আলোচিত ও সমালোচিত মিল্টন সমাদ্দার

সুপ্রভাত ডেস্ক »

দুস্থ, অসহায় ব্যক্তিদের আশ্রয় ও সাহায্যের মতো মানবিক কাজের কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচিত ও আলোচিত ব্যক্তি বাংলাদেশের মিল্টন সমাদ্দার।

সম্প্রতি গণমাধ্যমে এসব কাজের আড়ালে তার নানা অন্যায়-অনিয়মের অভিযোগ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এরপর বুধবার এই মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

তার বিরুদ্ধে ডেথ সার্টিফিকেট জালিয়াতি, মানবপাচার, আশ্রয় দেয়া অসহায়, দুস্থ ব্যক্তিদের মৃত্যুর পর তাদের কিডনি বিক্রি, জমি দখলসহ নানা অভিযোগ উঠেছে।

কে এই মিল্টন সমাদ্দার

মিল্টন সমাদ্দারের বাড়ি বরিশালের উজিরপুরে।

২০০৯ সালে রাঙ্গামাটির চন্দ্রঘোনা খ্রিষ্টান হাসপাতাল থেকে নার্সিংয়ে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেছেন বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের পরিচয়ে তুলে ধরেন তিনি।

ভেরিফায়েড ফেসবুক পাতায় মিল্টন সমাদ্দার নিজের পরিচয় সম্পর্কে তিনটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

এসব প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার, চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার ফাউন্ডেশন ও মিল্টন হোম কেয়ার প্রাইভেট লিমিটেড।

এর মধ্যে প্রথম দুইটি প্রতিষ্ঠানকে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মিল্টন হোম কেয়ার প্রাইভেট লিমিটেড প্রতিষ্ঠানটি কোম্পানি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

ফেসবুকে দাবি করা হয়েছে, রাস্তায় পড়ে থাকা অসহায় ও আশ্রয়হীন বৃদ্ধ ও শিশুদের খুঁজে বেড়ানো তার নেশা ও পেশা হয়ে গেছে। মানুষের দান আর নিজের ব্যবসা থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে কুড়িয়ে পাওয়া বৃদ্ধ ও শিশুদের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করেন তিনি।

এতে আরো দাবি করা হয়েছে, বৃহৎ পরিসরে সেবা দিতে ২০১৪ সালে ঢাকার পাইকপাড়ায় ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।

মিল্টন সমাদ্দার নিজের পেইজে যেসব ভিডিও প্রকাশ করেছেন সেখানে বিভিন্ন সময়ে তিনি এই প্রতিষ্ঠানকে আশ্রম বলে তুলে ধরেছেন।

যেভাবে আলোচনায় মিল্টন

শুরু থেকেই মিল্টন সমাদ্দার নানা মানবিক কর্মকাণ্ডের ভিডিও করে নিজের ফেসবুক পেইজে শেয়ার করেন।

তার পেইজগুলোতে সড়কে পড়ে থাকা অসহায় বৃদ্ধ, মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি, আশ্রয়কেন্দ্রের শিশুদের অনেক ছবি ও ভিডিও শেয়ার করা রয়েছে।

এসব ভিডিওতে এ ধরনের ব্যক্তিদের রাস্তাঘাট থেকে উদ্ধার করা, চিকিৎসা ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করার পুরো প্রক্রিয়ার ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে।

এমনকি যেসব ব্যক্তিদের পরিবার রয়েছে তাদের স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের নিয়ে যাওয়া বা মৃত ব্যক্তিদের লাশ নিতে অনুরোধ করার ভিডিও রয়েছে।

ফেসবুকে প্রকাশিত বিভিন্ন ভিডিওতে এসব অসহায় মানুষদের সাহায্য করার জন্য বিভিন্ন সময়ে সমাজের বিত্তবানদের কাছে সাহায্যও চেয়েছেন তিনি।

তার আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের বাবা-মা ও শিশুদের সন্তান বলে সম্বোধন করেন মিল্টন।

এসব ভিডিওর পাশাপাশি তার ফেসবুক পেইজে ১০টির বেশি মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর রয়েছে। যেগুলোর মাধ্যমে অনুদান সংগ্রহ করা হয়। মানুষের অনুদানেই এসব কেন্দ্র পরিচালনা করা হয় বলে নিজের পেইজে প্রকাশিত বিভিন্ন ভিডিওতে বলেছেন মিল্টন।

সামাজিক মাধ্যমে এসব ভিডিও প্রকাশের পর ব্যাপক প্রশংসিত হন মি. সমাদ্দার। দুস্থদের স্থায়ী আবাসনের জন্য সাভারে ২৫ শতাংশ জমিতে ছয়তলা ভবন নির্মাণের কথাও ফেসবুকে বলা হয়েছে। চারশো থেকে পাঁচশ ব্যক্তি এখানে স্থান পাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বছরের পহেলা মার্চ এটি উদ্বোধন করা হয়েছে।

ফেসবুকে এক কোটি ৬০ লাখ মানুষ তাকে অনুসরণ করে। বাংলাদেশে সামাজিক মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি অনুসারী যাদের, তাদের মধ্যে প্রথম সারিতেই অবস্থান এই মিল্টন সমাদ্দারের।

মানবিক কাজের জন্য তিনটি রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি।

মিল্টনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ

সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে আছে মানবিক কাজের আড়ালে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রির মতো গুরুতর অপরাধের অভিযোগও।

এছাড়া সাভারে জমি দখল, আর্থিক হিসাবে অস্বচ্ছতা, আশ্রিতদের হিসাবে গড়মিল, বরিশালে চার্চ দখলের চেষ্টা, বৃদ্ধদের চিকিৎসা না দেয়া, ডেথ সার্টিফিকেট জালিয়াতি, নিজের বাবা-মাকে মারধরের নানা অভিযোগ উঠে এসেছে এসব সংবাদে।

গত তিনদিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা। মিল্টন নিজেও এসব সংবাদ নিজের পেইজে শেয়ার করেছেন। অস্বীকার করেছেন অভিযোগ।

এসব অভিযোগের পর নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজে মিল্টন সমাদ্দার লিখেছেন, “জীবনের বড় ভুল ছিল আরাম আয়েশের জীবনযাপন না করে অসহায় মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেছিলাম। সেই ভুলের মাশুল হিসেবে আজকের সবচেয়ে বড় সহজ কাজ মনে হচ্ছে আত্মহত্যা করা। রাগ অভিমান, ধৈর্য আর নিজের মধ্যে বেঁধে রাখতে পারছি না।”

ফেসবুকে এসব অভিযোগ খণ্ডন করে বিভিন্ন ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে মি. সমাদ্দারের পক্ষ থেকে।

মৃত ব্যক্তিদের কিডনি বিক্রির অভিযোগের বিষয় খণ্ডন করে যে মাওলানা মৃত ব্যক্তিদের জানাজা পড়াতেন ও গোসল করাতেন তার বক্তব্য সংবলিত ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে।

মাওলানা ফয়সাল আহমেদ এই ভিডিওতে, মৃতদের শরীরে কোনো কাটাছেঁড়া না থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে এ অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন।

এছাড়াও কিডনির অস্ত্রোপচারের বিষয়ে এস জেড এম হাসান নামে একজন চিকিৎসকের বক্তব্য ভিডিও করে প্রকাশ করা হয়েছে।

ওই ভিডিওতে চিকিৎসক বলেন, “কিডনির সার্জারি করতে যে ধরনের মেডিকেল যন্ত্রপাতি প্রয়োজন তা এই আশ্রয় কেন্দ্রে নেই। এমনকি যেসব ব্যক্তিদের কথা বলা হচ্ছে কিডনির অস্ত্রোপচারের মতো শারীরিক সক্ষমতাও তাদের নেই। এ ধরনের অপারেশন করতে প্রয়োজনীয় জনবলও তার নেই।”

তিনি বলেন, “অনেক সরকারি হাসপাতালেও এ ধরনের অপারেশনের সক্ষমতা নেই। মিল্টনের যে আশ্রম সেখানে এটা সম্ভব না। যে অভিযোগ করা হচ্ছে সেটা একেবারেই ভিত্তিহীন ”।

এরই মধ্যে মি. সমাদ্দারের সঙ্গে কাজ করা এবং নানাভাবে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তিও তার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনেন।

নিজের বাবা-মাকে মারধরের অভিযোগও খণ্ডন করে ফেসবুকে ভিডিও শেয়ার করা হয়েছে। ওই ভিডিওতে মিল্টনের মা ছবি সমাদ্দার এ অভিযোগ নাকচ করে দেন।

সুষ্ঠু তদন্ত শেষে এসব অভিযোগ প্রমাণিত হলে দেশের আইন ও প্রশাসন যে শাস্তি দেবে তা মাথা পেতে নেয়ার কথা বলে গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন মিল্টন সমাদ্দার।

গ্রেপ্তারের আগের দিন একটি বেসরকারি টেলিভিশনে দেয়া সাক্ষাৎকারে মিল্টন সমাদ্দার ডেথ সার্টিফিকেট জালিয়াতির কথা স্বীকার করেন। তবে, আশ্রয়কেন্দ্রের আগের কর্মচারীরা চিকিৎসক ওস তার অজ্ঞাতসারে স্বাক্ষর জাল করেছেন বলে দাবি মি. সমাদ্দারের।

ডেথ সার্টিফিকেট জাল করা অন্যায় হয়েছে স্বীকার করে এর কারণ ব্যাখ্যা করেছেন মিল্টন।

তিনি বলেন, “আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা চাইল্ড এন্ড ওল্ড এজ কেয়ারে আমরা মৃত ব্যক্তিকে দাফন কাফন করতে পারি না। না পারার বড় কারণ হলো তাদের জন্ম নিবন্ধন নাই, পরিচয়পত্র নাই, তাদের কাছে কোনো কাগজপত্র পাওয়া যায় না। শতকরা ৯৫ ভাগ বাবা-মাই তাদের পরিচয় দিতে পারে না”

“সেক্ষেত্রে তারা যখন মারা যায় তখন আমাদের দাফন কাফন করতে হেনস্থা হতে হয়। অনেক সময় হয়, একটু কাগজপত্র দিলে কথাবার্তা ছাড়াই মাটি দেয়া যায়। কবরস্থানে যে কোনো কাগজ চায়। একটা মেডিকেল সার্টিফিকেট হোক, সেটা জন্ম নিবন্ধন হোক, ভোটার আইডি হোক। অজ্ঞাত মানুষকে কবর দেয়ার সুবিধার্থে চিকিৎসকের সিল মেরে সই করে দেয়া হইছে। ঘটনাটা সত্যি,” বলেন মিল্টন সমাদ্দার।

মিল্টনের আইনজীবী মো. ওহিদুজ্জামান বিপ্লব ফেসবুক ভিডিওতে দাবি করেছেন, “সাভারে আশ্রয়কেন্দ্রের জন্য যে স্থায়ী ভবন বানানো হয়েছে সেখানে জমি ও রাস্তা সংক্রান্ত জটিলতায় মিল্টনের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তোলা হয়েছে।”

সাভার থানায় এ নিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে বলে ভিডিওতে বলেছেন ওই আইনজীবী।

অভিযোগ ওঠার পর গ্রেপ্তার মিল্টন

এরই মধ্যে বুধবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে মিল্টন সমাদ্দারকে।

গ্রেপ্তারের পর ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ গণমাধ্যমে বলেছেন, “তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে সেগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করা হবে। প্রমাণ পাওয়া গেলে তাকে ছাড় দেয়া হবে না।”

মিল্টন সমাদ্দার লাশ দাফনের যে হিসাব দিয়েছেন, সেখানেও গরমিল রয়েছে বলে গণমাধ্যমে দেয়া বক্তব্যে জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে তিনি ৯০০ লাশ দাফন করেছেন। কিন্তু ৮৩৫টি লাশের হিসাবে গরমিল পাওয়া যায়। এসব লাশ দাফনের কোনও ডকুমেন্ট তার কাছে নেই। তিনি গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছেন, নিজেই মৃত্যু সনদ তৈরি করে চিকিৎসকের স্বাক্ষর ও সিল জাল করতেন। তার আশ্রমের পাশে একটা মসজিদ আছে, সেখান থেকেও প্রশ্ন উঠেছে, লাশের শরীরে কিডনির পাশে রক্তের দাগ রয়েছে। এসব বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।”

আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা ব্যক্তিদের সংখ্যা নিয়েও গড়মিল রয়েছে বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ।

মিল্টনের বিরুদ্ধে মামলা

বৃহস্পতিবার তার বিরুদ্ধে মিরপুর মডেল থানায় তিনটি মামলা দায়ের করা হয়।

এসব মামলায় ডেথ সার্টিফিকেট জালিয়াতি, মানব পাচার, হত্যার উদ্দেশ্যে মানুষকে নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে ডেথ সার্টিফিকেট জালিয়াতির মামলায় মিল্টন সমাদ্দারকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হয়।

তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাত দিন রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত তিন দিন মঞ্জুর করে।

তবে, বিকেলে শুনানি শেষে মিল্টনের আইনজীবী আব্দুস সালাম শিকদার ডেথ সার্টিফিকেট জালিয়াতির অভিযোগ অস্বীকার করেন। এই মামলার কোনো ভিত্তি নেই বলে দাবি তার।

সূত্র: বিবিসি বাংলা