এক বরেণ্য শিক্ষাবিদের প্রতিকৃতি

জাতীয় অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন

ড. সালমা বিনতে শফিক »

জন্ম তাঁর অবিভক্ত ভারতবর্ষে ; চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া থানার অন্তর্গত কাঞ্চনা ইউনিয়নের এক সম্ভ্রান্ত কৃষিজীবী পরিবারে। শৈশবেই প্রত্যক্ষ করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা। গ্রামের পাঠশালার পাঠ চুকিয়ে ক্রমান্বয়ে চট্টগ্রাম, ঢাকা ছাড়িয়ে যাত্রা করেন বিলেতে। পড়ার নেশায় ছুটে যান দেশ হতে দেশান্তরে। পঁচাশি বছর দীর্ঘজীবন পরিক্রমায় বইপত্র আর কাগজ কলমের সঙ্গে রচিত হয়েছে এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। একজন শিক্ষাবিদের জন্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘জাতীয় অধ্যাপক’ অভিধায় ভূষিত। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং একুশে পদকপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন। ১৯৩৭ সালের ১ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন এই বরেণ্য শিক্ষাবিদ।
পিতা মৌলবি আবদুল বারী এবং মাতা মোসাম্মাৎ গুলজান বেগমের ছয় সন্তানের মধ্যে পঞ্চম তিনি। বিদ্যানুরাগী বাবার কাছেই লেখাপড়ার হাতেখড়ি, আরবি ও ধর্মীয় শিক্ষার মধ্য দিয়ে। গ্রামের স্কুল হতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ সমাপ্ত করেন। এরপর চট্টগ্রাম কলেজ হতে সাফল্যের সঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় অসামান্য কৃতিত্বের জন্য রাষ্ট্রপতি পদক লাভ করেন ১৯৫৯ সালে। পরের বছর প্রভাষক পদে যোগ দেন ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কলেজে।
১৯৬১ সালে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (ঝঙঅঝ)- এ গমন করেন। কাকতালীয়ভাবে তাঁর পিএইচডি তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন প্রফেসর জে. বি. হ্যারিসন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যিনি ইংরেজ মেজর হিসেবে কর্মরত ছিলেন চট্টগ্রামেই। সেদিনের বালক আলমগীরের গ্রামের বাড়ি থেকে মাত্র দু’মাইল দূরে দোহাজারি বিমানঘাঁটিতে অবস্থান করছিলেন তদানিন্তন মেজর হ্যারিসন। জাপানি বোমার আক্রমণ হতে চট্টগ্রাম সীমান্ত রক্ষায় অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। এই ঘটনাটি বহুবছর পর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও ছাত্রের মাঝে একটা অদ্ভুত যোগসুত্র স্থাপন করেছিল। গবেষক আলমগীর সিরাজুদ্দীন প্রফেসর হ্যারিসনের নির্দেশনায় ‘ঞযব জবাবহঁব অফসরহরংঃৎধঃরড়হ ড়ভ ঊধংঃ ওহফরধ ঈড়সঢ়ধহু রহ ঈযরঃঃধমড়হম’ শিরোনামে অভিসন্দর্ভ রচনা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৬৪ সালে। ইংরেজ ঐতিহাসিকগণ এবং পরবর্তীকালে ভারতীয় ইতিহাসবিদগণও ঔপনিবেশিক শাসনের ত্রুটিগুলোকে প্রধানত সর্বভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিশ্লেষণ করতেন এবং তাঁদের গবেষণায় স্থানীয় ইতিহাস এক প্রকার উপেক্ষিত ছিল, বলা যায়। ড. সিরাজুদ্দিন তাঁর পিএইচডি গবেষণায় এই অনালোচিত বিষয়ের ওপর আলো ফেলেন এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার স্বরূপ উন্মোচন করেন।
পিএইচডি গবেষণা চলাকালীন আলমগীর সিরাজুদ্দীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় লাহোর থেকে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে আগত লাহোর মহিলা কলেজের চারুকলার প্রভাষক এবং লন্ডনের হর্নজি আর্ট কলেজের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী আসমা হকের। ১৯৬৬ সালে তাঁরা পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। ইতোমধ্যে ড. সিরাজুদ্দিন লিঙ্কন্স ইন থেকে ‘বার এট ল’ ডিগ্রি সম্পন্ন করেন (১৯৬৭)। একই সময়ে আসমা হক (সিরাজুদ্দীন) ঝঙঅঝ- এর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। জ্ঞানচর্চা এবং ভালোবাসার এমন যুগলবন্দি ইতিহাসে বিরল।
১৯৬৯ সালে তাঁরা দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। আলমগীর সিরাজুদ্দীন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে যোগ দেন ঊর্ধ্বতন প্রভাষক হিসেবে। ড. আসমা সিরাজুদ্দীনও একই বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। তাঁর পাঠদানের প্রধান বিষয় ছিল- ‘মুসলিম চিত্রকলা ও স্থাপত্য’। শিক্ষকতা, গবেষণা আর গবেষণার প্রয়োজনে দেশ বিদেশ পরিভ্রমণে তাঁরা দু’জন ছিলেন দু’জনের অনুগামী সহযোগী সহযাত্রী। তাঁরা দু’জন এক দীর্ঘ আনন্দময় সৃষ্টিশীল বুদ্ধিবৃত্তিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ভালোবাসার অমর মহাকাব্য রচনা করেছেন মর্তের বুকে।
জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান বিতরণের পাশাপাশি শিক্ষা প্রশাসনেও অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন অধ্যাপক আলমগীর সিরাজুদ্দীন। শিক্ষকতা জীবনের প্রথমার্ধে আলাওল হলের প্রাধ্যক্ষ (১৯৭২-১৯৭৩), কলা অনুষদের ডিন (১৯৭৮-১৯৮০) ও বিভাগীয় সভাপতির (১৯৭৫-১৯৮০) দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৮৮ সালে তদানিন্তন উপাচার্য প্রফেসর মোহাম্মদ আলী পদত্যাগ করার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন অধ্যাপক সিরাজুদ্দিন। পরের বছর জুন মাসে সিনেট নির্বাচনে ৭২/৮১ ভোট পেয়ে চার বছরের জন্য উপাচার্য নির্বাচিত হন। কিন্তু ১৯৯১ সালের ৩১ ডিসেম্বর সরকারি হস্তক্ষেপে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তাঁর পরে আর কোন উপাচার্য নির্বাচনের মাধ্যমে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন নি, বরং সরকারী মনোনয়নের ভিত্তিতে নিযুক্ত হয়েছেন।
উপাচার্যের পদে ইস্তফা দিয়ে বিভাগে প্রত্যাবর্তন করেন অধ্যাপক সিরাজুদ্দীন। ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে এম. এ. ক্লাসের শিক্ষার্থী হিসেবে তাঁর শ্রেণীকক্ষে প্রবেশের সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। তাঁর পাঠদান পদ্ধতি, বিষয়বস্তু উপস্থাপন, প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ এবং বাচনভঙ্গীর জন্য দুই মহাযুদ্ধের অন্তর্বর্তীকালীন জটিল আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে সরল ও উপভোগ্য মনে হত ছাত্রছাত্রীদের কাছে। ওপরের ক্লাসের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জেনেছি- আন্তর্জাতিক আইনের মতো দুর্বোধ্য বিষয়ও তিনি কেমন মনোমুগ্ধকরভাবে উপস্থাপন করতেন। ৮ টা ৪৫ মিনিটের ক্লাশে কোনদিন ৮ টা ৪৬ মিনিটে প্রবেশ করেননি তিনি। তাঁর সম্পর্কে আরও জানা যায়- উপাচার্য ও বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব পালনকালে তিনি সকাল সাড়ে সাত টার মধ্যে দপ্তরে প্রবেশ করতেন, এবং দেরিতে আসা কর্মকর্তা কর্মচারীদের কাছ থেকে কৈফিয়ত তলব করতেন।
বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে অধ্যাপক সিরাজুদ্দীন অসংখ্য ফেলোশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কর্ম সম্পাদন করেন। ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবেও একাধিক দেশে ভ্রমণ করেন। দেশ বিদেশের খ্যাতনামা জার্নালে তাঁর প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা ত্রিশের অধিক। প্রকাশিত গ্রন্থ সাতটি, তন্মধ্যে তিনটিই প্রকাশিত হয়েছে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস হতে। তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু- বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, উপজাতি বিষয়ক শিক্ষা (ইনডিজেনাস স্টাডিজ), আইন ও মানবাধিকার, উচ্চশিক্ষা, শরিয়া আইন, সমাজ ও মুসলিম নারী ইত্যাদি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং ইংল্যান্ডের সাপ্তাহিক পত্রিকা দি গার্ডিয়ানের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শীর্ষক দুটি গ্রন্থ ছাপাখানায় আছে প্রকাশের অপেক্ষায়। এছাড়াও দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে তিনি অসংখ্য স্মারক বক্তৃতা ও সমাবর্তন বক্তৃতায় বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার সংকট ও সমাধান, আইন ব্যবস্থার সংস্কার, মানবিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, ইতিহাস পাঠের গুরুত্বসহ অনেক বিশ্লেষণধর্মী বক্তব্য উপস্থাপন করেন, যা দেশ ও জাতির অগ্রগতিতে মূল্যবান অবদান রাখতে পারে।
২০২১ সালের ২১ ডিসেম্বর প্রত্যূষে তাঁকে একা ফেলে পরলোক গমন করেন তাঁর দীর্ঘ ছয় দশকের পথচলার সঙ্গী অধ্যাপক আসমা সিরাজুদ্দীন। অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন স্যারের সুস্বাস্থ্য ও কর্মময় শতায়ুর জন্য আমাদের প্রার্থনা।

অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়