এগিয়ে চলার স্বপ্ন

সুপ্রিয় দেবরায় »

চৈত্রের শেষ বিকেল। দুপুরবেলার দাবদাহ এখন অনেকটাই প্রশমিত হলেও শরীর এখনও চিড়বিড় করছে গরমে। বিকেলের শেষ রোদ্দুর ছুঁয়ে যাচ্ছিল ছায়ার মুখে-চোখে। খাকি প্যান্ট-শার্ট ঘামে ভিজে জবজব। খানিকটা তাপ লাগলেও ছুটে আসছিল মাঝে-মাঝে একটা ফুরফুরে হাওয়া। তার সর্বাঙ্গে ঘামে ভেজা জামাকাপড় ফুঁড়ে যেন শীতল একটা পরশ ছুঁইয়ে দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ওটা তাৎক্ষণিক একটা মানসিক অনুভূতি। অটোটা ‘সোনার তরী’ এনজিও’র বাইরে পার্ক করে অফিসে ঢোকে। এখানে আসার আগে খালি টিফিনবক্সগুলো নামিয়ে দিয়ে এসেছে অনাথ আশ্রমে। অটোর চাবিটা নির্ধারিত স্থানে ঝুলিয়ে রাখতে না রাখতেই উমা দিদিমণি ডাকেন ছায়াকে।
আমি ভাবছি, কাল থেকে তুমি দুপুরের ফুড ডেলিভারি করার পর অটোটা নিয়ে বাড়ি চলে যাবে। সন্ধেবেলায় সাতটায় এসে রাতের খাবারটা বৃদ্ধাশ্রমে ডেলিভারি করতে হবে। তোমার সাথী পারুল যে রাতের খাবার ডেলিভারি করতো, কাল থেকে আর আসবে না। ওর বাচ্চা হবে, বাড়ি থেকে বাধা দিচ্ছে। তুমি পারবে? পারিশ্রমিক অবশ্যই দ্বিগুণ পাবে।
একটু চুপ করে থেকে ছায়া আস্তে আস্তে বলে, লিটনের বাবার সাথে কথা বলে দেখি। কালকে জানাবো।
না, তুমি বাড়ি ফিরে আজকেই আমাকে ফোনে জানাবে। নাহলে, অন্য ব্যবস্থা আমাকে করতে হবে।
ঠিক আছে, উমাদি।
চিন্তাগ্রস্ত মনে ছায়া চলে যায় খাকি প্যান্ট-শার্ট ছেড়ে সালোয়ার-কামিজ পরতে। লিটনের বাবা নিমাই হয়তো একটু গাঁই-গুঁই করবে প্রথমে, একটু চিল্লাবে। কিন্তু মনে হয় নিশ্চয়ই মেনে যাবে। একবারে মাইনেটা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এটা ভাবলেই আর আপত্তি করবে বলে মনে হয় না। একটাই অসুবিধা, এই অফিস থেকে সাইকেলে ছায়াকে বাড়ি ফিরতে হয়, প্রায় পাঁচ মিনিট মতন লাগে। রাতের খাবার বৃদ্ধাশ্রমে পৌঁছিয়ে, ফেরত আসতে রাত সাড়ে নয়-দশটা তো বাজবেই। যদিও কাঞ্চননগর, উদয়পল্লি খুব শান্ত-শিষ্ট জায়গা। সেরকম বড় কোনো ঝামেলা হয়েছে বলে কোনোদিন শোনেনি ছায়া। সেরকম মনে করলে নিমাই চলে আসবে ঐ সময় তার সাইকেল নিয়ে। তবে ননদ মঙ্গলা ঝামেলা করতে পারে। সকালে ছায়া দুপুরের রান্না করে, পাঁচ বছরের ছেলেকে খাইয়ে, নিজে খেয়ে বারোটা নাগাদ বেরোয়। বিকেলে সাড়ে চারটে নাগাদ ফিরে, স্নান করে, রাতের রান্না করে। এবার ননদকে রাতের ভারটা নিতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতে ছায়া বেরিয়ে আসে এনজিও‘র অফিস থেকে। মনে মনে ঠিকই করে নেয়, রাতের কাজটা ও করবে। এতগুলো টাকার সুযোগ ছেড়ে দেওয়া যায় না।
দুই
কাঞ্চননগর পূর্ব বর্ধমান জেলার অন্তর্ভুক্ত একটি ছোট শহর। আনুমানিক ৫০০ ঘর বসতি হবে। আছে একটি প্রাইমারি এবং দুটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। কৃষ্ণ ঠাকুর, শিবঠাকুর ছাড়াও একটি শক্তিপীঠ মা কালির মন্দির আছে। আছে কয়েকটি সিনেমা হল, হাসপাতাল, বাজার। বর্ধমান ৪-৫ কিলোমিটার দূরে।
এখানে ‘সোনার তরী’ নামে একটি এনজিও আছে। আছে এদের অধীনে একটি বৃদ্ধাশ্রম এবং একটি অনাথাশ্রম। সোনার তরী শুরু করেছিলেন অনিমা দেবী বেশ কয়েক বছর আগে, এখন ওনার প্রধান সহকারী উমা দেবী ছাড়াও আছেন আরও দশ-বারোজন। অনাথাশ্রমের বাচ্চারা পড়ে প্রাইমারি স্কুলে এবং তারপর ভর্তি হয় ডি এল পোদ্দার হাই স্কুলে। সেভাবেই ব্যবস্থা করে রেখেছেন অনিমা দেবী স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথে। এখন প্রায় তিরিশটি বাচ্চা আছে অনাথাশ্রমে। ওদের দেখাশোনা করার জন্য তিনজন সহকারী আশ্রমেই থাকেন, এছাড়া রান্নার এবং বাজার করার জন্য চার-পাঁচজন আছে। প্রাইমারি স্কুলটি অনাথাশ্রমের গা ঘেঁষে, কয়েক মিনিটের হাঁটা রাস্তা। অনাথাশ্রমের দুজন পরিচারিকা নিয়ে যায় বাচ্চাদের প্রাইমারি স্কুলে, ছুটির সময় ফেরত নিয়ে আসে। ডি এল পোদ্দার স্কুলের নিজস্ব বাস আছে, ছাত্রছাত্রীদের জন্য। অবশ্য স্কুল এখন বন্ধ। এছাড়া অনাথাশ্রমে দুজন প্রাইমারি টিচার আসেন, যারা বাচ্চাদের খেলাধুলা ছাড়াও প্রাথমিক শিক্ষাও প্রদান করেন। কিছু হাতের কাজও – যেমন ছবি আঁকা, একটু বড়দের সেলাই, মাটির মূর্তি তৈরি করা, ইত্যাদি শেখানো হয়।
অনিমা দেবী দিনের বেলায় অনাথাশ্রমেই বেশি সময় কাটান আর অফিসটা চালান উমা দেবী। বৃদ্ধাশ্রমে খাবার পাঠানো হয় অনাথাশ্রমের রান্নাঘর থেকেই। সকালের টিফিন এবং বিকেলের নাশতা-চা ইত্যাদির ব্যবস্থা আছে বৃদ্ধাশ্রমে। বৃদ্ধাশ্রমেও দুজন মহিলা থাকেন। এখন আঠারোজন সদস্য আছেন বৃদ্ধাশ্রমে। অনাথাশ্রম শুরু করেছিলেন অনিমা দেবী পাঁচবছর আগে, আর বৃদ্ধাশ্রম বছর তিনেক আগে। ছায়ার আগে অনাথাশ্রমের রান্নার লোকেরাই সাইকেল করে খাবার পৌঁছে দিয়ে আসত বৃদ্ধাশ্রমে, তখন মাত্র চারজন ছিলেন। এখন সদস্য সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতে অটোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বৃদ্ধাশ্রমে দশটি থাকার ঘর ছাড়াওএকটি বড় হলঘর টিভিসহ, একটি খাওয়ার ঘর আছে। একটি রান্নাঘরও আছে যেখানে চা-কফি, দুধ, সকালের এবং বিকেলের খাবার বানানো হয়। বৃদ্ধাশ্রমে সবসময় থাকা দুজন পরিচারিকা এসব দেখাশোনা করেন। উমা দেবী অফিস সামলানো ছাড়াও এখানে রোজ একবার এসে সব সদস্যদের সাথে কিছুটা সময় কাটান, ওনাদের সুবিধা-অসুবিধার খোঁজখবর নেন। একজন ডাক্তার ঠিক করা আছে, প্রত্যেক সপ্তাহে এসে চেকআপ করে যান।
‘সোনার তরী’ এনজিওটি চলে কিছুটা সরকারি অর্থসাহায্যে, যেটার অনুমোদন পেয়েছে দুবছর আগে। বাকিটা পাবলিক ডোনেশনে। অনিমা দেবীর স্বামী একজন উচ্চপদস্থ অফিসার একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। আছেন সেলস মার্কেটিং বিভাগে। ওনার মাধ্যমে অনেক বড় বড় পার্টির থেকে মোটা টাকার ডোনেশন আসে। অনিমা দেবীর পৈতৃক বাড়ি এই কাঞ্চননগর শহরে, ছোটবেলা কেটেছে এখানকার ধুলোমাটি মেখে। সেই মাটির টান ওনাকে শুরু করায় ‘সোনার তরী’ এনজিও’টি। ছেলেমেয়েরা সব বড় হয়ে গেছে, ছেলে আমেরিকাতে সেটলড। মেয়ে তার সংসার নিয়ে থাকে মুম্বাইতে। স্বামী এখনো এক্সটেনশনে কাজ করছেন। আগে ছিলেন কলকাতার অফিসে। এখন কোম্পানির ব্রাঞ্চ অফিস – দুর্গাপুরে বসেন। এই চুক্তিতেই উনি এক্সটেনশন নিতে রাজি হন। কোম্পানির ক্যাবে যাতায়াত করেন। এসব ছায়া আস্তে-আস্তে অনিমা দিদির মুখ থেকে শুনেছে।
উমা দেবীর সাথে পরিচয় হয়েছিল অনিমা দেবীর যখন ওনারা কলকাতাতে থাকতেন। উমা দেবী অনেকটাই ছোট অনিমা দেবীর থেকে। উমা দেবী ডিভোর্সি। বিয়ের তিন-চার বছর পরই উমা দেবীর সন্দেহ হয় স্বামীর ওপর। মানিয়ে-গুছিয়ে চলছিলেন, কিন্তু ব্যাপারটা প্রায় অসহ্যর পর্যায়ে চলে আসে যখন অফিসের কাজের এবং টুর-এর অজুহাত দিয়ে বাইরে রাত কাটাতে আরম্ভ করেন ওনার স্বামী। উমা দেবী তখন সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছেন। মাঝ-মাঝেই বিকৃত মস্তিষ্কের মতন চেঁচামেচি করতেন, ব্যবহার করতেন। সেটার সুযোগ নিয়েই ওনার স্বামী আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-পড়শিদের কাছে প্রমাণ করতে শুরু করেন যে উমা দেবী উন্মাদ হয়ে গেছেন, এখনই মেন্টাল হাসপাতালে দিতে হবে। আর সহ্য করতে না পেরে উমা দেবী মিউচুয়াল সেপারেশন নিয়ে বেরিয়ে আসেন এবং চলে আসেন অনিমা দেবীর আশ্রয়ে। এবং শুরু হয় ওনার নতুন জীবন।
তিন
ছায়া ওর স্বামী নিমাই, ননদ মঙ্গলা আর ছেলে লিটনকে নিয়ে থাকে উদয় পল্লিতে। স্বামী-স্ত্রী দুজনই কাজ করতো ডি এল পোদ্দার হাই স্কুলে। স্কুলের ঘরগুলি ধোয়া-মোছা পরিষ্কার করার জন্য পেতো দুজনে মিলে ৬,০০০ টাকা মাসে। দুবছর আগে করোনা মহামারি চালু হলে স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। চলে যায় ওদের চাকরিও, সাময়িকভাবে। পড়ে মহাবিপদে। বুঝতে পারে না কী করে চলবে সংসার। দুমাস পর যখন লকডাউন ধীরে-ধীরে শিথিল করা হয়Ñ নিমাই বর্ধমান থেকে সবজি, ডিম, ইত্যাদি পাইকারি দরে কিনে এনে শুরু করে ঘরে-ঘরে গিয়ে বিক্রি। কিন্তু তাতে থাকে কয় পয়সা! আবার এটা শুরু করার জন্য নিমাই রায়বাবুর থেকে নিয়েছে ৫,০০০ টাকা লোন, সেটাও মাথার ওপর চেপে বসে আছে। দুবেলার রান্নার জোগাড় করাই তখন একটা চিন্তার বিষয় হয়ে ওঠে। এদিকে মঙ্গলাও শরীরে বাড়ছে, কিছুদিনের মধ্যে করতে হবে বিয়ের ব্যবস্থা। সেটা ছিল জুলাই মাস। ছায়া বেরিয়েছিল কাজের খোঁজে, সাইকেলে। রোদের তাপে কাহিল হয়ে পরে, জলের তেষ্টাও পেয়েছিল। ‘সোনার তরী’ এনজিওর গেট খুলে, অফিসের দরজায় পৌঁছে একটু জল চায়। উমা দেবী তখন আরেকজনের সাথে বসে মনোযোগ সহকারে কম্পিউটারে কিছু কাজ করছিলেন। চোখটা তুলে চশমার ফাঁক দিয়ে দেখতে পান ছায়াকে। ভেতরে ডাকেন। জল আনতে বলেন কাউকে উঁচু গলায় ভিতর থেকে। কথাবার্তায় জানতে পারেন ছায়া কাজ খুঁজছে। ছায়া চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। ঘর-উঠোন পরিষ্কার করা, রান্না করা, এছাড়া আর কিছু জানে না। কিন্তু উমা দেবীর দরকার একটু পড়াশো জানা লোকের। হঠাৎ উনি ছায়াকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি অটো চালানো শিখবে? ছায়া হা করে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে উমা দিদিমণির দিকে। উনি কি ঠাট্টা করছেন ছায়ার সাথে! ছায়ার অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে তখন উমা দেবী বোঝান, একটি অনাথাশ্রম আছে – যেখানে এক সাথে রান্না করা হয়। ওখান থেকে রান্নাকরা খাবার টিফিনবাক্সে ভরে পৌঁছে দিতে হবে ৪ কিলোমিটার দূরে বৃদ্ধাশ্রমে। তারপর সবার খাওয়া হয়ে গেলে, খালি টিফিনবাক্স আবার অনাথাশ্রমে পৌঁছে দিতে হবে। বৃদ্ধাশ্রমে এখনও রান্নার ব্যবস্থা পুরোপুরিভাবে শুরু করা যায়নি। পারুল নামে একটি মেয়ে এর মধ্যেই ১৫ দিন হলো অটোচালানোর ট্রেনিং নিচ্ছে ড্রাইভিং স্কুলে। সপ্তাহখানেক পরে পরীক্ষা দিয়ে লাইসেন্স পেয়ে যাবে। অটোটাও কিছুদিন আগে কেনা হয়েছে। তবে পারুল রাতের খাবার পৌঁছে দেবে। কারণ ও দিনের বেলায় একটা কারখানায় কাপড়ের মাস্ক বানানোর কাজ করে ওর বরের সাথে। কাপড়ের মাস্ক বর্ধমান ইত্যাদি জায়গায় সাপ্লাই করে কোম্পানিটি। পারুল কারখানা থেকে ফিরে বিকেলে অটো চালানোর ট্রেনিং নিচ্ছে। ছায়াকে দুপুরের খাবার পৌঁছে দিতে হবে। অটোচালানোর লাইসেন্স পেয়ে গেলে সাথে-সাথেই কাজে নিয়োগ হয়ে যাবে ছায়া এবং মাসিক ৩,০০০ টাকা পাবে। টাকার অঙ্ক শুনেই ছায়া রাজি হয়ে যায়।
চার
নিমাই তো প্রথমে শুনে অবাক হয়ে যায়। বলে, তুমি মেয়ে হয়ে অটোচালাবে? লোকে কি বলবে! বড় শহরে শুনেছি মেয়েরা আজকাল ক্যাব, অটো চালাচ্ছে। কিন্তু এই গ্রামের মতো ছোট শহরে কি এটা সম্ভব! আর তুমি পারবে নাকি অটো চালাতে!
চেষ্টা করতে দোষ কোথায়। আরেকটি মেয়ে পারুল সেও নাকি অটো চালানো শিখছে। এই দুর্দিনে টাকাটার কথা ভাববে না! এতগুলো টাকা! আর লোকে কী বলবে সে কথায় কান দিলে আমাদের চলবে! চেষ্টা তো অনেক করলাম। কিন্তু এই মহামারির সময়ে কেউ নতুন লোক বাড়িতে ঢুকতে দিচ্ছে না। তোমার বাজারে দেনা এতগুলো টাকা। কবে স্কুল খুলবে কোনো ঠিক নেই। আর আমি সংসারের সব কাজ করেই বারোটা নাগাদ বেরোবো। একবার চেষ্টা করে তো দেখি। আর বড় শহরে যদি মেয়েরা ক্যাব-অটো চালাতে পারে, এখানে কেন পারবে না! এই চিরাচরিত চলে আসা গতানুগতিক শেকলটা ভাঙার চেষ্টা একবার করে দেখি না!
নিমাই আর একটু ধানাই-পানাই করে নিমরাজি হয়ে যায়। টাকার অঙ্কটাও লোভ দেখায়। সবজি বিক্রি করে একা সংসার চালাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। রায়বাবুর দেনাটাও মাথার ওপর খাঁড়ার মতন যেন ঝুলছে। রায়বাবু প্রায় রোজই তাগাদা দেয়। আর সেই সুযোগে, যা দাম দেয় তার থেকে বেশি পরিমাণ সবজি-ডিম হাতিয়ে নেয়।
ছায়া একমাসের মধ্যে লাইসেন্স পেয়ে কাজে বহাল হয়ে যায়। পাড়ার লোকে অবশ্য প্রথমে ভালো দৃষ্টিতে নেয়নি ব্যাপারটা। অনেকেই নিমাইকে টিটকিরি মেরেছিল, বাড়ির বৌকে অটোচালাতে দেয়ার জন্য। এখন অবশ্য ধীরে-ধীরে ব্যাপারটা মেনে নিয়েছে। বৃদ্ধাশ্রম থেকে ফেরার পর প্রায় দিনই অনিমা দিদিমণির থেকে একটু-একটু করে ছায়া ইংরেজি শিখে নিচ্ছে। এখন ছায়া একটু-একটু ইংরেজি পড়তে পারে, লিখতেও পারে। দিদিমণি বলেছেন এরপর আস্তে-আস্তে কম্পিউটারেও প্রশিক্ষণ দেবেন।
দেখতে-দেখতে প্রায় দুবছরের কাছাকাছি কেটে গেল। গত বছর নভেম্বর মাসে স্কুল খুলেছিল। নিমাই কয়েকদিন গিয়ে স্কুল পুরো পরিষ্কার করেছে। স্কুলবাড়ি পুরো স্যানিটাইজ করা হয়। নিমাই আবার কাজে বহাল হয়। ছায়াকেও স্কুল কর্তৃপক্ষ নিমাইয়ের মাধ্যমে খবর দিয়েছিল। ছায়া ভাবছিল কী করবে। হুট করে এনজিওর চাকরিটা ছাড়তে মন চাইছিল না। দোনামোনা করতে-করতেই আবার বন্ধ হয়ে যায় স্কুল। নিমাইও আবার সবজি বিক্রি করতে শুরু করে।
পাঁচ
লুঙ্গিটা কোমর থেকে আলগা করে নিমাই ঝাপটা মেরে আর একটু হাঁটুর ওপর তুলে পরে। খালি গা। সেই যে কখন কারেন্ট গেছে, এখনও আসার নাম নেই। যা গরম পড়েছে ! লোমকূপ ভিজিয়ে ঘাম বেরিয়ে গেলে শরীরে একটু আরাম পাওয়া যেত। এই চৈত্র মাসেই গরম যেন শরীরে গিরগিটির মতো মোচড়াচ্ছে। ঘাম লোমকূপ ভিজিয়ে না শরীর বেয়ে পড়ছে, না তার পীড়াদায়ক কার্যকারিতা বন্ধ রেখেছে। বিচ্ছিরি ঘামে শরীর স্যাঁতস্যাঁতে লাগছে।
নিমাই বাইরের খোলা বারান্দায় এসে বসে। এখানে তবু একটু আরাম, মাঝে-মাঝে একটা হাওয়া এসে ঘাম ভেদ করে একটা শীতল স্পর্শের ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে।
ছায়া স্নান করে চুল আঁচড়াতে-আঁচড়াতে বাইরে মোড়ার ওপর এসে বসে, নিমাইয়ের শরীর ঘেঁষে। মঙ্গলা চায়ের কাপ দাদা-বৌদিকে ধরিয়ে, নিজেও একটা চায়ের কাপ নিয়ে বসে আরেকটি মোড়াতে। লিটন এখনও ঘুমুচ্ছে ঘরের মধ্যে।
আজ রায়বাবুর বাড়ি যখন সবজি দিতে যাই, বলে কাল যে বারোটা ডিম নিয়েছিল তার মধ্যে দুটো পচা ছিল। পচা তো আমি কী করবো! আমি কি ডিমের মধ্যে ঢুকে দেখতে গেছি, কোনটা পচা, কোনটা ভালো! দুটো ডিমের পয়সা কেটে নিল। একটু রাগারাগি করলাম। বলে কিনা, কালকের মধ্যে বাকি টাকা ফেরত দিতে। কোথায় পাই এখন টাকা। বললাম, সপ্তাহ দুয়েক অপেক্ষা করুন। ছায়া মাইনে পেলেই ফেরত দিয়ে দেব। কিছুতেই কথা শোনে না। কালকেই ফেরত দিতে হবে। তার ওপর তোমার অটোচালানো নিয়েও কটূক্তি করলো। মরদ হয়ে বাড়ির বৌকে সামলাতে পারি না। পাড়ার মান-ইজ্জত আমরা নাকি ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছি।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে ছায়া বলে, আর কত টাকা বাকি আছে?
হাজার টাকা দিলেই সব মিটে যাবে।
আমি কাল অফিস থেকে চেয়ে এনে দেব। কাল বিকেলেই সব মিটমাট করে চলে আসবে। আর শোনো, একটা কথা আছে। আমাদের অফিসে পারুল বলে যে মেয়েটি কাজ করতো রাতে, সে পোয়াতি। তাই কাজ ছেড়ে দেবে। উমা দিদিমণি বলেছেন, রাতে খাবার দেওয়ার কাজটা আমাকে করতে। সাতটায় যেতে হবে, ফিরতে রাত দশটা মতন হবে। অনাথাশ্রম থেকে রান্নার লোকের একজন জোগালি আমার সাথে যাবে বৃদ্ধাশ্রমে।
নিমাই ক্যাঁক করে একটি আওয়াজ গলা থেকে বের করে বলে, মামদোবাজি নাকি! ওদেরকে বলো অন্যলোক খুঁজে নিতে। অটোচালাতে দিয়েছি বলে নানা লোকে কত কথা শুনিয়েছে। এখন রাতে বাড়ির জোয়ান বৌ বাইরে থাকলে পাড়ার লোক আমাদেরকে ঘরছাড়া করাবে। ওসব হবে না। তুমি অত রাতে বাড়ি ফিরবে সাইকেল করে? আমি আজকে রায়বাবুর সাথে ঝামেলা হওয়ার পর স্কুলে গিয়েছিলাম। পরের সপ্তাহ থেকে স্কুল খুলবে। আমরা দুজনে ওখানেই আবার কাজ করতে পারবো।
কেন, তুমি সাড়ে ন’টার সময় চলে আসবে এনজিওর অফিসে আমাকে নিতে। পারবে না ? স্কুল তো ৬,০০০ টাকা দেবে আমাদের দুজনকে। আর এখানে আমার মাইনে দ্বিগুণ হয়ে যাবে ৬,০০০ টাকা। তারপর তোমার টাকা স্কুল থেকে। এই সুযোগ কেউ ছাড়ে ?
কিন্তু রাতে বাড়ির রান্না কে করবে ? আর ছেলেটাও মা ছাড়া প্রায় সারাদিন থাকবে।
দেখো, টাকার মুখ দেখতে গেলে একটু তো সবাইকে মানিয়ে নিতে হবে। আমি যাওয়ার আগে যতটা পারি রান্না করে যাবো। তুমি একটু সাহায্য করবে আমাকে, পারবে না ?
এই সময় ছায়াকে চমকে দিয়ে মঙ্গলা বলে ওঠে, দাদা, তুমি বৌদিকে রাতের কাজটা করতে দাও। আমি ঘরের কাজ সামলে নেব। লিটনেরও কোনো অসুবিধে হবে না।
অগত্যা নিমাই রাজি হয়ে যায়। ছায়া বুঝতে পারে, সংসারে টাকা আসবে। সেই কারণে মঙ্গলা হয়তো রাজি হয়ে গেল ঘরের কাজ করার জন্য। বুঝতে পারছে নিজের বয়স হচ্ছে। টাকা-পয়সা একটু না হলে, দাদা বিয়ে দেবে কী করে !
ছয়
একাদশীর চাঁদের জ্যোৎস্নার আলো মেঘে-মেঘে সাঁতার কেটে নীরবে ঝাঁকড়া সজনে গাছটার ডাল-পাতা ফুঁড়ে ভাসিয়ে দিচ্ছে বিছানার চাদর, ছায়ার কপাল। চৈত্র শেষের দখিন হাওয়ায় উড়ছে মন-কেমনের তীব্র ঘ্রাণ। আজ চোখে ঘুম নেই ছায়ার। নিমাই আর ওর মাঝখানে লিটন শুয়ে আছে মাকে জড়িয়ে, এক পা তুলে ছায়ার কোলের ওপর। নিমাইও সারাদিন খেটেখুটে ক্লান্ত অবসন্ন, নাক ডেকে সুখনিদ্রায়। ছায়া আজ খুব খুশি, নিমাই মেনে নিয়েছে সবকিছু। মঙ্গলাও খুশি। ছায়ার মঙ্গলাকে নিয়েই একটু অস্বস্তি ছিল। জানতো নিমাই একটু গাঁই-গুঁই করলেও, ওকে মানাতে অসুবিধা হবে না। ছায়া এখন অনেক দূরের স্বপ্ন দেখছে। একটু টাকা-পয়সা জমলে, ব্যাংকের থেকে লোন নিয়ে একটা অটো কেনার মতলব করছে কিছুদিন পর। এনজিওর দিনের খাবার সরবরাহ করার জন্য একজন কেউ জুটে গেলে, ছায়া নিজের অটো নিয়ে বর্ধমান আর তালিত ইস্টিশন থেকে সওয়ারী আনা-নেওয়া করবে। আর রাতের এনজিওর কাজটা করবে। স্কুলের ছেলেমেয়েদেরও স্কুলে নিয়ে যাওয়া-নিয়ে আসা করতে পারে। এখানে অনেক অটো তাই করে। মহিলা ড্রাইভার দেখলে অভিভাবকেরা বাচ্চাদের দিতে আরও ভরসা পাবে। ছায়া এখন আর কিছু আগে ভাবতে পারছে না। একবার যখন অটোচালানো শিখে নিয়েছে, আর স্কুল পরিষ্কার করার কাজ করবে না। এই সাফল্যের চাকা সে থামতে দেবে না। এখন অনেক-অনেক স্বপ্ন। সবে একটু সুখের মুখ দেখার কিরণ দেখতে পাচ্ছে। কাল সকালের সূর্য এক নতুন লাল আভা নিয়ে তার জীবনের দিগন্তে উদ্ভাসিত হবে। এই তো সবে শুরু। সাতকাহন ভাবতে-ভাবতে কখন যে গভীর ঘুমে ঢলে পড়েছে ছায়া, নিজেই জানে না।