চীনদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যে রিপোর্ট আসে সরকারের হাতে, তার ওপর ভিত্তি করে ১৯৫৮ সালে চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুং ঘোষণা করেন মশা, মাছি, ইঁদুরের সাথে সমস্ত চড়াইপাখিকে মেরে  ফেলার। কারণ প্রত্যেকটি চড়াই পাখি বছরে ৪ কিলো শস্য খেয়ে নষ্ট করে এবং পুরো চীনদেশে ৬৫ কোটির ওপর চড়াই পাখি আছে। প্রায় ৯৬ বর্গকিলোমিটারের এই দেশটিতে কোটি-কোটি চড়াইপাখি মারার জন্য নানারকম পন্থা অবলম্বন করা হয়। করা হয় এক অঘোষিত লড়াই দেশজুড়ে চড়াই পাখি মারার জন্য। সমস্ত দেশের জনগণ রাস্তায় নেমে থালা-বাটি জোরে-জোরে বাজাতে লাগলেন হাতা, খুন্তি দিয়ে। ড্রাম বাজিয়ে। শুধু কৃষক-শ্রমিক নয়Ñ  রাস্তায় নেমে পড়েছে স্কুল-কলেজপড়ুয়ারা, অফিস কর্মচারীরা, এমনকি পিপল’স লিবারেশন আর্মি। সবাই নেমে পড়েছে চড়াইনিধনযজ্ঞে। বিকট শব্দে পাখিগুলো দিগভ্রষ্ট হয়ে পালাতে লাগে। কিন্তু যাবে কোথায়Ñ যেখানেই যায়  সেখানেই এই বিকট আওয়াজ। বুক ধড়ফড় করতে করতেই মারা যায় প্রচুর চড়াইপাখি। কেউ ধরে এবং মারে জাল ফেলে, গুলতি ছুড়ে, খেলনা বন্দুকের গুলি দিয়ে, খাবারে বিষ মিশিয়ে- একটাই উদ্দেশ্যÑ চড়াইপাখি মারতে হবে। ১৯৫৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর চীনের দৈনিক পত্রিকা থেকে জানা যায়, খতম হয়েছে প্রায় ৬৫ কোটি চড়াই পাখি। বেলচা ব্যবহার করতে হয়েছিল এই মৃত চড়াই পাখিদের সরানোর জন্য রাস্তা, বাড়ির উঠোন থেকে। এটা কী একটা যুদ্ধের চেয়ে কম কিছু ছিলÑ যেখানে শয়ে-শয়ে, লাখে-লাখে হত্যা করা হয় নিরীহ মানুষকে! পরের বছর অবশ্য চীনকে গুনতে হয়েছিল মাশুল এই নির্মম সিদ্ধান্তের জন্য। চড়াইপাখিরা শস্যদানার সাথে খেত নানারকম পোকামাকড়। চড়াইপাখির অনুপস্থিতিতে, ধেয়ে আসতে থাকে লক্ষ লক্ষ পোকামাকড় ও পঙ্গপাল আর খেতের সমস্ত শস্য খেয়ে সাবাড় করে দেয়। এত শস্য খেয়ে তারা শেষ করে দিয়েছিল যে খাদ্যশস্য মজুতের ন্যূনতম লক্ষমাত্রায়ও পৌঁছনো গেল না এবং খাদ্যসংকটের মুখে পড়ল কোটি-কোটি মানুষ। শুরু হলো দুর্ভিক্ষ ‘দ্য গ্রেট চাইনিস ফ্যামিন’ নামে পরিচিত এই দুর্ভিক্ষ। নথিপত্র অনুযায়ী প্রায় দেড় থেকে সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ মারা যান। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছিল আনহুই, ছঙকিঙ, সিচুয়ান, হুনান স্থানগুলো। পরবর্তী চেয়ারম্যান লিউ শাওকিন, এর জন্য চড়াই মারার সিদ্ধান্তকে ৭০ শতাংশ দায়ী করেন। এবং এর সাথে দায়ী করেন নিম্নমানের কৃষিকৌশল, কোটি-কোটি কৃষককে শস্যচাষ পরিত্যাগ করে কলকারখানায় নিয়োগ করাকে।

চড়াইনিধন করার সিদ্ধান্ত যে কত বড় ভুল ছিল সেটা বুঝতে পেরে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কয়েক লক্ষ চড়াইপাখি আমদানি করতে বাধ্য হয় চীন সরকার।  ঘোষণা করা হয়, এবার থেকে সবাইকে চড়াইপাখিদের রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। চীনের ইতিহাসে এই চড়াইনিধন একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়।

ছেলে, বৌমা, স্ত্রীর সবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখিÑ  তাদের মুখ সব থমথমে। জানি স্বাভাবিক হতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে। যেমন আমার হয়েছিল ঘটনাটি জানার পরে। এটা বোধ হয় কোনো সভ্যসমাজের, মানুষের ধারণার অতীত। এ রকম নির্মম একটি সিদ্ধান্তের- একটি নিরীহ প্রজাতির সবংশে বিলুপ্ত করার।

আমরা সবাই জানি কবিরু রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ থেকে শুরু করে জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব গুহ এবং অন্যান্য সমস্ত কবি-লেখকরা ভাবতেন, প্রকৃতি এবং পাখিই তাঁদের সবচেয়ে বড় সম্পদ। ওনাদের সব কাব্য, সাহিত্য  পাখিময় এক পাখিরালয়। বিভূতিভূষণের মনে হতÑ  এই প্রকৃতির সঙ্গে, গাছপালার সঙ্গে, পাখির গানের সঙ্গে মানুষের যোগ আছে। ওনি বলেছিলেন, চৈত্র দুপুরের অলস নিমফুলের গন্ধে, ঝরাপাতার শুকনো সুবাসে, পাখির বেলা যাওয়া উদাস গানে অনন্তের অনুভূতি জাগে। ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থে জীবনানন্দ লেখেন, ‘অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে দেখি ছাতার মতন বড় পাতাটির নিচে বসে আছে ভোরের দয়েল পাখি।’ বুদ্ধদেব গুহর ‘কোজাগর’ উপন্যাসে সায়ন পাখি বিশারদ না হয়েও এবং পাখিজগতের তথ্য জেনে নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ না থাকা সত্ত্বেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাখি  দেখে সময় কাটিয়ে দেয়। কবিগুরু ওনার ‘দুঃসময়’ কবিতায় লিখেছেন, ‘তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর, / এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।’ আমরা যে সবাই সায়নের মতন পাখিদের পাখা মেলে আকাশে ওড়া  দেখেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতে চাই।