একটি মাস্কের আত্মজীবনী

আজগর আলী

আমি একটি মাস্ক। খুব সাধারণ। মূল্য পাঁচ টাকা মাত্র। আমাকে কেনার সময় এই পাঁচ টাকাও দিতে হয় না আমার খরিদ্দারকে। তিনি আমাকে কেনার সময় এমন দরাদরি শুরু করেন। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে হকার আমাকে ফ্রিতে দিয়ে দেয়। অবশ্যই রেগে গিয়ে হকার ‘হালার মাক্স কিনবার আইছে খানকির পুলাই’ বলে আমাকে ও আমার খরিদ্দারকে এমন দুটো গালি দিতে ছাড়ে না।
আমি যে সময়ের গল্প শুনাচ্ছি তখন করোনা মহামারি আসেনি। সারা দুনিয়ার সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। তখনো বাজারে আমার তেমন কোন চাহিদা ছিল না। আমাকে কেউ অতো ব্যবহার করতো না।
আমার যে খরিদ্দার তার আবার ফুসফুসে সমস্যা। সে কী একটা কাজে এসেছিল ধূলিবালির এ শহরে। মিয়াভাইয়ের কিছুক্ষণ হাঁটার পর হাঁপানি ওঠে গেল। কিন্তু কাজের কাজ এখনো কিছুই হয়নি। আর কোন উপায়ান্তর না পেয়ে তিনি আমাকে কিনে নিল। তাও ফ্রিতে, সেই কথা আগেই বলেছি।
শহরে সারাদিন এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করে, কাজ শেষ করে মিয়াভাই গ্রামে ফিরে এলেন। আমিও তার সাথে গ্রামে চলে এলাম। এই প্রথম আমার গ্রামে আসা। দলামোচা করে পকেট থেকে বের করে তিনি আমাকে ঘরের এক কোণে ফেলে রাখলেন।
হঠাৎ একদিন দেশে করোনা করোনা বলে হাঁকডাক শুরু হয়ে গেল। দিনকয়েক যেতে না যেতেই দেখি মাস্কপরা বাধ্যতামূলক ঘোষণা করা হলো। রাস্তাঘাটে আমাকে ছাড়া আর বেরও হওয়া যায় না। বাজারে বেড়ে গেল আমার বিপুল-বিশাল চাহিদা। বলতে বলতে আমার মূল্য হয়ে যায় আকাশচুম্বী। পাঁচ থেকে দশ, দশ থেকে পঞ্চাশ, পঞ্চাশ থেকে একশো!
আমি তো খুশিতে প্রায় নাচানাচি শুরু করেছি। কি থেকে হয়ে গেল। শেষমেশ আমাকে সাথে না রাখলে পুলিশের পিটুনি খেতে হচ্ছে …!
এদিকে বেশ কয়েকদিন ধরে মিয়াভাই আমাকে গরু খোঁজার মতো খুঁজতে শুরু করেছেন। ঘরের সাজানো- গোছানো সব জিনিশপত্র কয়েক দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার এলোমেলো করতে হলো মিয়াভাইইকে
এর মধ্যে বৌয়ের বকুনি-ঝকুনি খাওয়া হলো বারকয়েক। মিয়াভাইয়ের বৌ, মানে আমাদের ভাবি রাগ করে বাপের বাড়ি যাবার হুমকি দিয়েছেন অনেকবার। তবে এখনো যাননি। আমি তো ঘরের এককোণে বসে মিয়াভাইয়ের কা-কারখানা দেখছি। আর সবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে হাজির। আমাকে খুঁজে পাওয়া গেল। আমাকে পেয়ে তো মিয়াভাই খুশিতে লাফালাফি শুরু করে দেন। যেন তিনি কলম্বাসের মতো কোন নতুন দেশ আবিষ্কার করেছেন। আরেকটু হলে পরনের লুঙ্গি খুলে যাওয়ার মতো অবস্থা।
এসব দেখে দেখে মিয়াভাইয়ের বৌ তো মহাবিরক্ত। এদিকে করোনা ভয়ে জানবাঁচানো নিয়ে টানাটানি। আর, এ হলো ঘরের অবস্থা। কাজকর্ম বাদ দিয়ে মিয়াভাই খুঁজে বেড়াচ্ছে একটা মাস্ক, পাঁচ টাকা মূল্যের মাস্ক। কিন্তু অনেকে জানেন না, বাজারে এখন আমার ব্যাপক চাহিদা!
রাত নাই, দিন নাই মিয়াভাই আমাকে মুখে পরে বসে থাকেন। যেখানে যান আমাকে সাথে নিয়ে যান। ঘুমাতে গেলেও আমাকে মুখে রেখেই ঘুমান। মিয়াভাইয়ের এসব কর্মকা-ের খরব অতি দ্রুত এলাকায় ছড়িয়ে পড়লো।
অবশ্য তখনো গ্রাম-গঞ্জে আমার মতো সামান্য মাস্ক নিয়ে লোকজনের মধ্যে তেমন একটা আগ্রহ দেখি নাই। তবে দ্রুত অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। গ্রামে মোটামুটি সব দোকানপাটে আমাকে পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে কিছু অতিউৎসাহী ব্যবসায়ী আমাকে নিয়ে দু’নম্বরি কাজ-কারবার শুরু করে দিয়েছে।
দ্রুত করোনা বাড়ছে। আর বাড়ছে আমার চাহিদা। হঠাৎ করে বাজারে আমার অভাব দেখা দিলো। খেয়াল করলাম, মিয়াভাইয়ের বাড়িতে আমার খাতির-যতœ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। পরিবারের অন্য সদস্যরা এতদিনে আমার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছেন। মিয়াভাইয়ের কাছে আমি থাকাতে তারা মনে করছে, মাস্ক তো নয় যেন সাতরাজার ধন মানিকমুক্তো আছে তার কাছে।
এত আনন্দের মধ্যেও আমি মিয়াভাইয়ের অতি যতেœর অত্যাচারে প্রায় হাঁপিয়ে উঠেছি। প্রতিদিন তিনবার করে আমাকে গোসল করানো হয় ব্ল্যাক শাইন শ্যাম্পু দিয়ে। তারপর আমার গায়ে মাখানো হয় সৌদি আরব থেকে আসা অতি সুঘ্রাণযুক্ত এক আতর।
এই বেকুবকে কে বুঝাবে আমি ওয়ান টাইম মাস্ক। আমাকে একবারের অধিক ব্যবহার করা যায় না। সে কিনা আমার ওপর তিনবার ‘প্রাত্যহিক ধৌতকরণ কার্যক্রম পরিচালনা করিতেছে’
মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে, এ মিয়াভাই ব্যাটারে কান ধরে দুটো থাপ্পড় দিয়ে বলি, আরে গাধা আমি একটা সামান্য মাস্ক। আমাকে নিয়ে এতো লাফালাফির কিছু নাই। কিন্তু কে শুনে কার কথা!
আমিও করোনাকালীন সেলিব্রিটি হয়ে গেছি। এখন কে দেখে আমার এই সেলিব্রিটি হওয়ার কি যে ভোগান্তি!
এর মধ্যে আরেকটা অঘটন ঘটে গেল। আমাকে অপহরণ করা হলো। আমাকে হারিয়ে তো মিয়াভাইয়ের যা-তা অবস্থা। তিনি পাগলের মতো আমাকে খুঁজতে শুরু করলেন।
আমি আছি আমার নতুন মালিকের সাথে।
তার সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেওয়া যাক। আমার নতুন মালিক এক উর্বশী রমণী। এমন সুন্দরী মেয়ে আমি প্রথম দেখেছি। যাকে বলে দুধে-আলতার মতো গায়ের রং। এই সুন্দরী সম্পর্কে মিয়া ভাইয়ের শালি। সে এ বছর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবে। কিন্তু করোনার জন্য সেটা আর দিতে পারছে না। পড়ালেখা করতে হচ্ছে না বলে সে এ দীর্ঘ অবসরে নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ অকাজ করে বেড়াচ্ছে। এই যেমন এ সুন্দরী আরেকটা অসাধারণ কাজে হাত দিয়েছে। সে তার প্রেমের জাদুতে এলাকার সমস্ত ছেলেকে পাগল করে ছাড়বেÑ এমন এক মহান অভিযানে নেমেছে।
এ যে আমাকে চুরি করে, মিয়াভাইকে জব্দ করার প্ল্যানিংটা ওই প্রিয়দর্শিনী রমণীর। সেই যাই হোক। আমি অবশ্যই এ সুন্দরীর সঙ্গে দারুণ সময় কাটাচ্ছি। সেই আমাকে যতœ করে এক জায়গায় রেখে দিয়েছে। মুখে পরছে না। মিয়াভাইয়ের মতো শ্যাম্পু দিয়ে গোসল দিচ্ছে না। বলতে গেলে, আমি একপ্রকার ভালোই আছি।
সামান্য একটা মাস্ক। আর তাকে নিয়ে কত ট্রাজেডি! করোনা বাড়ছে। সমানতালে বাড়ছে আমার চাহিদা। এখন যেখানে-সেখানেই আমাকে পাওয়া যাচ্ছে। মাঠে ঘাটে নদীতে পুকুরে নালায়। আরও কত জায়গায়।
আমি মাস্ক, ব্যবহার শেষে পড়ে থাকি অযতেœ, অবহেলায়।
এ হলো আমার অল্প আয়ুর স্বল্পজীবন-গল্প।