বর্ণিল ইতিহাসের রেল : সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত হোক

খন রঞ্জন রায় »
আজ ১৫ নভেম্বর রবিবার বাংলাদেশ রেলওয়ের ১৫৮ তম জন্মদিন। জন্মবার্ষিকীর এই আনন্দঘন বর্ণিল দিনে রেলের সকল কুশীলবদের জানাই আন্তরিক অভিনন্দন। রেলের যাত্রা শুরু হয়েছিল ইংল্যান্ডে ১৮২৫ সালে। ভারতীয় উপমহাদেশে আসতে ১৯ বছর লেগেছিল। ১৮৪৪ সালে পশ্চিম বাংলার হাওড়া থেকে রানীগঞ্জ শহর পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ শুরু করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি। আর রেলগাড়ির ঝমাঝম শব্দ এই বাংলার মানুষ শুনেছিল আরো পরে। সেটা ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর। এদিন দর্শনা থেকে জগতী পর্যন্ত ৫৩ দশমিক ১১ কিলোমিটার রেললাইন উদ্বোধন করা হয়। কুষ্টিয়ার ‘জগতী’ হয় বাংলাদেশের প্রথম রেলস্টেশন। সবচেয়ে প্রাচীন যোগাযোগ ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে টিকে থাকা রেলগাড়ির বিবর্তনের ইতিহাস বেশ রোমাঞ্চকর। ধীরে ধীরে আধুনিকায়ন হয়েছে রেলগাড়ির। রেলগাড়ি অনেকের কাছে ট্রেন নামেই বেশি পরিচিত। ট্রেন শব্দটি এসেছে প্রাচীন ফরাসি শব্দ ট্রাহিনার থেকে। শুরুর দিকে ট্রেনগুলো ছিল ঘোড়াটানা। পরবর্তীতে রেল ইঞ্জিনের ব্যবহারের পাশাপাশি রেললাইন স্থাপন করার পর রেলগাড়ি বর্তমান রূপ পায়।
ঊনবিংশ শতকের প্রথম ভাগ থেকে প্রায় সব ধরনের রেলগাড়ি বাষ্পীয় ইঞ্জিনের সাহায্যে চালিত হতে শুরু করে। ১৯২০ সালের প্রথম ভাগ থেকে শুরু হয় ডিজেল ইঞ্জিন ও বৈদ্যুতিক ইঞ্জিনের ব্যবহার। বাষ্পীয় ইঞ্জিনের চেয়ে এ ধরনের ইঞ্জিন অনেক কম পরিবেশ দূষণ করে, এ ছাড়া এগুলো চালাতে লোকবলও কম লাগে। ১৯৭০ এর দশক নাগাদ প্রায় সব দেশেই বাষ্পীয় ইঞ্জিনের ব্যবহার উঠে যায়। তবে সস্তা কয়লা ও জনশক্তির দেশ, যেমন চীনে এখনো বাষ্পীয় রেল ইঞ্জিনের ব্যবহার আছে। স্থল পরিবহনের অপরিহার্য মাধ্যম হিসেবে উপমহাদেশে রেলওয়ের প্রবর্তন এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে এর সম্প্রসারণ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ আর্থসামাজিক বিবর্তনের জন্য রেলওয়ে এক মাইলফলক।
রেল একটি আরামদায়ক পরিবহন ব্যবস্থা। এর লাইনগুলো সাধারণত মসৃণ। যে কারণে যাতায়াতে ঝাঁকি কম লাগে। একটি স্টেশনে এসে নির্দিষ্ট পরিমাণ সময় অপেক্ষা করে যাত্রী এবং মালামাল ওঠানামা করার জন্য। যে কারণে বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী, শিশু, মহিলাসহ সর্বস্তরের মানুষ নির্বিঘেœ যাতায়াত করতে পারে। কালের পরিক্রমায় ব্রিটিশ শাসনামলের ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে ইস্ট পাকিস্তান রেলওয়ে এবং অবশেষে বাংলাদেশ রেলওয়েতে পরিণত হয়েছে। রেলওয়ে বোর্ড ভেঙ্গে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের আওতায় রেলওয়ে বিভাগ ডিভিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশ রেলওয়েকে পূর্বাঞ্চল (চট্টগ্রাম) ও পশ্চিমাঞ্চল (রাজশাহী) দুই ভাগে ভাগ করা হয়। ৪ ডিসেম্বর ২০১১ যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ভেঙ্গে পৃথক রেলপথ মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়।
বর্তমান বিশ্বের একমাত্র শাটল ট্রেন সমৃদ্ধ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমান পৃথিবীর আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সার্ভিস নেই। আগে একটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকো ইউনিভার্সিটিতে। তবে এখন সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে মানুষ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত নিজেকে পেছনে ফেলার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে সবাই। সময়কে পেছনে ফেলতে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অসাধারণ সমন্বয়ে এসেছে নিত্য নতুন দ্রুতগামী ট্রেন। যত দিন যাচ্ছে আরও উন্নত হচ্ছে এসব ট্রেন। দ্রুতগামী ট্রেন আবিষ্কারে এগিয়ে আছে জাপান ও চীন। ঘন্টায় ৩৫০ কিলোমিটার গতির সর্বাধুনিক ট্রেন, ভূগর্ভস্থ ট্রেন, পাতাললাইন, মেট্টোট্রেন এখন আকাক্সক্ষা টিউব ট্রেনের। বায়ুশূন্য টিউবের ভেতর দিয়ে দ্রুতগতির এই ট্রেন হাতছানি দিচ্ছে। অথচ বাংলাদেশে চলছে ধুকেধুকে, ঢিমেতালে, ঢিলাঢালায়। লাভজনক এই সরকারি প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন থেকে লোকসান গুনতে গুনতে ঋণে জর্জরিত।
আমাদের শৈশব কেটেছে যে ট্রেন ও লাইন চড়ে, সেসমস্ত অনেক পথ বন্ধ হয়েছে। আন্তর্জাতিক চক্রের খপ্পরে পড়ে বাস চলাচলের রাস্তা বানানো হয়েছে। পরিত্যক্ত রেলস্টেশন নিয়েতো প্রায় প্রতিদিন পত্রিকায় বেদনার খবর দেখি। বর্তমানে দেশে মোট রেলপথের পরিমাণ দুই হাজার ৮৩৫ কিলোমিটার। রেলওয়ের চালক ও সহকারী চালকের পদ রয়েছে এক হাজার ৭৮২। দুই পদে কর্মরত আছেন এক হাজার ১১২ জন। দীর্ঘদিন ধরে লোকোমাস্টার নিয়োগ বন্ধ থাকায় নতুন করে চালকও সৃষ্টি হচ্ছে না পূর্ব এবং পশ্চিম অঞ্চলে। তীব্র চালক সংকট এড়াতে আড়াই বছর আগে থেকে শুরু হয় চুক্তিভিত্তিক লোকোমাস্টার নিয়োগ প্রক্রিয়া। অবসরে যাওয়া লোকোমাস্টারদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিচ্ছে রেলওয়ের পরিবহন ও মেকানিক্যাল বিভাগ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রেলওয়ের জনবল কাঠামো অনুসরণ করে এলওবি প্রণয়ন করে দেয় এডিবি। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) রেলের জনবল কাঠামো ও কর্মপরিধি সংশোধন করে লাইন অব বিজনেস (এলওবি) বাস্তবায়নের পরামর্শ দিলেও তাতে অগ্রগতি নেই। এখনো আগের কাঠামোতেই চলছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। বিদ্যমান কাঠামোর সংস্কার ও আধুনিকায়নের অংশ হিসেবেই বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছিল এডিবি। ২০০৬ সালে জুলাইয়ে সংস্কার প্রকল্প গ্রহণও করে রেলওয়ে। এজন্য ২০১ কোটি টাকা (৩ কোটি ডলার) ঋণ দেয় এডিবি। এলওবি বাস্তবায়নের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন প্রকল্পে তিন কিস্তিতে আরো ২০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সংস্থাটি।
ভুলে গেছে চলবে না, সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। সময়ের যাবতীয় সমীকরণ জীবিতদের জন্যই। মরণের ওপারে যারা চলে যান তাদের কাছে সময়ের হিসাবের কোনো মূল্য নেই। যতক্ষণ এই শরীরে জীবন প্রবহমান, ততক্ষণ সময়ের সাথে প্রতিটি কাজ সম্পন্ন করার তাগিদ থাকবে। আবার প্রতিটি জীবনই বহুমাত্রিক, ভারসাম্যপূর্ণ এক একটি চৈতন্যচালিত পদ্ধতি-সমষ্টির সমাহার। সর্বোপরি মানুষ বিবেকতাড়িত। সুতরাং জীবনকে রক্ষা করে ভোগ, উপভোগের বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। রেল পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও একই কথা। প্রতিশ্রুতি আর উদ্যোগ আয়োজনে আটকে থাকলে এর সুফল ভোগ থেকে বঞ্চিত হবে একটি পুরো প্রজন্ম।
বর্তমান প্রেক্ষপট বিবেচনা করে রেল ব্যবস্থাপনাকে আরো আধুনিক ও সময়োপযোগী করতে হবে। অবকাঠামোগত রূপান্তরের পাশাপাশি বাড়াতে হবে সৃজনশীলতা। অনিয়ম, অবহেলা, দায়িত্বহীনতা কাটিয়ে ঝুঁকিমুক্ত রেলওয়ে ব্যবস্থাপনা যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন রেলকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। যাত্রীবান্ধব করার জন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তির সম্মিলন ঘটাচ্ছে। চাকুরিরতদের সর্বাধুনিক জ্ঞান চর্চার সুযোগ উন্মুক্ত করছে। শিক্ষা-প্রশিক্ষণ, পরিচর্চাখাতকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। বর্তমান সরকারের আমলে রেলের উন্নয়নে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। আরো কিছু প্রকল্পের সমীক্ষা চলছে। অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশও রেলের অবকাঠামোগত সুবিধাদি নির্মাণের বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করছে। রেলের সাথে জড়িয়ে আছে রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ। আমাদের দেশে বড় রেল স্টেশন, জংশন নিয়ে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট শহর, গঞ্জ। সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে, নাটকে ট্রেন বড়ো জায়গা নিয়ে আছে। ক্রীড়া ও বিনোদনের ক্ষেত্রে রেলের কর্মকর্তাÑকর্মচারীরা প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছেন। চট্টগ্রাম রেল হেড কোয়ার্টারে সমৃদ্ধ পাঠাগার ছিলো।
আমরা মনে করি, অর্থনৈতিক চাহিদা, পণ্য ও যাত্রী পরিবহন, অভ্যন্তরীণ ব্যবসাÑবাণিজ্য, এসব ক্ষেত্রে রেলের বড়ো ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। তবে এ জন্য আধুনিক, প্রগতিমনস্ক ও লোক চাহিদার প্রতি আন্তরিক হওয়ার উদ্যোগ রেলের অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনতে পারে।
মহাপরিকল্পনায় রেলওয়ে চাকুরিজীবীদের বেলায় প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের পরিবর্তে সার্টিফিকেট নির্ভর পূর্ণাঙ্গ পরিপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় আগাতে হবে। বাংলাদেশ রেলওয়েকেও পরিপূর্ণভাবে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার উপযোগী করে গড়ে তোলার পদক্ষেপ নিতে হলে শিক্ষাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। আজকের এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আনন্দঘন দিনে সবার প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই ব্যাপারে আক্ষরিক অর্থে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে।

লেখক : টেকসই উন্নয়নকর্মী
শযধহধৎধহলধহৎড়ু@মসধরষ.পড়স