ছোটনের ফেরিভ্রমণ

সাঈদুর রহমান লিটন :

সকাল সাতটা বাজে। ছোটন মিয়া ফেরিতে পা রাখে। মনে মনে ভাবে যেন চাঁদে প্রথম পা রাখছে। দাদুর কাছে শুনেছে  ফেরি খুব বড় যান। যা নদীতে চলে। যে যান অনেকগুলো বাস, ট্রাকসহ অনেক যানবাহন নিয়ে নদী পার করে  দেয়। অবাক হত ছোটন। গল্প শুনে রূপকথার গল্প মনে হত তার। তাও কি সম্ভব? মনে মনে তখন থেকেই ইচ্ছে, জীবনে একদিন হলেও ফেরিতে চড়বে সে। ইচ্ছেটা পূরণ হচ্ছে আজ  ছোটনের নানাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করার জন্য পরিবারসহ ঢাকায় যাওয়ার কারণে। ছোটনের ছোট মন আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। ফেরিতে গোটাদশেক বাস, ট্রাক, চার-পাঁচটি মাইক্রোবাস, অনেকগুলো বাইক, প্রায় শতেকখানি মানুষ। কয়েকবার গুনতে চেষ্টা করে ছোটন। বাস-ট্রাক গুনতে পারলেও মানুষ গুনতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। দোতলা ফেরি। ছোটন  দোতলায় ওঠে। দোতলায় কয়েকটি  দোকান, বিরাট হল রুম, অন্তত একশ-দেড়শ চেয়ার সেটিং করা, বাথরুম, কিচেন সবই আছে। দাদুর গল্পের চেয়েও আরো অনেক কিছু বেশি আছে ফেরিতে। অন্তত দশ-বারোটি ফলের দোকান। কত রকম ফল। ঝালমুড়ি বিক্রেতা ঝালমুড়ি বিক্রি করছে, ডিম সেদ্ধওয়ালা গরম ডিম বিক্রি করছে, নানারকম জিনিসের ফেরিওয়ালা ফেরি করে নানারকম জিনিসপত্র বিক্রি করছে। এমনকি পদ্মানদীর ইলিশ মাছ, আইড় মাছ, গাইরে মাছসহ নানা ধরনের নদীর মাছও বিক্রি করছে জেলেরা। ছোটন বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে সবকিছু  দেখতে থাকে।  ফেরিটি কখন ছেড়েছে ছোটনের খেয়াল নেই। বিকট একধরনের শব্দে  ফেরিটি নদীর পানি  ফেরে ফেরে চলছে। নদীতে গাঙচিলের ঝাঁক উড়ছে, মাছ ধরছে, পানিতে সাঁতরাচ্ছে। কি দারুণ লাগছে। ছোটনের এই এতটুকু বয়সে সবচেয়ে সুন্দর জিনিস দেখার সৌভাগ্য, যা ভোলার মতো নয়। সারাজীবন মনে থাকবে।

শীতের সকাল। শিশু সূর্যের আলো। পদ্মানদীর হালকা ঢেউযুক্ত পানির ওপর পড়ছে। রুপালি রঙ আর সোনালি রঙে  কী এক মাধুর্য সৃষ্টি করেছে। ছোটনের কিশোর চোখে স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে সব। ফেরি ক্রমাগত এগিয়ে চলছে পাটুরিয়া ঘাটের দিকে। নৌকা নিয়ে জেলেরা মাছ ধরছে। জাল দিয়ে ইলিশ মাছধরাও  ছোটন জীবনে প্রথম  দেখল।

সে যে এক বিরাট অনুভূতি, ভালোলাগার এক নুতন দিগন্ত। শীতের দিনে মরা নদী। কয়েক জায়গায় চর পড়েছে। ফেরি আর লঞ্চ চলার জন্য নদী ভরা ড্রেজার পাইপ ভেসে আছে সাপের মতো। নদী যেন নয় লঞ্চ, স্টিমার, আর কার্গোর মেলা। নয়ন জুড়িয়ে যাওয়া দৃশ্য। ছোটন বারবার হতবিহ্বল হয়ে ওঠে আনন্দে। আর আছে নৌকা। ঢেউয়ের তালে তালে দুলছে। এই বুঝি নৌকায় পানি উঠবে, বা তলিয়ে যাবে। তলায় না অবলীলায়। ঢেউ  ভেঙে নৌকা এগিয়ে যায় সামনের দিকে।

ফেরির রেলিং ধরে ছোটন দেখতে থাকে নয়নভরে।