তেঁতুমিয়া

জসিম উদ্দিন মনছুরি

মনছুর আলীর ডাক পড়ে আবার সাালিসে যেতে হবে। সকালবেলা জাফর ও কাদেরের দ্বন্দ্বের সমাধান শেষে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল মনছুর আলী। পরোপকারী, ন্যায়বিচারক এই মনছুর আলীর বিচার জজও যেন এড়াতে পারে নাÑ আমজনতার এমন দৃঢ়বিশ্বাস। যখনই তাঁর ডাক পড়ে কোথাও তিনি নিরলসভাবে ছুটে যান। কারো কাছ থেকে একটা কাপ চা পর্যন্ত পান করেন না। সালিস-বিচারে তার দিবানিশি কাটে। নিজের জায়গা-সম্পদ পর্যন্ত দেখার জো মেলে না। ইদানিং মানুষ কোর্টে না গিয়ে মনছুর আলীর দ্বরস্থ হতেই পছন্দ করে বেশি। মনছুর আলীও সানন্দ চিত্তে জনসেবা করে যান। উদ্দেশ্য পারলৌকিক মুক্তিপ্রাপ্তি।
তাঁর চৌদ্দপুরুষ ছিল খান্দানি বংশের। বিচারের এই কলাকৌশল ও তীক্ষ্মবুদ্ধি তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন। তার শালিস না মেনেও উপায় থাকে না। এলাকার সবাই তাঁর মুখাপেক্ষী। গেরামের অধিকাংশ জমিজমা বলতে গেলে মনছুর আলীরই। গরিব প্রতিবেশীরা তাঁর বিশাল সম্পত্তি যে যার মতো চাষাবাদ করে যার যা খুশি খাজনা দেয়, যখন ইচ্ছে দেয়। এ নিয়ে মনছুর আলীর তেমন একটা কড়াকড়ি নেই। তাঁর উদ্দেশ্য শুধু মানবসেবা। তাঁর গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ, গোয়ালভরা মহিষ। মনছুর আলীর চার কন্যা আর এক ছেলে। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। তারা যে যার যার মতো সংসারী হয়ে সুখে আছে। মনছুর আলীর ছেলের বয়স ১৪, নাম বাবু। দেখতে-শুনতে সে এলাকার অন্য দশ ছেলেদের মতো নয়। কিছুটা হাবাগোবাধরনের, বলা যায়, আধপাগলাটে। মনছুর আলী ছেলেকে সুস্থ করতে কম খরচাপাতি করেছেন। দেশের নামকরা কোনো ডাক্তার বৈদ্য বাদ রাখেননি। কথায় আছে বিধির লিখন না যায় খণ্ডন। মনছুর আলীর একমাত্র অপূর্ণতা তাঁর একমাত্র ছেলেটির বিকলাঙ্গতা।
মনছুর আলীর বিশাল দিঘির দক্ষিণ-পূর্বকোণে একটা বিশাল তেঁতুলগাছ ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন সেই কবেকাল থেকে। এই তেঁতুলগাছের জন্মবৃত্তান্ত কেউ সঠিকভাবে বলতে পারে না আর এ তল্লাটে। কেউ বলে, দুশো কিংবা তিন শ বছরের প্রাচীন।
কথিত আছে, এই গাছে জিনের আছর আছে। এই তেঁতুলগাছের দৃষ্টি যাকে আছর করেছে তার আর রক্ষে হয়নি। বাবু মায়ের পেটে থাকতে রহিমা বিবি এক অমাবস্যার রাতে ঐ তেঁতুলগাছের পাশ দিয়ে একবার কোথা থেকে আসছিলেন। তারপর রহিমা বিবির গায়ে জ্বর, মাথাঘোরা, মূর্ছা যাওয়া, খিঁচুনি এসব রোগ লেগেই ছিল। চিকিৎসায় ডাক্তার-বৈদ্য-ওঝার শেষ রাখেননি মনছুর আলী। যদিও রহিমা বিবির শেষরক্ষা হয়েছিল মিয়া বৈদ্যের শ্যায়ামি মন্ত্রের বদৌলতে। মিয়া বৈদ্য সতর্ক করেছিল, গর্ভের সন্তানের ওপর আছর পড়তে পারে। সে ভবিষ্যদ্বাণীই যেন সত্য হলো। বাবুর কোনো বন্ধু ছিল না। সে কারো সাথে মিশতো না। তেঁতুলগাছের নিচে বসে নিবিষ্ট মনে কথা বলতো কারো সাথেবিড বিড় করে, গান গাইতো। তাকে ও-স্থানে না যেতে বারণ করা হলেও সে চলে যেত। এমনকি ওকে বেঁধে পর্যন্ত রাখা হয়েছিল। কিন্ত কী এক বাঁধন খুলে সে ঠিকই তেঁতুলতলায় ছুটে যেত। যদিও এ বাঁধন স্বাভাবিক লোকের পক্ষে খোলা সম্ভব নয়। হয়তো অদৃশ্য কোনো প্রেতাত্মা তার এই বাঁধন খুলে দিতো। মনছুর আলীও ছেলের আশা ছেড়ে দেন। তাকে আর বাধা দেয়া হয় না, বাবু ছুটে যায়। সেই থেকে লোকে ওকে ডাকে তেঁতুমিয়া। আবার বাবু ওই তেঁতুলগাছকেই তেঁতুমিয়া বলে ডাকে। হয়তো অদৃশ্য থেকে উত্তরও আসে। যা সাধারণ মানুষ শুনতে পায় না। হয়তো বাবুই শুধু শুনে।
বাবুর পাগলামিটা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিল। মনছুর আলীরও চিন্তার শেষ নেই। সিদ্ধান্ত নিলেন, এবার বন্ধু মশরফ আলীর বাড়ি থেকে সপ্তাহখানেক ঘুরে আসবেন। যাত্রা হলো। বন্ধু তাদের আপ্যায়নের ত্রুটি রাখেনি। মাছ-মাংস, পোলাওর আয়োজনের শেষ নেই। জমিদারবন্ধু বলে কথা। মশরফ আলীও শেখেরখিল গেরামের মাতব্বর। শালিস-বিচার নিয়েই তাঁরও দিন কাঁটে। দুবছর পর দুবন্ধু দুইবন্ধুকে পেয়ে মহাউল্লাসে আনন্দে মেতে ওঠেন। কিন্ত সমস্যা হলো বাবুকে নিয়ে। বাবুর খাবারের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। পাগলামি আর ভাঙচুর করে মশরফ আলীর সুখের নীড়কে লঙ্কাপুরী বানিয়ে দিল। কান্নাকাটি করে বলে, তেঁতু আমাকে ডাকছে। আমি তেঁতুর কাছে যাবো, তেঁতুর কাছে যাবো।
একদিন রাত হলে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে আর সকালে ঘুম থেকে জেগে বাবুকে পাওয়া গেল না কোথাও। রহিমা বিবি ছেলেকে না পেয়ে মূর্ছা গেলেন। সবদিকে তন্নতন্ন করে খুঁজেও যখন পাওয়া গেল না বাবুকে তখন মনছুর আলীর মনে পড়ল সেই তেঁতুলতলার কথা। সফর শেষ করে তারা বিষণ্ন মনে পুত্রশোকে বাডি ফিরে এলো। বাড়ির আঙিনায় এসে বাবুকে তেঁতুলগাছের সাথে জড়িয়ে থাকতে দেখলো। আর সে মনের সুখে গান করছে : ‘তেঁতুমিয়া, তেতুমিয়া, আঁরে তুঁই ভুলি ন যাইও’!
মনছুর আলী : বাবু তুই কি গরি আইস্যযদে?
বাবু : তেঁতুলমিয়া আঁরে আনি ফেলাইয়্যে দে। তেঁতুমিয়া বেশি ভালা, ন বাজি?
মনছুর আলীর রাগ ওঠে চরমে। একমাত্র পুত্র বলে কথা। রাগ সম্বরণ করে বাবুকে নিয়ে ঘরে ফেরেন।
আর দেরি করে না করে আরাকশি (করাতি) ডাকলো। সিদ্ধান্ত হলো গাছটি কেটে ফেলা হবে। পরিচিত কেউ গাছ কাটতে সাহস দেখালো না। তাদেরও কেমন জানি ভয় করছে মনে-মনে। জানহারানোর ভয়! বহুদুর থেকে আরাকশি ডেকে আনা হলো চডা মূল্যে। গাছকাটা হলো। এলাকাবাসী দেখতে এলো প্রাচীন গাছটির বিধ্বস্ত অবস্থা। গাছকাটার সাথে সাথে বাবু বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেল মাটিতে। তার জ্বর আসলো, বমি হলো। চারদিন অচেতন অবস্থায় থাকার পর বাবু তেঁতুমিয়া তেঁতুমিয়া বলে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলো।
এ বাড়িতে এরপর থেকে আর তেঁতুলগাছ জন্মায় না। হয়তো তেঁতুমিয়ার অভিশাপে। প্রতি অমাবস্যার রাতে বাবু আসে। তেঁতুমিয়া তেঁতুমিয়া বলে ডাকে। কান্নার আওয়াজ আসে তেঁতুমিয়ার কান্না।