লায়ন্স সেবাবর্ষ শুরু : অসহায়ের দুঃখ ঘুচে ফুটুক হাসি

কাশেম শাহ »

সারাবিশে^ যে কয়টা আন্তর্জাতিক সেবা সংগঠন নিরলস কাজ করে চলেছে লায়ন্স ক্লাবস ইন্টারন্যাশনাল তার মধ্যে অন্যতম। ১৯১৭ সালে যাত্রা শুরু করা মানবতাবাদী এ সংগঠনটি ১০৪ বছর ধরে নানা কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছার চেষ্টা করে যাচ্ছে। দেশ-জাত-ভাষার ভিন্নতা ভুলে, সাদা-কালো’র বিভেদ ঘুচিয়ে যার যার অবস্থান থেকে সবাই একটা লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে, তা হলো ‘উই সার্ভ’। বাংলাদেশেও স্বাধীনতার পরপরই নিজস্ব সৌরভে আর গৌরবে যাত্রা শুরু লায়ন্স ক্লাবের। সারাদেশে একটি মাল্টিপল লায়ন্স জেলার অধীনে সাতটি জেলার কয়েকশ’ ক্লাব আর প্রায় ৮ হাজারের কাছাকাছি লায়ন সদস্য তাদের নিরলস কর্মকা- অব্যাহত রেখেছেন। অন্ধত্ব নিবারণে সারা পৃথিবীতে বিশেষ ভূমিকা রাখা এ সংগঠনটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ‘লক্ষ্য’ পূরণে কাজ করে যায়। একেকটি লক্ষ্য পূরণ হয়ে গেলে নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল কাজ করছে সুনির্দিষ্ট পাঁচটি লক্ষ নিয়ে। এর মধ্যে আছে ভিশন (অন্ধত্ব নিবারণ), হাঙ্গার (ক্ষুধা নিবারণ), ডায়াবেটিস, ………. ও ইয়ুথ (তরুণদের জীবনমান উন্নয়ন)।
চট্টগ্রাম লায়নইজমের অন্যতম বাতিঘর। স্বাধীনতার পরপর এখানে লায়ন্স ক্লাবের কর্মকা- শুরু হয়। বাংলাদেশে লায়নইজমের জনক র্মহুম এম আর সিদ্দিকী। তাঁর পুরো নাম মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যমন্ত্রী। ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহচর। চট্টগ্রামের সীতাকু-ে জন্ম নেয়া প্রবীণ এ লায়ন ব্যক্তিত্ব ৬৯-৭০ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে লায়ন্স জেলার (জেলা ৩০৫-ই পাকিস্তান, ১৯৬২-৬৩, ১৯৬৩-৬৪) গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে সাথে সাথেই তিনি বাংলাদেশে লায়ন্স জেলা প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর সে সময়ের লায়ন সদস্যদের অক্লান্ত পরিশ্রমে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে লায়নইজমের যাত্রা শুরু হয়। তাঁকে বলা হয় ‘ফাদার অব লায়নইজম ইন বাংলাদেশ’। মরহুম লায়ন এম আর সিদ্দিকী ১৯৭২-৭৩ ও ১৯৭৩-৭৪ সালে প্রতিষ্ঠাকালীন গভর্নর হিসেবে নবগঠিত জেলা ৩১৫ এর দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ৩১৫ এর অধীনে পর্যায়ক্রমে ৭টি জেলা গঠিত হয়। তার অন্যতম জেলা ৩১৫-বি৪, যেটির কর্মকা- পরিচালিত হয় বৃহত্তর চট্টগ্রাম জুড়ে।
চট্টগ্রামে পৃথক লায়ন্স জেলা (৩১৫-বি৪) গঠন হয় ১৯৯৬-৯৭ সালে। সে সময় অবিভক্ত ৩১৫-বি২ এর গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন চৌকষ লায়ন ব্যক্তিত্ব লায়ন এ. কাইয়ুম চৌধুরী। চট্টগ্রামে জেলা গঠনের পর প্রতিষ্ঠাকালীন গভর্নর নির্বাচিত হন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মরহুম লায়ন আবদুল গাফফার দোভাষ। লায়ন্স ক্লাব অব চিটাগাং বাংলাদেশের প্রথম লায়ন্স ক্লাব। বর্তমানে চট্টগ্রামে ৮৭টি লায়ন্স ক্লাবের অধীনে প্রায় ২৮০০ লায়ন সদস্য বৃহত্তর চট্টগ্রাম জুড়ে তাদের সেবা কর্মকা- পরিচালনা করছেন। এ বছর ২০২১-২২ সেবাবার্ষের জন্য লায়ন্স জেলা ৩১৫-বি৪ বাংলাদেশের জেলা গভর্নর নির্বাচিত হয়েছেন মরহুম লায়ন আবদুল গাফফার দোভাষের সুযোগ্য সন্তান লায়ন আল সাদাত দোভাষ। প্রথম ভাইস জেলা গভর্নর হিসেবে লায়ন শেখ সামশুদ্দিন সিদ্দিকী ও দ্বিতীয় ভাইস গভর্নর হিসেবে লায়ন এমডিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁদের সাথে কেবিনেট সেক্রেটারি হিসেবে লায়ন এস এম আশরাফুল আলম আরজু এবং কেবিনেট ট্রেজারার হিসেবে লায়ন আবু বক্কর সিদ্দিকী আগামী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবেন।
নব-নির্বাচিত জেলা গভর্নর লায়ন আল সাদাত দোভাষ এ বছর কল দিয়েছেন সার্ভ ফর ম্যানকাইন্ড (মানবতার জন্য সেবা)। এটা মূলত লায়নইজমেরই মূল কথা। মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে স্থায়ী বিভিন্ন প্রকল্প ছাড়াও বছরব্যাপী নানা কর্মসূচি আয়োজন করে চলেছে। গ্রামে গ্রামে গিয়ে চক্ষু শিবির, খৎনা ক্যাম্প, রক্তের গ্রুপ নির্ণয়, ত্রাণ বিতরণ, অসহায় কন্যার বিয়েতে অনুদান, ঝড়-বন্যা-অগ্নিকা-ে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ বিতরণ, মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান আরও নানা কার্যক্রম। স্থায়ী প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে লায়ন্স চক্ষু হাসপাতাল, আনোয়ারা তাহের ফিজিওথেরাপি ক্লিনিক, লায়ন্স জেনারেল হাসপাতাল, ইমদাদ-সিতারা কিডনি সেন্টার, দন্ত হাসপাতাল।
কোনো একক ব্যক্তি বা একটি সংগঠনের পক্ষেও দেশের বড় কোনো সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয় বললেই চলে। যে কাজ রাষ্ট্রের একার পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়, সেটি জনগণের সম্মিলিত অংশগ্রহণে সমাধান সম্ভব। দেশের বিত্তশালীরা যদি সরকারের সহযোগী হিসেবে এগিয়ে আসেন তাহলে দারিদ্র্য নির্মূল সম্ভব না হলেও কমিয়ে আনা সম্ভব। লায়ন্স ক্লাব ঠিক সে কাজটাই করে যাচ্ছে।
প্রতিবছরের মতো এ বছরও ১ জুলাই শুরু হলো নতুন আরেকটি লায়ন সেবাবর্ষ। গত দুই বছর ধরে করোনা মহামারীর প্রকোপ বাড়তে থাকায় অন্য সব কিছুর মতোই লায়ন্স ক্লাবের কার্যক্রমেও গতি কিছুটা কমিয়ে আনতে হচ্ছে। ২০১৯-২০ সেবাবার্ষের জেলা গভর্নর লায়ন কামরুন মালেকের উদ্যোগে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে করোনা সাপোর্ট সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ সেন্টারের মাধ্যমে করোনা আক্রান্ত রোগিদের অক্সিজেন সেবা, হাই ফ্লো নেজাল, আইসিইউ বেড প্রদানসহ বিভিন্ন সেবা প্রদান করা হচ্ছে। ২০২০-২১ সেবাবর্ষের জেলা গভর্নর লায়ন ডা. সুকান্ত ভট্টাচার্যও লায়ন সদসদের নিয়ে করোনা মহামারীর এ দুর্যোগের সময়ও নিরলস সেবা দিয়ে গেছেন।
এটাই মূলত সেবার মূল বক্তব্য। মানুষের জীবনে বিপদ-আপদ আসবে, দুঃসময় আসবে, তাই বলে থেমে থাকা যাবে না। যার যার অবস্থান থেকে অসহায় মানুষগুলোর জন্য এগিয়ে আসতে হবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। পৃথিবীর একেক জায়গার মানুষের ভাষা, শারিরিক গঠন, আচার-আচরণ, কৃষ্টি-কালচার সব আলাদা, কিন্তু হাসি আর কান্না সারা পৃথিবীর সব মানুষের একই। তাই কষ্ট আর দুঃখের সময় কারো কান্না মুছে হাসি ফিরিয়ে দেওয়ার চেয়ে মহৎ কাজ আর কিছুই হতে পারে না।

লেখক : প্রেসিডেন্ট,
লায়ন্স ক্লাব অব চিটাগাং ইম্পেরিয়াল সিটি