অধরা

অরূপ পালিত

নিলয় কানে-কানে বলল, কাজল চোখ দুটো মুছে নাও। ভাই-ভাবী এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার আমাদের খেয়াল করেছে। উনারা কিছু মনে করতে পারেন।
মনে করলে আমার কিছুই যায় আসে না। আমি কাউকে ভয় করি না।
পাগলামি হচ্ছে না। এই বলে নিলয় কাজলের পাশ থেকে দূরে সরে বসল।
মাদুরাই বিমানবন্দরে কাজলকে বিদায় দিতে নিলয়ের অনেক বন্ধু এসেছে।
অযাচিতভাবে নিলয় কাজলকে শুধু একবার মুখের ওপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিতে আস্তে করে ফুঁ দিয়ে ছুঁয়ে দিল।
কাজলের দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল ঝরনার স্রোতধারা। বিষাদের ছায়া চোখে-মুখে। কাজল শক্ত করে নিলয়ের হাত ধরে রেখেছে। কাজলের ছটফট করতে থাকা দেখলে যে কেউ সন্দেহ করবে। দুমাসের ভেতরে দুজনের মধ্যে অনেক কিছু হয়ে গেছে।
নিলয় লেখাপড়া করছে ভারতের মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজে। বাংলাদেশ থেকে যাবার পথে বেনাপোল সীমান্তে কাজলের পরিবারের সাথে ওর দেখা। কথায় কথায় কাজলের বড়ভাই ব্রেইনের চিকিৎসা কোথায় ভালো হবে জানতে চাইলে নিলয় মাদ্রাজের মেডিকেলের নাম বলে।বড়ভাই মুনশী হতাশ হয়ে বলেন, ভাই আমার ওইখানে পরিচিত কেউ নেই। কিভাবে যাবো?
ভাইয়া আপনি কোন চিন্তা করবেন না। যদি বিশ্বাস করেন, আমার সাথে চলেন। আমি সেই মেডিকেলে লেখাপড়া করি।
মুনশীর মুখে অসাধারণ একটি হাসি ফুটে উঠলো। পরিবারের সবাইকে বললেন। তোমরা সবাই আল্লাহকে ডাকো।
আপনাদের আমি কলকাতা শিয়ালদহ স্টেশন থেকে টিকিট কেটে দিচ্ছি। আমার তো আগের থেকেই এয়ারের টিকিট কাটা আছে।
মুনশী মিয়া একবার এয়ারে যাবার সাহস দেখালে বউ নুপুর বললো, তোমার একবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে না। বিমানে যাওয়া যাবে না। কাজলের শরীরও ভালো নেই। আমরা বাই রোডে যাবো। কাজলকে দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না ওর এতবড় রোগ হয়েছে।
বাংলাদেশে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। সবাই নিশ্চিত হয়েছে ব্রেইন টিউমার। অপারেশন করতে বিশ লক্ষ টাকা লাগবে। তবে অপারেশন টেবিল থেকে ফিরে আসবে কি না সেই নিশ্চিয়তা কেউ দেয় না।
নিলয় ওদের ট্রেনের টিকিট কেটে দিয়ে মাদ্রাজে চলে গেল।
কাজল ভাবী কে বলে, ভাবী আমার তো ছেলেটাকে বিশ্বাস হচ্ছে না। তোমরা ওকে এত সহজে বিশ্বাস করলে?
না করে তো কোনো উপায় নেই। ছেলেটা যদি ফেক হতো তাহলে তোর রিপোর্টগুলো মোবাইলে ছবি তুলে নিতো না।
আরে ভাবী আমার মতো সুন্দরী মেয়ে দেখলে অনেকেই তোমাকে সাহায্য করতে আসবে।
ভাবী একটু অগোছালো দুষ্টু হাসি দিয়ে বললো, তাহলে তো ভালো। তোর ভাইকে ছেড়ে দিয়ে এখান থেকে একটাকে বেছে নিতাম।
সত্যি অবিশ্বাস্য, ট্রেন থেকে নেমে দেখে নিলয় ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সবাই বিস্ময়ে হতবাক।
মুনশী মিয়ার উদ্দেশে নিলয় বলে, দাদাভাই, এই দেশ বাঙালির জন্য বিদেশ। বিদেশে বাঙালিরা ভাই-ভাই।
মুনশী মিয়াকে মেডিকেলের পাশে একটি বাড়িতে রুম ভাড়া করে দেয় নিলয়।
ভাইয়া, আপনাদের আর্থিক অবস্থা কেমন আমি জানি না। এখানে চিকিৎসা করাতে যারা আসে, সবাই এ রকম কম খরচে থাকে। আপনার কি আপত্তি আছে?
মুনশী মিয়া নিলয়কে বুকের মধ্যে জড়িয়ে কেঁদে ফেললেন।
সত্যি কোন্ জন্মে ভাই ছিলি রে তুই।
আপনারা এক ঘণ্টা পরে মেডিকেলে চলে আসেন। আমি সবকিছু ঠিক করে রেখেছি।
মুনশী মিয়ারা সেদিন ডাক্তার দেখাতে পারলেও বোন কাজলকে আর ডাক্তার দেখাতে পারেনি। চারদিন পর সিরিয়াল পড়াতে। বড়ভাই মুনশী মিয়ার সব ডাক্তার দেখানো হয়ে গেছে। মুনশী মিয়ার অপারেশন লাগবে না। ওষুধে সেরে যাবে শুনে সৃষ্টিকর্তার কাছে নিলয়ের জন্য দোয়া করলেন। নিলয়ের পরীক্ষা থাকাতে কাজলকে ডাক্তার দেখানোর সময় থাকতে পারেনি।

ডাক্তারের কথায় ভেঙে পড়েছে পরিবারের সবাই।
নিলয় সন্ধ্যার সময় বাসায় গিয়ে দেখে, কেঁদে সবার চোখ-মুখ ফুলে লাল হয়ে গেছে। মুনশী নিলয়কে বাইরে নিয়ে দুহাত ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। বংশের একমাত্র মেয়ে। তা আবার মা-বাবা নেই। ছোট থেকে মেয়ের আদরে মানুষ করেছেন। ও না থাকলে আমি থেকে লাভ কি বলো।
মুনশীর কথায় নিলয়ের চোখ ছলছল করছে। এমন সুন্দরী মেয়েকে চোখের সামনে হারাতে হবে। মনে মনে কত কিনা ভেবে রেখেছে। আকাশ ভারী হয়ে আসছে মুনশীর গুমরানো কান্নায়।
ভাইয়া আপনি আগে বলেন ডাক্তার কি কি বলেছেন?
ডাক্তার দুটি টেস্ট দিয়েছেন। ডাক্তার সব কথা হিন্দিতে বলেছেন। বাঙালি একজন বলেছেন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
নিলয় কাজলের টেস্টের নাম্বার নিয়ে বের হবে। এমন সময় কাজলের চোখে চোখ পড়াতে দেখে মেয়েটির মুখের ওপর বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে। ফ্যাল ফ্যাল করে নিলয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। নিলয় হেসে বলে, এখানে কেমন লাগছে আপনার। আমার সাথে কালকে এখানের ওটারওয়ার্ল্ড দেখতে যাবেন?
কিছু না বলে কাজল মুখ ঘুরিয়ে নিল।
আপনি কি আমাকে কম পছন্দ করেন?
এ কথা কেন বলছেন।
এই যে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।
আপনারা ডাক্তাররা পাষাণ।
কেন বললেন এ কথা। আর আমি তো ডাক্তার না। মাত্র থার্ড ইয়ারের ছাত্র।
কাজল কথা না বাড়িয়ে বলল, আপনার কি মনে হয় আমার আয়ু আর বেশিদিন আছে?
নিলয় হেসে বলল, আপনি আমার থেকে আরো আশি বছর বেশি বাঁচবেন।
নিলয় খুব সকালে কাজলকে একা নিয়ে প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে গিয়ে রিপোর্টের কপিগুলো ল্যাপটপ থেকে দেখালেন। একটি হাসি দিয়ে স্যার বলল,
তোমার কি হয়?
স্যার ঘনিষ্ঠজন, বন্ধুর ছোটবোন।
ছোট একটি অপারেশন করতে হবে। কালরাতে প্রফেসর ডেভিড আমার কাছে রিপোর্টগুলো মোবাইলে এসএমএস করেছিলেন। সময়ের অভাবে দেখার সুযোগ হয়নি।
নিলয়, তুমি একটা কাজ করো। আজ রোবার সবকিছু বন্ধ। কাল ওকে কলেজে নিয়ে এসো। সব স্টুডেন্টকে থাকতে বলো।
নিলয় ঘাবড়ে গিয়ে বলল, স্যার এনি থিং রং?
নো নো এভিথিং ইজ ওকে।
স্যার ওর প্রচ- মাথাব্যথা কেন?
কালকে কলেজে নিয়ে এসো। সবকিছু জানতে পারবে। স্যার দুষ্টমি করে নিলয়কে বললেন।
এই নিলয়, সুন্দরী বান্ধবী পোয়ে পরীক্ষা খারাপ করো না।
নিলয় লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে বললো, ঠিক আছে স্যার। কাল তো আমার পরীক্ষা আছে স্যার।
অসুবিধা নেই। তুমি সকাল নয়টার দিকে নিয়ে এসো। এখানে ওকে দিয়ে পরীক্ষা দিতে দিতে যেও।
সকালে কি অপারেশন?
না। ওকে নিয়ে আমি একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করবো। এ রকম কেসস্টাডি করা অনেক ভাগ্যের ব্যাপার।
নিলয়ের মন কাজলের জন্য বেশ ছটফট করছে।
পরীক্ষা দিতে যাবার সময় নিলয় কাজলকে বললো,তুমি আমার ধর্মে জন্ম নিলে না কেন?
নিলয়ের প্রশ্নের উত্তরে হতবাক কাজল। তবুও বললো, আমার মৃত্যুর পর কবরে গিয়ে বসে বসে কাঁদতে!
নিলয় অপ্রস্তুতভাবে কাজলের মুখ হাতে চেপে ধরে।
কাজল ভালোবাসা কি জানে না। নিলয়ের হাত দুটো নিয়ে বলল, আমাকে বাঁচাও। আমি তোমার জন্য বাঁচতে চাই।
নিলয়ের মনে হচ্ছে এখনই মেয়েটাকে জড়িয়ে নিতে। পিছুটান বলতে ধর্মের বন্ধন। নিলয় যখন ডাক্তারের রুম থেকে বের হবে, পেছন থেকে কাজল এসে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে।

আমি তোমাকে দেখার পর থেকে আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কোন ভণিতা নয়, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি কোনো জাতকুল মানি না।
পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়ার পর সব ছাত্রছাত্রী হাজির। প্রিন্সিপাল স্যার কাজলকে নিয়ে বসে আছেন। সব ডাক্তারকে একসাথে দেখে কাজলও ঘাবড়ে গেল।
কাজল নিলয়কে দেখার পর ভয়ে সবার সামনে নিলয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সবাই হো হো করে হেসে ওঠে।
প্রিন্সিপাল স্যার কাজলের মাথায় যন্ত্রণাটি কেন হচ্ছে, কোথায় এর উৎপত্তিস্থল সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করলেন।
একজন নবীন ডাক্তার বললো, স্যার রোগীর আগের এমআরআই রিপোর্ট, কালকের এমআরআই রিপোর্ট সেইম। মাথার মধ্যে একটি কালো কি যেন টিউমারের মতো ঢেকে রেখেছে। অপারেশন না করলে বুঝবেন কি করে স্যার।
প্রিন্সিপাল স্যার সবাইকে বলেন, ওই কালো অংশটি হচ্ছে দুটি রগ। ও দিনে না হলেও ১০০টির ওপরে হাঁচি দেয়। হাঁচি দিলে ওঁর প্রচ- মাথাব্যথা হয়। সে কারণে মাথার রগগুলো ফুলে যায়।
স্যার তা হলে রোগীর রোগ কী?
প্রথম হচ্ছে মানসিক চাপ। সে যখন ডাক্তারের কাছে প্রতিনিয়ত যাচ্ছে, ওর মনে মনে ভয় কাজ করছে। ডাক্তার কি বলবেন। আমরা ডাক্তারদের তো রোগীদের সাথে তাদের রোগ নিয়ে আলোচনা করার সময় নেই। যত রোগী বেশি দেখবো, ততো টাকা আসবে। তাই রোগীর সাথে সময় নষ্ট করার দরকার কি? মূলত এই কেশবতীকন্যার কেশই হলো ওর রোগের কারণ।
সবাই থমকে যায়।
প্রথমে নিলয়কে কাজলের নাকের ভেতর দেখতে বলেন। নিলয়সহ অনেক ছাত্রছাত্রীকে কাজলকে দেখানো হলো। কেউ কিছু দেখতে পায়নি।
প্রফেসর ডেভিড ব্যাখ্যা দেন, নাকের ভেতর দিয়ে মাথায় একটি লম্বা চুল ওপরে ওঠে গেছে। সেটি মাথার দিকে আঘাত করছে। সেখান থেকে ওর যন্ত্রণা। আর মেয়েটির সাইনোসাইটিসও আছে।
নিলয়কে সঙ্গে নিয়ে ডাক্তার অপারেশন টেবিলে গেলেন। এক ঘণ্টা পর ফিরে এসে যে নমুনা ডেভিড স্যার সবাইকে দেখালেন, সবাই অবাক হয়ে যায়। নাকের ভেতর এত বড় লম্বা চুল কিভাবে হয়।
সবার কাছে কাজল যেন আদরের হয়ে গেছে। নিলয়ের নাম বদলে গেছে। ঠাট্টা করে নিলয়কে নায়ক অজয় বলে ডাকছে সবাই। অল্পখরচে সবকিছু হবার পর কাজলের ভাবী নিলয়কে ডেকে বলেন, দু-একদিনের মধ্যে আমরা দেশে ফিরে যাবো। আমি তোমাকে আমার ধর্ম মেনে ভাই হিসেবে মেনে নিয়েছি। কারণ আমার কোনো ভাই নেই। আর ভাইবোনের সম্পর্কের মধ্যে কোন ধর্ম বা জাত লাগে না। আমি তোমাকে কিছু দিয়ে ছোট করবো না। বড়বোন হিসাবে তুমি আমার থেকে কিছু আবদার করলে খুশি হবো।
অবশ্য দিভাই তোমার কাছে আমি এমন কিছু চাইবো, সেদিন ফিরিয়ে দিও না।
এখন বল।
এখনো সময় হয়নি। পরীক্ষার পর ঢাকায় গিয়ে একবারে তোমার বুক থেকে টেনে নিয়ে আসবো। নিলয়ের কথার মানে নূপুর বুঝেও না বোঝার ভান করে বললেন, যতদিন বেঁচে থাকবো আমরা সবাই তোমার কথা স্মরণ রাখবো। দেশে গেলে আমার দাবি, বোনটিকে আগে দেখে যাবে। একটি কথা বলি ভাই। কাজল আমার মেয়ের মতো। ওর কোন কিছুতেই আমি বাধা দিইনি। কাল রাতে আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলেছে সে তোমাকে ভালোবাসে। জানি না তোমার মনে ওর জন্য জায়গা কতটুকু। মনে হয় পাগলী মেয়েটা অসুস্থ অবস্থায় যতটা কষ্ট পায়নি, এবার পাবে।
আজকে থেকে আমি তোমাকে দিভাই বলে ডাকবো। আর তুমি আমার নাম ধরে ডাকবে।
মুনশী মিয়ার আবেদন একটা কিছু কিনে দেবেন। নিলয় রাজি হয় না। কাজলকে উদ্দেশ করে ভাবী বললেন, কাজল, আমার ভাইটাকে নিয়ে মার্কেটিং করে আয়।
কাজল নিলয়কে একা পেয়ে অটোতে জড়িয়ে ধরে।
তোমার কি লাজলজ্জা হচ্ছে না।
ভালোবাসার মানুষের কাছে লজ্জার কিছু নাই।

আইসক্রিম খাবে। নানা ফ্লেভারের আইসক্রিম পাওয়া যায়। জানো এখানের সব চাইতে মজার আইসক্রিম ‘ইসবকুল কাজু আঞ্জির’।
তুমি আগে আমার শর্তপূরণ করো। তারপর খাবো।
কি কি শর্তপূরণ করতে হবে জান।
ঘুমুনোর আগে প্রতিদিন একবার ফোন করে বলবে, জান কোথায়? সব সময় নেটওয়ার্কের ভেতরে থাকবে। পড়াশোনায় কোন গাফিলতি করবে না।
আমি তোমার জন্য চট্টগ্রাম যাবো। মাকে একবার দেখে আসবো।
সব ঠিক আছে। এবার গাড়ি থেকে নামো।
না, আজকে থেকে আমার চেহারায় পর্দা থাকবে। তোমাকে ছাড়া আর কাউকে এ মুখ দেখাবো না। আমাকে তুমি একটা বোরকা কিনে দেবে।
নিলয় কাজলের কথা শুনে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, পাগলী তোমার যা ইচ্ছে।
কাজলের পছন্দ আছে। গোলাপি রঙের পাতলা দুটি শার্ট এবং দুটি গেঞ্জি কিনে দেয় নিলয়কে। নিলয়ের সহজ-সরল স্বীকারোক্তি, কাজল তোমাকে আমি তোমার পছন্দ মতো কিছু কিনে দিতে পারবো না। আমি এখানে খুব কষ্ট করে চলি। একটি পারফিউম এবং একটি বোরকা কিনে দিলাম। বাংলাদেশে যাবার সময় তোমার জন্য অনেক কিছু নেব।
কাজলের কাছে নিলয়ের কথাগুলো এত মনে ধরেছেÑ ছলছল চোখে বললো, তোমাকে ছাড়া আমার আর কিছুর প্রয়োজন নেই। সত্যি আমি কোনো জন্মে পুণ্য করে এসেছি। তাই তোমার মতো একজন ভালো মানুষের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছি।
তোমরা কি সত্যি কাল চলে যাবে ?
তোমার কাছে আরো কিছুদিন থাকতে ইচ্ছে করে।
আমার কাছে তোমাকে রাখার মতো এখনো সামর্থ্য হয়নি। হলে বলতে হতো না। ইচ্ছে করছে তোমাকে বুকের মধ্যে রেখে সমুদ্রের গর্জন শোনাতে। যদি পারতাম, কোলে করে নিয়ে বরফের পাহাড়ের নিয়ে ছেড়ে দিতাম। তুমি শীতল হয়ে আমার বুকের মাঝে উষ্ণতা অনুভব করার জন্য ছটফট করতে থাকতে। আমি হাত বাড়িয়ে দিতাম। বাংলাদেশে গেলে তুমি আমার সাথে পাহাড় দেখতে যাবে।
না।
কেন?
এই যে তুমি আমাকে বরফের মধ্যে কোল থেকে ফেলে দেবে বললে।
তোমাকে নিয়ে সাজেক যাবো। সেখানে কুয়াশামাখা সবুজঘাসের ওপর হাঁটব। হাঁচি ওঠার আগেই তোমার পা দুটো আমার জামা খুলে জড়িয়ে দেব।
নিলয়ের কথাগুলো শুনে কাজল অঝোরে কাঁদে।
বিদায় নিতে হয়েছে কাজলের পরিবারকে। মাদ্রাজ মেডিকেল থেকে সকালে কাজলকে উইশ করার জন্য অনেক ছাত্রছাত্রী আসে। নিলয়কে অনেক ছাত্র মুখের ওপর বললো, ওকে তুই হাতছাড়া করিস না। না হয় পরে পাগল হয়ে যাবি।
কাজল নিলয়ের বন্ধুদের এমন ভালোবাসা দেখে কেঁদে ফেলল। অনেক মেয়ে কাজলকে সান্ত¡না দিয়ে বললো, তোমার আমানত তোমার কাছে পাঠিয়ে দেবো। এখানে রাখবো না।
নিলয় আর কাজলের প্রতিদিন একবার করে কথা হয়। দুবছর পর নিলয় আসছে। এয়ারপোর্টে সকাল দশটায় চলে এসেছে কাজল। নীল শাড়ি আর নীল টিপে দারুণ মানিয়েছে ওকে। অনেক দিন পর এমন খুশি দেখে ভাবী একবার ঠাট্টার ছলে বলে ফেললেন, ও ননদি আমার ভাইটাকে নিয়ে পালিয়ে যাস নে।
অনেক ফ্লাইট আসছে-যাচ্ছে। কিন্তু নিলয়ের ফ্লাইটেরদেখা নেই।সন্ধ্যা নামতেই খবর আসছে টিভির হেডলাইনে বোয়িং ৭৩৭ বিমানটি ঝড়ের কবলে পড়ে ভারত মহাসাগরের বুকে মিশে গেছে। একজন যাত্রীও বেঁচে নেই।
কাজল সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। ভাই-ভাবী গিয়ে কাজলকে নিয়ে আসে। কিন্তু বেশিক্ষণ ঘরে আটকে রাখা যায় না। সুযোগ পেলে ঘর থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে গিয়ে যাত্রীদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, সেই একই জায়গায়। চোখের কোণে জল গড়িয়ে কালো হয়ে গেছে। পরনে সেই নীল শাড়িটি। আঁচল টেনে যখন চোখ মোছে, আঁচলও যেন কেঁদে ওঠে।