করোনাকালে মনুষ্যত্বের পুনর্জন্ম

আবদুল মান্নান »

সারা বিশ্ব বর্তমানে অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে একটি অজানা অণুজীবের দাপটে । বিজ্ঞানীরা তার নাম দিয়েছে কোভিড-১৯, সাধারণ মানুষ জানে তাকে করোনা বলে । এই একটি অজানা অণুজীব বা ভাইরাস সারা বিশ্বের সকল মানুষকে জাতি, ধর্ম, বর্ণ বিশেষে নতজানু করে দিয়েছে । বিশ্বের বড় বড় পরাশক্তি হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে মানুষ মারার মারণাস্ত্র বানানোর জন্য কিন্তু মানুষকে বাঁচানোর জন্য এই অর্থের ক্ষুদ্র পরিমাণও যদি তারা ব্যয় করতো তা হলে বিশ্ব আজ এই অণুজীবের কাছে পরাস্ত হতো না। এই পরাশক্তিগুলো ভিন গ্রহে অক্সিজেনের অস্তিত্ব খোঁজার চেষ্টা করছে কিন্তু মর্ত্যে এই অক্সিজেন বানানোর কৌশল বিজ্ঞান তাদের হাতে তুলে দিয়েছে অনেক আগে । কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, সেই অক্সিজেনের অভাবে করুণ অবস্থায় আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের হাসপাতালে করোনা রোগিরা মারা পড়ছে ঘন্টায় ঘন্টায় । অথচ এই দেশটি একটি পারমানবিক শক্তিধর দেশ, ধারণা করা হচ্ছে আগামি এক দশকে বিশ্বের তৃতীয় অর্থনৈতিক পরাশক্তি হবে । একই অবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোরও । যে দিকেই চোখ যায় সেদিকেই মৃত্যু আর আহাজারি। মানুষের কিছু করার নেই ।
বিশ্ব গত একশত বছরে মানুষের এমন করুণ অবস্থা দেখেনি । সর্বশেষ একটি সর্বগ্রাসী পরিস্থিতি হয়েছিল ত্রিশ আর চল্লিশের দশকে । তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকাল । যদিও একে বিশ্বযুদ্ধ বলা হয় বাস্তবে এটি বিশ্বযুদ্ধ ছিল না কারণ এই যুদ্ধে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ জড়িত ছিল না । কিন্তু এই করোনা অতিমারি কালে বিশ্বের প্রায় সব দেশ কম বেশী আক্রান্ত হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে সব দেশে, কোন কোন দেশে এই সংখ্যা শতকের ঘরে আবার যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রাজিলে এই সংখ্যা লাখের ঘরে। এই মৃত্যুর মিছিলে কোটিপতি হতে সেনা বাহিনীর জেনারেল, খেটে খাওয়া মানুষ হতে পেশাদার ডাক্তার, শিল্পপতি হতে শুরু করে পত্রিকার সাংবাদিক, গবেষক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, মন্ত্রী হতে লেখক, কেউ বাদ যায়নি । সারা পৃথিবীর যখন এই অবস্থা তখন মানুষ দু’টি জিনিসের জয়যাত্রা দেখেছে । প্রথমটি বিজ্ঞানের আর দ্বিতীয়টি মনুষ্যত্ব বা মানবিকতার ।
এর পূর্বে যত অতিমারির আঘাত এসেছে তার প্রতিষেধক তৈরি করতে পাঁচ হতে ছয় বছর সময় লেগেছে । মারা পড়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ । ধারণা করা হয় ১৯১৮ সালের ফেব্রুয়ারি হতে শুরু করে ১৯২০ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত সময়কালে ইউরোপ ও আমেরিকা কমপক্ষে এক কোটি সত্তর লক্ষ হতে দশ কোটি পর্যন্ত মানুষের মৃত্যু হয় স্পেনিশ ফ্লুতে। এই অতিমারিটি আঘাত হেনেছিল শুধু ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলে। এই অতিমারি মোকাবেলা করার জন্য নানা রকমের ঔষধ বা প্রতিষেধক ব্যবহার করা হয়েছিল । সঠিক ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়েছিল ১৯৪০ সালে । আর কোভিড-১৯ ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনে প্রথম দেখা দেওয়ার পর যখন তা ইউরোপে আঘাত হানে, তার নয় মাসের মাথায় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ঘোষণা করেন তারা এই অতিমারি রোধ করার জন্য ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছে । এরপর আরো একাধিক ঔষধ প্রস্তুতকারি প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা তাদের গবেষণাগারে ভ্যাকসিন তৈরি করার ঘোষণা দেয় ।
বিজ্ঞানের এই বিস্ময়কর অবদানের পর আর একটি বিষয় দেশে এবং দেশের বাইরে মানুষ প্রত্যক্ষ করলো আর তা হচ্ছে সাধারণ মানুষের মনুষ্যত্ব বা মানবিকতা । প্রথম দিকে কোন একজন করোনা রোগী মারা গেলে তার স্বজনরাও তার মৃতদেহ হাসপাতালে ফেলে পালিয়ে গেছে । এটি বেশী ঘটেছে বাংলাদেশে । এগিয়ে এলো কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা যার অধিকাংশ সদস্যই তরুণ যারা মৃতদেহ দাফন কাফনের ব্যবস্থা করতে লাগলো। অনেক জায়গায় দেখা গেল সনাতন ধর্মের কেউ একজনের মৃত্যু হলে তার সৎকারে এগিয়ে এসেছে এলাকার মুসলমান যুবকেরা । নারায়ণগঞ্জে একজন ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য এই কাজের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে নিজেই করোনা আক্রান্ত হয়ে গেলেন। আর একদল তরুণ নেমে গেল ক্ষুধার্তদের বিনামূল্যে আহার যোগাতে। হাসপাতালগুলোর ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য কর্মচারীরা দিনরাত রোগির সেবা দিয়ে যাচ্ছে । গত এক বছরে করোনা সেবা দিতে গিয়ে প্রায় দেড়শত ডাক্তার মৃত্যুবরণ করেছে । এ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভাররা তাদের গাড়িতেই রাত কাটাচ্ছে । পিছিয়ে থাকেনি সরকারের বিভিন্ন বাহিনী । এদের এই আত্মত্যাগ মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ।
আমাদের পাশের দেশ ভারত। গত কয়েক সপ্তাহে করোনার আঘাতে সম্পূর্ণ পরাস্ত। এই পর্যন্ত প্রায় দুই কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সঠিক ভাবে পরীক্ষা হলে এই সংখ্যা ৫০ কোটি পর্যন্ত হতে পারে। এই পর্যন্ত দ্ইু লক্ষের উপর মানুষ সেই দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার মানুষ ভারতে মারা যাচ্ছে। ভারতে করোনার এটি দ্বিতীয় ঢেউ। দিল্লি, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, তামিলনাড়–, কর্ণাটক, গোয়ার অবস্থা ভয়াবহ। পশ্চিম বঙ্গের অবস্থাও খারাপের দিকে। সব চেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি তখনই সৃষ্টি হয়েছে যখন হাসপাতালগুলোতে রোগির সিট, আইসিইউ, অক্সিজেনের অভাব দেখা দিয়েছে । দিল্লির একটি হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে অনেক রোগির মৃত্যু হয়েছে ।
ভারতে করোনা এই মহামারি আকার ধারণ করার জন্য সাধারণ মানুষ কেন্দ্র সরকারকে দায়ি করছে । সরকার মনে করেছিল এই অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ ভারতে লাগবে না । সরকার উত্তর ভারতের উত্তরাখা- রাজ্যে অনুষ্ঠিত হরিদ্বারে কুম্ভ মেলা বন্ধ করতে পারেনি। সেখানে চারদিনে আনুমানিক এক কোটি লোক কোন রকমের স্বাস্থ্যবিধি না মেনে গঙ্গা স্œানে গিয়েছিল। এই পর্যন্ত এই মেলায় অংশ গ্রহণকারিদের মধ্যে প্রায় দুই হাজার জনের বেশী করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। আসল সংখ্যা আরো কয়েকগুন হতে পারে । দেশটির রাজ্য সরকার গুলো এই রকম আরো কিছু ধর্মীয় জমায়েত বন্ধ করার কোন পদক্ষেপ নেয় নি । ভারতে আরো একটি কর্মসূচি হয়েছে যাতে সংক্রমণটা এতো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে আর তা হচ্ছে পশ্চিম বঙ্গ সহ চারটি রাজ্যে রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন। এতে নিয়মিত মানুষের জমায়েত হয়েছে, জনসভা আর প্রচার প্রচারণায়। পশ্চিম বঙ্গে এটি বেশি হয়েছে প্রতি সপ্তাহে এই রাজ্যে হয় ভারতের প্রধান মন্ত্রী অথবা তাঁর সরকারের কোন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী নির্বাচনী সভা করেছেন । কোথাও স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা ছিল না ।
ভারতের এই চরম দুর্দিনে অনেক প্রতিষ্ঠান, মানুষ ও দেশ তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে প্রমান করেছে মানবতাই মানুষের প্রধান ধর্ম। এর পর কেউ মুসলমান আর কেউ বা হিন্দু নয়ত বা খ্রিষ্টান কিংবা নাস্তিক । ভারতে বর্তমানে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় যাদের অন্যতম মন্ত্র হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী, অর্থাৎ ভারত শুধু হিন্দুদের দেশ । এমন চিন্তা চেতনা শুধু উগ্র জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয় যা যে কোন দেশ, সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর । অথচ এই অতিমারির ক্রান্তিকালে দেখা গেছে গুজরাটের মুসলমানরা তাদের অনেক মসজিদকে স্বেচ্ছা হাসপাতালে রূপান্তর করেছে । এই মসজিদগুলোর অনেকগুলোই ২০০২ সালে সংগঠিত দাঙ্গায় সম্পূর্ণ বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল । গুজরাট ছাড়াও উত্তর প্রদেশের অনেক মসজিদই হাসপাতালে রূপান্তর করা হয়েছে । সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ঘটেছে উত্তর প্রদেশের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায়। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তাদের একটি বিশাল ভবনকে হাসপাতালে রূপান্তর করেছে । এই সব হাসপাতালের দ্বার সকলের জন্য উন্মুক্ত । অথচ আমাদের দেশের এক শ্রেণির উগ্রবাদী অর্ধশিক্ষিত মোল্লা যারা নিজেদের দেওবন্দি বলে দাবি করেন তারা সব সময় ওয়াজের নামে হিংসা, বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা ছড়ান যা ইসলাম ধর্ম কখনো অনুমোদন করে না । শুধু মসজিদ নয়, অনেক মন্দির ও অন্যান্য উপাসনালয়কেও হাসপাতাল বা আইসোলেশন সেন্টারে রূপান্তর করা হয়েছে । উত্তর প্রদেশের মুজাফ্ফরনগর শহরে একজন সনাতন ধর্মাবলম্বি মৃত্যু হলে তার মুখাগ্নি করার কেউ ছিল না । তার একমাত্র ছেলে অন্য শহরে থাকে । লকডাউনে আসতে পারছিল না । তার কাজটি করলো তার বন্ধু মোহাম্মদ ইউনুস।
ভারত যখন অক্সিজেনের অভাবে ধুঁকছে তখন সৌদি আরব আশি মিলিয়ন মেট্রিক টন তরল অক্সিজেন পাঠিয়েছে । এর আগে ভারত সৌদি আরবকে কোভিড-১৯ এর টিকা দিয়েছে । অক্সিজেন এলো সিঙ্গাপুর, জার্মানি হতেও । যুক্তরাজ্য হতে এলো চিকিৎসা সরঞ্জাম । যুক্তরাষ্ট্র টিকা উৎপাদনের জন্য কাঁচামালের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল তা তুলে নিয়েছে । মহারাষ্ট্রের অবস্থা আগে থেকেই করুণ । শাহনেওয়াজ শেখ তার দামি গাড়িটা বাইশ লক্ষ রূপিতে বিক্রি করে তা দিয়ে একশত ষাটটি অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে তা হাসপতালে বিনামূল্যে বিতরণ করেছেন। ধর্ম নয় তার কাছে মানবতাই প্রথম। ভারতের বড় বড় শিল্পপতিরা একসাথে হয়ে সরকারকে এই দুর্যোগ মোকাবেলায় সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে । রতন টাটা একাই দেড় হাজার কোটি রূপি সরকারের তহবিলে দান করেছে এবং ঘোষণা করেছে তাঁর সকল সম্পদ তিনি দেশের প্রয়োজনে দিয়ে দিতে রাজি । রতন টাটা একজন পার্সি । যে সব বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান অক্সিজেন ব্যবহার করে তারা তার ব্যবহার হয় সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে অথবা অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে । বাকিটা যাচ্ছে হাসপাতালে। বাংলাদেশের একাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনে একই কাজ করার ঘোষনা দিয়েছে । পাকিস্তানের সাথে ভারতের বৈরী সম্পর্ক ঐতিহাসিক । সেই পাকিস্তান ভারতকে এই দুর্যোগ মোকাবেলায় সহায়তার হাত বাড়িয়েছে । বাংলাদেশের সাথে প্রতিশ্রুত টিকা না দিয়ে ভারত চুক্তি লঙ্ঘন করেছে । তারপরও বাংলাদেশ মানবিকতার নিদর্শন স্বরূপ হিসেবে প্রয়োজনীয় ঔষধ ও অন্যান সরঞ্জাম বা তার যা সাধ্যে কুলায় তা দিয়ে ভারতকে সাহায্য করতে প্রস্তাব দিয়েছে। ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে খ্যাত মুম্বাইয়ে কারফিউ চলছে । অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে । ক’দিন আগে দেখা গেল মুম্বাই পুলিশ সেহরির সময় মাইকে মুসলমানদের আহ্বান করছেন, সেহরির পর তারা যখন নামাজ (ফজর) পড়েন তখন যেন তারা এই অতিমারি থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য প্রার্থনা করেন ।
সারা বিশ্বে নানা ঘটনার কারণে মনুষ্যত্ব লোপ পেয়েছিল । মনে হচ্ছে এই একটি অতিমারির কারণে সেই মনুুষ্যত্বর কিছুটা হলেও ফিরে এসেছে । মানুষ বাঁচলে ধর্ম । মানুষই যদি না বাঁচে তা হলে ধর্ম কর্ম পালন করবে কে? কোভিড-১৯ অতিমারি প্রমান করলো বিপদের সময় মনুষ্যত্বের চেয়ে বড় ধর্ম আর কিছু হতে পারে না ।
লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক