স্বপ্নজাল

সুভাষ সর্ব্ববিদ্যা

এটি একটি সরকারি ব্যাংক। এখানে রয়েছে তিনটি কাউন্টার। একটি রিসিভ কাউন্টার। অন্য দুটি পেমেন্ট কাউন্টার।
অপরাহ্ন সময় তিনটা সতেরো। আমি পেমেন্ট কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়াই। ভেতরে দুজন ক্যাশিয়ার গ্রাহকদের সেবাদানে নিবিষ্ট। তাদের পিছনে রয়েছে একজন ক্যাশ অফিসার।
কাউন্টারগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে গ্রাহকদের কেউ কেউ ব্যাংকের নিয়ম মেনে টাকা তুলছেন। কেউবা আবার জমাদানে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছেন। একটি ড্রাফট নগদায়ন করছিলাম। ড্রাফটখানি তিন-চার টেবিল ঘুরে পেমেন্ট কাউন্টারে আসে। আমার সামনে-পেছনে এখন দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি নেই। মানি কাউন্টিং মেশিনে কয়েক বান্ডিল টাকা গুনে ভেতরের ক্যাশিয়ার সাহেব আমার দিকে দৃষ্টি ফেরালেন। কণ্ঠে খেদ মিশিয়ে বললেনÑ স্যার, আপনি সৌভাগ্যবানদের একজন।
ভদ্রলোকের কথায় আচমকা স্তম্ভিত হই। নিজেকে স্থির রেখে বলি- যেমন!
-এই যে ধরুন, এই ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় প্রায় দশ বছর ধরে কাজ করে আসছি। প্রতি মাসে যে বেতনটুকু পাই, তার একটি অংশ থেকে একশ টাকা সমমূল্যের পাঁচটি প্রাইজবন্ড ক্রয় করে সেফ কাস্টডিতে রাখি। শালার ভাগ্যটা এমনিই এক নিষ্ফলা, যতবারই ড্র হয়, কোনোবারই একটি নাম্বারও ভাগে আসে না। অথচ দেখুন, বিশ টাকা দিয়ে আপনি লটারি কিনলেন। তার বিনিময়ে পেয়ে গেলেন ত্রিশ লাখ টাকা।
আসলেই। কথাগুলো অমূলক নয়। তারপরও আমার আর আপনার অবস্থানে বিস্তর ব্যবধান।
ক্যাশিয়ার সাহেব ব্যস্ততায় ব্যাকুল। আরও কয়েক বান্ডিল টাকা মেশিনে গুনে টেবিলের ওপর তিনি ওগুলো রাখলেন। এবং বললেন- স্যার, কী বললেন, বুঝি নাই!
বলছিলাম যে, আপনি সরকারি চাকরিজীবী। কর্মস্থলে উপস্থিত-অনুপস্থিত যা-ই থাকুন না কেন, মাস শেষে সরকারি কোষাগার হতে নির্দিষ্ট একটা এমাউন্ট পান। সেই বিচারে আপনার চেয়ে আমি একেবারে নিকৃষ্ট।
-স্যার, আপনার পেশা কি?
-ইতোপূর্বে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতাম। বছর দেড়েক হলো চাকরি নাই।
-চাকরিটা কিসের ছিল?
-একটি হোটেলে।
-চাকরি গেল কেন?
-কোভিড নাইনটিন-এ হোটেল ব্যবসায় ধস নামে। কর্তৃপক্ষ ’লস্ গোয়িং’ মানতে নারাজ। পরপর বেশ ক’জন কর্মী ছাঁটাই হলো। শেষ তালিকায় যে ক’জন অবশিষ্ট ছিল, তাতে আমার নামটিও সংযোজিত হলো। অর্থাৎ গেট আউট ফ্রম দ্যাট জব।
-ওহ! সো সেড। এখন কমপ্লিট বেকার, তাই তো?
-কমপ্লিট বেকার বললে ঈশ্বর বিরাগভাজন হবেন। মস্তিষ্কের ভাণ্ডারে যেটুকু জ্ঞানবোধ ছিল, সেটি টেবিল ব্যবসার কাজে লাগিয়েছি।
-বুঝি নাই স্যার। কীসের ব্যবসা বললেন?
-টেবিল ব্যবসা।
-টেবিল ব্যবসা?
-জি।
-স্যার, মনে হয় আপনি ফান করছেন!
-ফান নয়। একদম সত্যকথা। পেটের ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে বেশ ক’টা টিউশন নিলাম।
-তাই বুঝি?
-জি।
-পরিবারে আপনার কে আছেন?
-আমি বাদে চারজন।
-যাই হোক, এই কষ্টের দিনে টাকাটা আপনার কাজে আসবে।
-আপনাদের আশীর্বাদ।
-স্যার, যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা বলি?
-জি, বলুন।
-বলছিলাম কি, বিশাল এমাউন্ট। শত্রু বাড়াবেন কেন? কিছু টাকা আমাদের ব্যাংকে রাখুন। তিন মাস অন্তর অন্তর একটা লভ্যাংশ পাবেন।
-নারে ভাই। অত লোভ আমার নেই। যা পেয়েছি, ঈশ্বরের কাছে এটুকুতেই কুর্নিশ।
-ডোন্ট মাইন্ড, প্লিজ। আপনার ভবিষ্যতের কথা ভেবে কথাটি শেয়ার করলাম।
-আসল কথা কি জানেন, এই দুঃসময়ে আমার পরিবার, পরিজনের চাওয়া-পাওয়া ঢের। আগে সেসব চাহিদা মিটিয়ে নিই। এরপর না হয় ভাবলাম।
-প্লিজ স্যার। খুশি হব।
-ঠিক আছে। ভেবেই জানাবো।
ভ্যাট, ট্যাক্স কেটে নেওয়ার পর অবশিষ্ট টাকা আমার হাতে এলো। এতগুলো টাকা একসাথে পেয়ে শরীর-মন চনমনে হয়ে উঠল। খানিক এদিক-ওদিক দৃষ্টি ফেলে একটি বান্ডিল পেন্টের পকেটে ঢুকাই। অন্য বান্ডিলগুলো একটি কালোরঙের ব্যাগে সযত্নে রাখি। কী ভেবে পকেটের ভিতর হতে একটি বান্ডিল বের করে কিছু টাকা ছড়িয়ে নিচ্ছিলাম। আচমকা গেটের দিকে চোখ যায়। নজরে এলো দুজন নিরাপত্তা প্রহরীর লোলুপ দৃষ্টি। ওই দুজনের পরিধানে ছিল খাকি রঙের পোশাক। একজনের কাঁধে ঢাউস আকারের একটি রাইফেল। রাইফেলটি বেশ পুরোনো। দীর্ঘ সময় একাঁধ-ওকাঁধ ঝুলে বিবর্ণ রঙ ধারণ করেছে। এখন যার কাঁধে ঝুলছে সে সবল, অন্যজন দুর্বল প্রকৃতির। কেন জানি, বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠলো। বিড়বিড় করে বললাম- আহারে! কত কষ্ট-যন্ত্রণা সয়ে এরা দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। সরকারি কোষাগার হতে কতো টাকাই-বা এদের বেতন হয়? সামান্য ক’টি টাকা! দুর্মূল্যের বাজারে কীভাবে বেঁচে আছে ওরা, একমাত্র ঈশ্বরই জানেন।
অবয়বের দিকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলাম। বড্ড মায়া হলো। যেন দারিদ্র্যের কষাঘাতে কিম্ভূত কিমাকার। তা না হলে কেউ কি এমন করে কারও ব্যক্তিগত সম্পদের ওপর লোলুপ দৃষ্টি দেয়? ইশারায় তাদের একজনকে কাছে ডাকি। ওরা একজন নয়, দুজনই গেট ছেড়ে ছুটে আসে। একজন লম্বা সালাম দেয়। জিজ্ঞাস করি- কী নাম তোমার? দুর্বল লোকটি বলল- স্যার, আমার নাম লিয়াকত। সবল লোকটিকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন পড়ে নাই। সে আগ বাড়িয়ে বলল- স্যার, আমি রহমত। দুজনই এই ব্যাংকের দারোয়ান। চাচা ডিউটি করেন সকালে। আর আমি নাইটে।
-তোমাদের কেন ডেকেছি জানো?
-জি না স্যার। এখানে এক হাজার টাকা আছে। দু’জন সমানভাগে ভাগ করে নেবে, কেমন!
ওরা বিস্মিত, বিমুগ্ধ। ঘোর কাটতেই দু’জনই হাসিমুখে সালাম দেয় আবার। ফিরে যায় গেটের দায়িত্বে।
অবশিষ্ট টাকা পেন্টের পকেটে রাখলাম।
ভেতর হতে ক্যাশিয়ার সাহেব বললেনÑ স্যার, কোক-ফানটা আনি, খাবেন।
বুঝলাম, তাঁর খুশির প্রয়োজন আছে। একজন বেকার লোককে সালাম দেওয়া, স্যার সম্বোধন করা। কেমন যেন গর্ববোধ করছিলাম। পাশাপাশি উচ্চমাপের মানুষও বলেও ভাবাচ্ছিল। এক হাজার টাকার একটি নোট নিয়ে ভেতরের দু’জনকে দিতেই বিপত্তি।
পেছন থেকে আরেকজন চেঁচিয়ে উঠলেন- স্যার, আমি বাদ পড়লাম কেন? যিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, তিনি পুরুষ নন, মহিলা। ক্যাশ অফিসার। বিড়বিড় করে বললাম, অফিসার মহিলা হলে কী হবে? শ্রেণিভেদে টাকার বিভক্তি হয় নাকি, এ্যাঁ! তাঁর সংসারেও নানাবিধ প্রয়োজন থাকতে পারে হয়তো।
পকেট হতে আরও একটি হাজার টাকার নোট বের করে ক্যাশিয়ার সাহেবের হাতে দিই। বলি, ভাই, আমার হাজার টাকার নোটটি একটু খুচরো করে দিন। ক্যাশিয়ার সাহেব বললেন, ইয়েস, অফকোর্স। কয়টি করে দেবো, স্যার?
-দুটো করে দিন। একটি আমাকে দেন, অন্যটি দেন মেডামকে। ক্যাশিয়ার সাহেব তাই করলেন।
পাঁচ শ টাকার নোটটি হাতে পেয়ে ভদ্রমহিলা ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিক এনে বললেন, ধন্যবাদ স্যার, ভালো থাকবেন। আর আমাদের জন্য বেশি-বেশি দোয়া করবেন।
Ñঅবশ্যই দোয়া থাকবে।
নিজেকে আর স্থির রাখা যাচ্ছিল না। মন উসখুস করছিল দ্রুত বাসায় যেতে। থলেটি তুলে পা বাড়াই সামনে। চেম্বার ছেড়ে নিকট দূরত্বে অবস্থান করছিলেন কোট-টাইপরা এক ভদ্রলোক। ইনি রহিম উল্লাহ সাহেব। এই ব্যাংকের ব্যবস্থাপক। বয়স পঞ্চাশ-পঞ্চান্নের এদিক-ওদিক। পুরো চশমার ফাঁক গলে তাঁর অন্তর্নিহিত দৃষ্টি আমার গতিপথ লক্ষ্য করছিল। গেট ছাড়ার খানিক আগে তিনি এগিয়ে এলেন। নিজ থেকে হাত বাড়িয়ে কুশলাদি জানার চেষ্টা করলেন। বললেন,
স্যার, আমাদের ব্যাংকে একটি একাউন্ট খুলুন। সব টাকা একত্রে ব্যয় না করে একটি ফিক্সড এমাউন্ট এই ব্যাংকে রাখেন। অন্য ব্যাংক যা সুবিধা দেবে, আমরা তার চেয়ে বাড়তি দেবো। প্রয়োজন হলে এই এমাউন্ট থেকে আপনি লোনও নিতে পারবেন।
এমন একটা মুহূর্ত। প্রাসঙ্গিক-অপ্রসাঙ্গিক সব তুচ্ছ মনে হচ্ছিল। আমাকে দ্রুত পৌঁছাতে হবে বাসায়। রহিম উল্লাহ সাহেবের কথাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সাথে না দেখে তাঁকে বলি, স্যার, আপনার উপদেশ শিরোধার্য। একটু বাসায় পৌঁছি। এরপর সিদ্ধান্ত নিয়ে আপনার চেম্বারে আসব।
-থ্যাঙ্ক ইয়ু সো মাচ, স্যার। বি কেয়ারফুল।
-থ্যাঙ্ক ইয়ু টু, স্যার।
কথোপকথন সেরে রহিম উল্লাহ সাহেব তাঁর চেম্বারের দিকে ফিরে যাচ্ছিলেন। আমিও আমার পথে।
গেটের বাইরে একটি সিএনজিচালিত টেক্সি দাঁড়ানো। যাবে বললে ওঠে পড়ি। ওই ড্রাইভার সম্ভবত দারোয়ানদের পরিচিত। তাদের একজন ডেকে বলল, কুদ্দুছ, ঠিকঠাক মতন গাড়ি চালাস। পথে স্যারের যেন কোনো সমস্যা না হয়। খবরদার, বাড়তি ভাড়া চাইবি না। কোনো এক সরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে এত খাতির-যত্ন? এই প্রথম আমার অভিজ্ঞতা হলো।
রাস্তা ফাঁকা ধরে আমাকে নিয়ে এগিয়ে চলছিল আমার গাড়িখানি। গতি বাড়ে-কমে। কিছুদূর এগিয়ে যাই। মাঝপথে এসে চালক কড়া ব্রেক কষে। অজানা আতংকে বুকটা ধক করে উঠল। দুহাতে ব্যাগটি চেপে ধরি। অনুমান সত্য নয়। সিগনাল অমান্য করায় ট্রাফিক পুলিশ গাড়িখানি থামিয়েছে। দু’জনের বাদানুবাদ অসহ্য ঠেকছিল। পাঁচশ টাকার একটি কচকচে নোট ওই ট্রাফিক পুলিশের হাতে গুঁজে দিই। দ্বিতীয় কোনো কথা না বলে ওই পুলিশ চুপচাপ থেকে সরে পড়লেন।
মুহূর্তে বাধা অপসারণ হলো।
গাড়ি আবারও চলতে শুরু করল। দশ কি পনেরো মিনিটের মধ্যে বাসার দরজার সামনে এসে পৌঁছি। তর সইছিল না। সারা শরীর ঘেমে একাকার।
নন-স্টপ কলিং বেল চাপছিলাম। বেলের শব্দ বৃদ্ধা মায়ের কানে ঠেকে। ডোরআইয়ে আমাকে দেখে তিনি দরজা খুললেন এবং বললেন, কই গেছিলি বাপ?
-একটু বাইরে গিয়েছিলাম। ভাত খেয়েছ?
-নারে বাপ। তুই ঘরে না এলে খাই কী করে?
বাসার ভেতর ঢুকতে-ঢুকতে তাঁকে বললাম, মা, অ-মা। কি লাগবে তোমার?
-বাবারে, মুখটা বিস্বাদ হইয়া গেছে।
-কেন? কি হলো আবার?
-ঘরে জর্দা-সুপারি কিচ্ছু নাই। দুদিন ধরে পান মুখে দিতে পারছি না।
-রাখো তোমার জর্দা-সুপারি। তোমার জন্য পঞ্চাশ হাজার বরাদ্দ রেখেছি। ঝটপট বলো কি লাগবে, তোমার?
-নারে বাবা। আমার কিচ্ছু দরকার নাই।
-শাড়ি, পেটিকোট, ব্লাউজ?
-নারে বাপ। এমনিতেই সংসার চলে না। তার ওপর বাড়তি ঝামেলা, কী দরকার? জর্দা-সুপারি হলেই চলবে। মায়ের স্বস্তিতে আমার স্বস্তি। তাঁকে বলি ‘নো চিন্তা’। একটু পর এনে দিচ্ছি। চোখ যায় বিছানায়। পা দুটো ছড়িয়ে দিয়ে বইয়ের পাতায় দৃষ্টি নিবদ্ধ আমার মেয়ের। তাকে বলি, এই মেয়ে, সেদিন না বললি তোর মেকআপ বক্সের জানি কী হয়েছে?
-গত বছর যে মেকআপ বক্সটি কিনেছিলাম, সেটির ডেট এক্সপাইয়ার্ড হয়ে গেছে।
-ঠিক আছে। ঠিকমতো লেখাপড়া কর। শপিংমল থেকে আজই কিনে আনব। মেয়ে চুপচাপ তার পাঠে নিবিষ্ট হয়।
পাশে প্রতিবেশীর ঘরে আমার ছেলেটি তার এক সঙ্গীর সাথে খেলা করছিল। ছেলেটির এখনও ৭ বছর পূর্ণ হয়নি। আমার আসার সংবাদে সে দ্রুত ছুটে আসে। বলে, বাবা, ও বাবা? কি হয়েছে?
-কিছু হয়নি। তোমার জন্য একটি অংশ বরাদ্দ রেখেছি। কি লাগবে বল?
উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে সে বলল, একটা বাইক লাগবে।
মিনমিনে গলায় বললাম, হারামজাদা বলে কি? যার বাবার একটি সাইকেল কেনার মুরোদ ছিল না, আর তার ছেলে হয়ে কিনা বলে, বাইক লাগবে! সে আবারও বলল- বাবা, কিনে দেবে?
-হ্যাঁ বাবা নিশ্চয়ই।
-কবে?
-কাল।
-সত্যি বলছ?
-সত্যি সত্যি সত্যি। তোমার মাকে ডাক।
ছেলে খুশিতে আটখানা। কি মজা! কি মজা! বাবা, আমার জন্য বাইক কিনে আনবে। বাইক কিনে আনবে। বলতে বলতে সে ভেতরের ঘরে ঢুকে পড়ল।
ছেলের মুখে খুশির বন্যা।
গিন্নি ছুটে এলেন। তাকে বললাম, বউ, কেমন আছেন? বিদ্রুপের কণ্ঠে তিনি বললেন, মাথা ঠিক আছে?
-শতভাগ ঠিক।
-যা বলবে তাড়াতাড়ি বল। রান্নাঘরে কাজ জমে আছে।
-সেদিন জামদানির কথা কী যেন বলেছিলেন?
-সেসব কথা এখন বাসি হয়ে গেছে।
-শোনেন, আপনার জন্য এক লক্ষ টাকা বরাদ্দ রেখেছি। এবার পুজোর সবচেয়ে দামি জামদানি শাড়িটা হবে আপনার! আচমকা একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন গিন্নি। যেন পুরোনো শোক উথলে উঠলো। তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, দীর্ঘ বিশ বছর অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছ। নতুন করে আর দেখানোর প্রয়োজন নাই।
-কেন?
মুখভার করে তিনি বললেন, শখ মিইয়ে গেছে।
মুহূর্তে বুকের অতল হু হু করে উঠল। তিনি তো মিথ্যা কিছু বলেননি। দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে একটা দামি শাড়ি কি তাঁকে কিনে দিতে পেরেছি?
আচমকা দরজার বাইরে থেকে ঠকঠক, ঠকঠক ক’টি শব্দ কানে বিঁধল। দরজা খোলার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দও কানে ভেসে এলো।
ছেলেটা দ্রুত ছুটে আসে। গা ধাক্কা দিয়ে বলল, বাবা, বাবা, ও বাবা। ওঠো না। ঘুমকাতুরে চোখে তার দিকে তাকাই। বলি, কি হয়েছে? এত ডাকাডাকি করছ কেন?
-একটা বুড়ো লোক এসেছে। মুখে সাদা সাদা লম্বা দাড়ি।
-মুখে সাদা সাদা লম্বা দাড়ি?
Ñসাথে একটা লাঠিও।
-তাই নাকি?
-হ্যাঁ বাবা।
-মাকে বলো পকেট থেকে দুই টাকা দিয়ে বিদায় করতে।
ওই মুহূর্তে আমার গিন্নি এসে হাজির। আড়চোখে তাঁর দিকে তাকাই। ফ্যাকাশে অভিব্যক্তি। বললেন, এই এই তাড়াতাড়ি ওঠো।
-কেন? কি হয়েছে?
-জমিদার চাচা এসেছেন।
-এত হুলুস্থুলের কী আছে? তাঁকে বসিয়ে চা-নাশতা দাও। গল্প-গুজব কর।
-চা-নাশতা? গল্প? তুমি এ জগতে আছ নাকি?
-কেন?
-মনে হয়, নাই।
-নাই মানে?
-উনাকে তিন মাসের ভাড়া দাও নাই। আবার বলো কিনা চা-নাশতা দিয়ে গল্প করতাম!
গিন্নির কটুকথায় মাথা ঝিম মেরে ওঠে। ধড়মড়িয়ে বিছানায় ওঠে বসে ওপরের দিকে দৃষ্টি ফেলি। ঘরে বিদ্যুৎ নাই। ফ্যানের পাখা তিনটিই স্থির।