চৌরাস্তা

রেবা হাবিব »

অফিস থেকে বাসায় ফিরছে উসামা। রাত প্রায় দশটা। ট্রাফিক সিগন্যালে লালবাতি দেখে সে গাড়ি থামাল। সিগন্যাল সবুজ হয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। হঠাৎই চৌরাস্তায় মোড় থেকে ভেসে এলো বিকট শব্দ। উসামার কান দুটি স্থির। চোর … চোর… চোর… এই পর্যন্তই লোকজনের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। লোকে চোর-ডাকাত বলে চেঁচামেচি করছে আর চারিদিক থেকে পথচারী আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কারো কান্নার শব্দও শোনা গেল। মনে হচ্ছে লোকজন চোরকে আচ্ছামতো ধোলাই দিতে ব্যস্ত। হঠাৎ সিগন্যাল সবুজ হয়ে গেল। সব যানবাহন ছুটতে শুরু করল গন্তব্যের দিকে। উসামাও চৌরাস্তায় মোড়ের চোরের কথা মনে মনে নাড়া দিয়ে এগোতে লাগল। পরের মোড়েও পৌঁছায়নি সে, চোরের কথা আবার তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে কেন? মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করল। একটু ভেবে নিল, আজকাল কারোর ওপর ভরসা নেই। কখন, কে, কোন্ সময়ে কার পকেট পরিষ্কার করতে পারে, কিছুই বলা যায় না। কেউ কারোর পকেট কেটে পরিষ্কার করতে থাকলে তাহলে তাকে শিক্ষা দিতে হবে। চোরেরও শিক্ষা পাওয়া ভালো। যতই মন থেকে উসামা চোর জিনিসটা বের করার চেষ্টা করছে, তার মন আবার সেই একই জিনিসে আটকে যাচ্ছে। বরং মনের গভীরে ঢুকে যাচ্ছে এই বিষয়। কিন্তু এখন তার মনের মধ্যে অন্যকিছু ভাবনা ছুটতে থাকে। বারবার মনের মধ্যে এই নতুন কথা ঘুরতে থাকে, কেন সে চুরি করল? চোরের কি কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল নাকি …। অজান্তেই না জানি কত প্রশ্ন উসামার মনের গভীরে জমে উঠতে লাগল।
সংবাদ, টিভি, চোর এবং চুরি সম্পর্কে খবরের কাগজে প্রায়ই পড়তে-শুনতে পায়, কিন্তু এবার সেই চোর থেকে তার মন সরছে না কেন? উসামা বুঝতে পারল না। হৃদয়ের এই সংঘর্ষে সে দশ মিনিট কাটাল। কিন্তু তার হৃদয়-মন সেই চোরে আটকে রইল। এখন সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সামনের মোড় কেটে আবার গাড়ি ঘুরিয়ে দিল। আগের সেই চৌরাস্তায় মোড়ে ফিরে এসেছে। দেখল, লোকজনের ভিড়। এখনও তারা চোরের চারপাশে মজা খুঁজছে। কিন্তু এখন চোরের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। গাড়িটা পাশে দাঁড় করিয়ে পায়ে হেঁটে ভিড়ের দিকে এগোতে থাকে উসামা। লোকজনকে সরিয়ে দিতে গিয়ে যখন ওই জায়গায় পৌঁছাল, সেই দৃশ্য দেখে তার হুঁশ উড়ে গেল। শক্ত-কাটা চেহারার একটি বারো-তেরো বছরের ছেলে। জনতা তাকে পিটিয়ে আহত করেছে। তার শরীরের সর্বত্র আঘাতের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। শরীরের অনেক জায়গা থেকে রক্ত ঝরছে। উসামা কাছে গিয়ে কারণ জানতে চাইলে শোনা গেল, ছেলেটি কারোর পার্স থেকে একশো টাকা চুরি করেছে। মাত্র একশো টাকার বিনিময়ে এই ছোট্ট ছেলেটিকে এত নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে শুনে উসামা হতবাক হয়ে গেল। সে চোর-চুরির উকিল নয়। এক টাকার চুরি হোক আর একশো টাকার চুরি, এটাকে শুধু চুরি বলে, তারও একই চিন্তা। কিন্তু এ সময় পরিস্থিতি ভিন্ন। ছেলেটির বয়স দেখছে না কেউ। তাকে বকা দিতে পারতো, একটু কঠোর ধমকি-ধামকি দিলেও পারতো। কিন্তু একশো টাকা চুরির জন্য এই ছেলেটির জীবন কোথায় নেবে এই বিচার?
ছেলেটিকে ভিড়ের হাত থেকে বাঁচানোর কোনো উপায় উসামার জানা নেই। হঠাৎ তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, এখানে কী হচ্ছে? এত ভিড় কেন? দেখুন, আমরা পুলিশ সদস্যরা সবকিছু দেখভাল করব। আপনারা সবাই সরে যান এখান থেকে।
এ কথা বলতেই ভিড়টা এখান থেকে সরে যেতে লাগল। কিন্তু দু-তিনজন কনস্টেবলকে আসতে দেখা যাচ্ছে। ওদের দেখে উসামার হৃৎপিণ্ড যেন হারিয়ে যাচ্ছে। এখন সে কী করবে? দ্রুত ভাবতে থাকে। একজন কনস্টেবল কাছে চলে এলো। পরিচয় জানতে চাইল। উসামার হুঁশ উড়ে গেল, এখন সে কী করবে? সে বলল, আমি দক্ষিণ সিটির থানার কনস্টেবল।
কনস্টেবল তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো। এক পর্যায়ে উসামার মনে হলো, কনস্টেবল হয়তো তার কথা বিশ্বাস করবে না। কারণ ইউনিফর্ম নেই। কিন্তু উসামা যখনই বলল, আমি আজ ছুটিতে আছি। এখানে বাজারে কেনাকাটা করার সময় ভিড় দেখে এগিয়ে এসেছি। ঘটনা কী ঘটেছে জানতে চেষ্টা করছি।
কনস্টেবল বিশ্বাস করেছে। উসামা জানে না কীভাবে কনস্টেবল তার কথা বিশ্বাস করল। যেতে যেতে বলল, আপনি এখানে সবকিছু সামলান।
উসামা কনস্টেবলকে পূর্ণ আশ্বাস দিয়ে বিদায় জানাল। তারপর ছেলেটিকে সাথে নিয়ে গাড়িতে তুলে হাসপাতালে পৌঁছাল। আঘাতের চিকিৎসা করে কিছু খাওয়ালো। তারপর শান্তভাবে জিজ্ঞেস করল, তুমি কেন চুরি করেছো? তুমি কি স্কুলে পড়োনি যে, চুরি করা খারাপ কাজ?
ছেলেটি বলল, স্যার, আমি কখনও স্কুলে যাইনি। কিন্তু আমি জানি চুরি করা অন্যায়।
উসামা বলল, তাহলে চুরি করলে কেন?
ছেলেটি বলল, স্যার, আমি চুরি করি না। আমি আমার মায়ের তৈরি খেলনা বিক্রি করে সংসার চালাই। মা অসুস্থতার কারণে খেলনা বানাতে পারেনি। তাই তিনদিন ঘরে কিছু নেই খাওয়ার। খিদের পেটে থাকতাম। কিন্তু আমার ছোটবোন ঘরে। তার খিদা কি করে দেখব? সেও মাকে ওষুধ আর খাবার দিতে চায়। আমার কাছে টাকা নেই। আমি ভিখারি নই, তবুও আজ সবার কাছে ভিক্ষা করেছি। কিন্তু কেউ আমাকে সাহায্য করেনি। আমার শুধু কিছু টাকা দরকার, আমাদের খিদা মেটানোর জন্য কিছু খাবার আনতে হবে। কিন্তু কেউ আমাকে সাহায্য করেনি। তাই শেষ পর্যন্ত আমি একজনের মানিব্যাগ ছিনিয়ে নিয়েছি। সেই মানিব্যাগ থেকে একশো টাকা নিয়ে বাকিটা ওই লোককে ফেরত দিয়েছি। কিন্তু লোকটি আমাকে চোর বলে লোকজন জড়ো করে। তারপরে তো বাকি সবকিছু আপনার জানা স্যার।
উসামা বিস্ময়ে ছেলেটির কথা শুনছে। সে বিশ্বাস করতে পারছে না এই ছেলেটি সত্য বলছে। উসামা বলল, তোমারও একটা ছোটবোন আছে? আর তোমার মা অসুস্থ? তারা এখন কোথায়?
ছেলেটি বলল, মা আর বোন বাড়িতেই আছে।
উসামা বলল, তোমার বাড়িটা আমাকে দেখাবে না কোথায়?
উসামা সত্যিই দেখতে চায় ছেলেটা আসলেই সব সত্যি বলছে নাকি সহানুভূতি পাওয়ার জন্য মিথ্যা বলছে। দুজনেই গাড়িতে বসে ছেলেটির উল্লিখিত জায়গায় পৌঁছে গেল। একটা ভাঙা জঞ্জালভরা কুঁড়েঘর। তার ওপরে কিছু পুরোনো প্লাস্টিকের ব্যাগ, বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাবার জন্য। উসামা কুঁড়েঘরে ঢুকল। ভেতরে অন্ধকার। ছেলেটি বলল, স্যার আপনি অপেক্ষা করুন, আমি আলো দিচ্ছি।
ছেলেটি আলোর জন্য একটি ছোট মোমবাতি জ্বালালো। ম্যাচ দিয়ে যখন সে জ্বালাল, তখন ঘরের কিছুটা আলোকিত হলো। কুঁড়েঘরের একপাশে একটি মাদুরের ওপর একজন মহিলা শুয়ে আছেন। পাশেই একটি আড়াই-তিন বছরের মেয়েটিও ঘুমাচ্ছে। উসামা আসার সময় খাবার নিয়ে এসেছে। ছেলেটি মা-বোনকে ঘুম থেকে জাগিয়ে খেতে দেয়। ছেলেটির প্রতি এখন তার বিশ্বাস হলো। উসামা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই ছেলেটিকে আর কখনও ভিক্ষা করতে দেবে না সে। বরং তাদের সাধ্যমতো সাহায্য করবে। কাল আবার আসবে বলে ছেলেটির বাসা থেকে বের হয়ে গেল।
রাত দুটা বাজে। কিন্তু ঘুম উসামার চোখ থেকে অনেক দূরে। ফোন হাতে নিয়ে সে একটি নম্বরে কল ঢুকাল। এমন একজনের সঙ্গে কথা বলল, যিনি ছেলেটির পরিবারকে সাহায্য করতে পারে। যেখানে ছেলেটি নিজেদের তৈরি খেলনার জিনিস ইত্যাদি বিক্রি করতে পারে পরিবারের ভরণপোষণের জন্য।