উড়ালসেতু

দীপক বড়ুয়া »

প্রতিদিনের অভ্যাস সকালবেলায় হাঁটার। আমি ডাইয়াবেটিস রুগী। ডাক্তারের নির্দেশ প্রথম অষুধ হাঁটা। কম হলেও চার-পাঁচ মাইল। হাঁটিÑ একা। সাথে কেউ নেই। ভোর সাড়ে ছটায় বেরেই।
বৃষ্টি হলে হাঁটি না।
আমীন সেন্টার-এর সামনের উড়াল সেতুতে হাঁটি। নিরাপদ জায়গা।
এই উড়াল সেতু মানুষের অনেক উপকারে এসেছে। আগে প্রচণ্ড জ্যামে হা-হুতাশ করতো। এখন একটু স্বস্তিতে মানুষ চলাফেরা করে। আবার কেউ-কেউ সেতুর নিয়ম মানে না। ভারি ট্রাক, বড়সড় মালবাহী, কাভার্ডভ্যান গাড়ি চলাচল করে। তবে এই উড়াল সেতুতে শুধু প্রাইভেটকার, সিএনজি বেবি, স্কুটার চলার কথা। কিন্তু কার কথা কে শোনে? পথে-পথে সিগন্যাল লাইট জ্বলে। লাল, নীল। তোয়াক্কা করে না কেউ। গাড়ি ছুটছে। পথ পার হবার জেব্রা ক্রসিং ছেড়ে মানুষ রাস্তা পার হচ্ছে। মানুষ এক্সিডেন্ট করছে। প্রতিনিয়ত মানুষ মরছে। দোষটা কার?
আমি অচ্যুত দেওয়ানজী।
প্রতিদিন সকালে আমীন সেন্টার-এর সামনে আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভার বা উড়াল সেতুতে ছুটে যাই। ওখান থেকে হাঁটা শুরু।
ভোরের ফিনফিনে হাওয়া। পায়ে কেডস। অনেকেই হাঁটে। কারো সাথে কথা হয় না। সকালে হাঁটা আবার বিপদও। আধুনিক সন্ত্রাসীর ভয়। প্রতিদিন সকালসন্ধ্যা বুদ্ধের সামনে বসে পঞ্চশীল নিই। নিশ্চয়ই কোনো অঘটন হবে না। মনভরা সাহস থাকে।
প্রায় প্রত্যেকের এখন ডাইয়াবেটিস আছে। সব জায়গায় সকালে-বিকেলে মানুষ হাঁটছে ওই রোগটার জন্য। কি রাস্তা, কি পার্ক, কি মাঠ! মেয়েছেলে বলে কথা নেই। সব বয়সীরা সমানতালে ছুটছে। কী আশ্চর্য, প্রতিদিন। নানান বয়সী ছেলেমেয়ে। বুড়ো, আধ বয়সী। বাদ নেই। অনেক মেয়ের সাথে একটি মেয়েও হাঁটে। একা। খুব সম্ভব ডায়াবেটিস আছে। না হলে এমন সকালে একা কোনো মেয়ে হাঁটে। মেয়েটির কি কেউ নেই? সাহসী মেয়েটা বটে। একা-একাই হাঁটে। বয়স তেমন নয়। আঠার, বিশ হবে।
আমি আমীন সেন্টার-এর সামনে উঠে ষোলশহর পর্যন্ত যাই। আবার ফিরে আসি।
সেই মেয়েটিও হাঁটে। আমার কাছাকাছি থাকে। আমাকে অনুসরণ করে, কী জানি, হয়তো আমার সাথে হাঁটতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ভয় পায় না। আমার মতোই ষোলশহর পর্যন্ত যায়, আবার আসে। আমি সামনে, মেয়েটি পিছনে।
একা হাঁটার চেয়ে একজন সঙ্গী তো পেলাম। ভালো লাগে। কথা না হোক, ক্ষতি কি? ভিন্ন একটি মজা তো আছো।
এভাবেই অনেক দিন যায়।
মেয়েটি জানে? আমি যে বিবাহিত। সন্তান আছে।
সেদিন মেয়েটি আগে আসে। দাঁড়িয়ে থাকে। দূরে-অদূরে চোখ রাখে। বিশেষ করে ইস্পাহানি মোড়ে। যেদিক থেকে আমি আসি। তখনই মেয়েটি আমাকে দেখে। কাছাকাছি হতেই হাসে, মৃদু। আমিও হাসি। দুজনের মুখেই হাসি। শব্দহীন।
কিছু মনে করলো কী!
মেয়েটিকে পাশ কাটিয়ে উড়াল সেতুতে পা রাখি। মেয়েটিও পা বাড়ায়।অন্যরকম মজা অনুভূত হলো। আমি আগে-আগে, মেয়েটি পিছু-পিছু। কী আনন্দ। মেয়েটি কথা বলবে মনে হয়, কিন্তু বলে না। আমারও ইচ্ছে হয়, বলি না। দুজনকে লজ্জা শাসন করে।
ফেরার সময়ও তাই।
আমি আগে-আগে। ও পিছুপিছু।
আমি ইস্পাহানি মোড় হয়ে স্টেডিয়ামের দিকে পা বাড়াই। মেয়েটি বাগঘোনায়। আমার মনটা দারুণ খুশি আজ। মেয়েটি হাসলো আমায় দেখে। দেখতে মন্দ নয়। মনের মতোই। উজ্জ্বল শ্যামলা। লম্বা গলা। হাতও লম্বা। সরু আঙুল। লম্বা নখ। মেরুন নখপালিশ। স্ট্রেট চুল, খোলা। চুল খোলা কেন? প্রাতঃভ্রমণে চুল খোলা রাখা আধুনিক নিয়ম বুঝি! নাকি অভ্যাস। পায়ে কেটডস। দারুণ মিষ্টি মেয়ে।
আমাকে কি মেয়েটির পছন্দ হয়েছে। নাকি ভালোবেসেছে আমাকে।
ছি ছি এসব আমি কি ভাবছি? আমি বিবাহিত। মেয়েটা কি সেটা উপলব্ধি করতে পারে।
ধুত্তুরি ছাই!
ও তো আমার সন্তানের মতোই।
সত্যকথা কি, পুরুষ জাতটাই একটা ভিন ্নজিনিস! আশিতেও সুন্দরীদের দেখে। বিয়ে করতে পাগলামি করে। বুড়ো হলে কি? মন তো বুড়ো নয়! কচি টসটসে।
আচ্ছা মেয়েটির নাম কী? সে কি আমার স্বজাতি। একই ধর্মের। যদি না হয়, তখন কি হবে? কি আসে-যায় তাতে! আমি কি বিয়ে করছি মেয়েটাকে?
বাসায় ডোরবেল টিপতেই শ্যামলীনা দরজা খোলে।
আমার মুখে হাসি দেখে অদ্ভুত প্রশ্ন করে
কি ব্যাপার এত খুশি-খুশি লাগছে! কোনো ব্যাপার না তো! আজ অন্যরকম লাগছে কেন তোমাকে। কথা না বাড়িয়ে সোজা শোবার ঘরে যাই। গায়ের ঘামে ভেজা কাপড় ছেড়ে বাথরুমে ঢুকি। বাথরুমের উজ্জ্বল আলোয় আয়নায় নিজেকে দেখি। চুলে পাক ধরেছে। ভুরুতেও পাক। মুখটা ভারি সুন্দর, টানটান। যৌবনের কিছুটা কমতি আছে। তারপরও স্মার্ট মনে হয়। তাই কি মেয়েটির আমাকে পছন্দ, ভালোবাসছে!
আজকাল তেমন কাজ নেই। ছয়তলার বারোটা ফ্ল্যাটের ভাড়া পাই। মাসে বিশ হাজার করে দুই লাখ চল্লিশ হাজার টাকা। বড়-ছোট দুই ছেলে ভালো চাকরি করে। বিয়ের কথা বলি। দুজনের এককথা, আরো শক্ত হই বাবা।
আমার তেমন কাজ নেই। হাঁটা, পত্রিকা পড়া, মাঝেমাঝে বাজার করা। এদিক-সেদিক যাওয়া-আসা। বাজারটা মূলত লীনাই করে। অন্য কারো বাজার শ্যামলীনার পছন্দ নয়।
সকালে ঘুম ভাঙেনি। রাতে কয়েকবার বাথরুমে গেলাম। তরল পায়খানা। শরীরটা দুর্বল। বেরোইনি। কিন্তু মনটা ওই উড়াল সেতুতে। মেয়েটি এসেছে নিশ্চয়ই। আমার অপেক্ষায় আছে। এখন তো সকাল সাড়ে সাতটা। মেয়েটি হাঁটছে? না একা হাঁটবে না। একা হাঁটা নিরাপদ নয়। মেয়েটি জানে। মেয়েটি আমাকে যথেষ্ট বিশ্বাস করে। তাই আমার সাথে হাঁটে।
লীনা বড় গলায় বলে,
-এ্যাই শুনছো?
আমার কানে যায় না লীনার কন্ঠ। আমার মন উড়ালসেতুতে। চোখ সেখানে। মেয়েটিকে খুঁজছে। দেখেছে চোখ। মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে।আজ সত্যিসত্যি হাঁটেনি। আমাকে ছাড়া হাঁটতেই পারে না।
তখনও লীনার কন্ঠ।
কী ভাবছো?
আমার মুখ দেখে বলে,
মন খারাপ? কিছু হয়েছে, কেউ কিছু বলেছে?
না- না কিছুই হয়নি। তুমি যাও তো! একটু একা থাকতে দাও।
আমার বউটা মনের মতো। আমাকে বোঝে। কথার ওপর কথা বলে না। আমি যা চাই, তার একটুও বাইরে চলে না। প্রচণ্ড ভালোবাসে। সংসারী, সামাজিকতায় পটু। সন্তানদের নিজে পড়িয়েছে ছোটবেলায়। দায়িত্ববান সে।
ওই মেয়েটির রঙে রঙ লীনার। শ্যামলা, পাতলা গড়ন। মুখটি ভারি মিষ্টি। আদুরে চেহারা। চটপটে নয়, আবার শান্তও নয়, মাঝামাঝি। শরীরপ্রিয়। শারীরিক সৌন্দর্যের জন্য অনেক কিছু স্পর্শ করে না। প্রতি মাসে পার্লারে যায়। ব্যায়াম করে। শুধু লীনা নয়, আজকাল সব মেয়েরাই ব্যায়াম করে। রূপ নিয়ে ভাবে। নিজেকে সুন্দরী রাখে। বিশেষত স্বামীর মন এবং অন্য পুরুষের মনভরানোর জন্য।
আমার কথায় লীনা চলে যায় নিজের কাজে।
সংসারে কত কাজ। ঘর ঝাড়ু দেয়া, ফার্নিচার মোছা, তরকারি কুটা, রান্না, কাপড় ধোওয়াÑ সব লীনাই করে। কাজের মেয়েও আছে। তবুও সব নিজেই করে।
আমি বিছানায় শুয়ে-শুয়ে ওই মেয়েটির কথা ভাবি। বয়সে ছোট হোক, মেয়েটিকে কেমন ভালো লাগে আমার। এটা কি এই বয়েসী মানুষের দোষ? ধুর, দোষ হবে কেন? ভালোবাসার বয়স আছে বুঝি? ভালোবাসলে বিয়ে করতে হয়! এমনি-এমনি ভালোবাসা যায় না? বন্ধু তো হওয়া যায়। কাল সকালে সত্যকথাটি বলবো আমি।
বিকেল গড়ায়।
সন্ধ্যা হয়। রাত বাড়ে। শেষ হয় না। বিছানায় গড়াগড়ি খাই। লীনা রাগে। একটু শব্দে লীনার ঘুম ভাঙে। প্রশ্ন করে,
কি হচ্ছে? ঘুমুওনি? ঘুমাও।
আমি ঘুমুবার চেষ্টা করি। ঘুম আসেনা। কখন ভোর হবে, প্রতীক্ষায় থাকি।
ভোর হতেই বেরোই। দৌড়ে ছুটি। উড়াল সেতুর কাছাকাছি পৌঁছি। খুঁজি মেয়েটিকে। দূরে-কাছে কোথাও মেয়েটি নেই। মন বললো, হয়তো দেরি হচ্ছে। আমি হাঁটি না। দাঁড়িয়ে থাকি মেয়েটার জন্য। সাতটা বাজে। সাড়ে সাতটা বাজে। এতটা দেরি হবার তো নয়। আসছে না কেন? আমি গতকাল আসিনি, সেই অভিমানে আসলো না? নাকি রাগ করে? শেষপর্যন্ত মেয়েটা আসেনি।
আমার হাঁটা হলো না।
বাসায় ফিরি।
শ্যামলীনার প্রশ্ন
এতো তাড়াতাড়ি এলে যে? হাঁটোনি আজ।
শরীর ভালো নেই, তাই।
লীনা গায়ে হাত দেয়। কপালে হাত রাখে। বলে
জ্বর আসেনি তা!
না-না ওসব কিছু নয়।
তাহলে হলোটা কি?
আমি উত্তর দিতে পারি না। সত্যকথাটি বউকে বলা যাবে না। শোবার ঘরে ছুটে যাই। তারপর বাথরুমে। মুখ-হাত ধুইয়ে প্রার্থনা রুমে যাই। বন্দনা করি। মেয়েটির জন্য মঙ্গল কামনা করি। ততক্ষণে ডাইনিং টেবিলে প্রিয়া সকালের নাস্তা আনে। ডিম, পরাটা, চা। এই পরাটার জন্য লীনা গালমন্দ করে
এই বয়সে তেলের কিছু খাওয়া শরীরের জন্য ভালো নয়। খাবে না।
দাঁতের জন্য চিবুতে পারি না ছেঁকারুটি। আমিও উত্তর দিই।
লীনা চুপ থাকে। কথা বাড়ায় না।
প্রিয়া কাজের মেয়ে। তাকে আমরা কেউ কাজের মেয়ে মনে করি না। ঘরের একজনই ভাবি। নিজের ঘর ভেবে সব করে। পরিবারের কাছের মানুষ সে।
আমার দিন ফুরোয় না। সময় কাটে না। এক-এক ঘণ্টা লম্বা মনে হয়। কখন বিকেল, রাত, সন্ধ্যা হবে শুধু ভাবি। নিয়ম মতো রাত শেষ হয়। পাখি ডাকে।
সকাল হয়। মন আনন্দে ভরে যায়। এখন বেরোবো। উড়ালসেতুতে যাবো। আজ নিশ্চয়ই মেয়েটির সাথে দেখা হবে। কথা হবে। আমি সত্যি-সত্যি কথা বলবো। মেয়েটির নাম কি জিগ্যেস করবো। কোথায় থাকে, কঅ করে, বিবাহিত কিনা, সব জানবো আজ।
তাড়াতাড়ি ছুটে যাই।
না মেয়েটি আজকেও এলো না।
কি হলো মেয়েটির?
আমি পরপর পাঁচ-ছয় দিন আসি। মেয়েটি আসে না। মান এখনও ভাঙেনি? বিয়ে হয়েছে মেয়েটির? নাকি অসুখে মারা গেছে? কোনটি সত্যি?
একমাস, দুই মাস ছয়মাস পার হলো।
আমি প্রতিদিন উড়ালসেতুতে হাঁটতে যাই। মেয়েটিকে দেখার ইচ্ছে করে। মেয়েটি আসবে মন বলে। প্রতীক্ষায় থাকি। মেয়েটি আসে না।
বারবার মেয়েটির সেই নিঃশব্দ হাসিটা চোখে ভাসে। কি দারুণ সেই মিষ্টি হাসি।