সৈয়দ শামসুল হক-এর মৃত্যুমগ্ন কবিতা

আরিফুল হাসান »

মৃত্যুকে ক্রমাগত অস্বীকার করে ফুলের গন্ধের মতো থেকে যান সৈয়দ শামসুল হক। তবু মৃত্যু তাঁকে ধরা দেয়। পৃথিবীর সব বন্ধন ত্যাগ করে ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর পাড়ি জমান অনন্তলোকে। গুপ্তজীবন প্রকাশ্য মৃত্যুর মতো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন স্থবির আবহমানতার পাথর দেয়ালে আর বলেন : ‘আমার যে মৃত্যুতেও মৃত্যু নেই।’ শেষভাগের কবিতাগুলোতেও তিনি পরাক্রমশালী মৃত্যুবিরোধী :
‘ভুলে যাও সন্ধ্যে বলে কিছু আছে
একটি তারার ফুল অন্ধকার গাছে
ভুলে যাও লকেটের মতো চাঁদ
সারারাত সারারাত
তোমার হাতের দিকে একখানি হাত।’
এভাবেই মৃত্যুনামের ছদ্মবেশের আড়ালে চিরন্তন জীবনের কথা বলেন, বলেন মৃত্যু মানে যতিচিহ্ন নয়, এক অনন্ত ইনফিনিটি। কবি এবং কবিতার মৃত্যুর আপেক্ষিকতা নিয়ে দ্বান্দ্বিকতার ভেতর পাঠককে ঠেলে দেন :
‘কিন্তু যে কবিতা নামে কলমের মুখে অগ্নিফুল
শব্দ আর ধ্বনিতে শোণিতে যার সমুদ্রের রোল
তারও কি বয়স বাড়ে? কবিতারও হয় শাদা চুল?
কীর্তনিয়া খোল?’
তবু দিন শেষে ভরাপালে চলে যায় সময়ের নৌকো। বাঁকাজলের বেষ্টনীর ভেতর নিঃসঙ্গতা আরও গাঢ় হলে বলতে হয়Ñ
‘লাইনে দাঁড়িয়ে আছি-
নামধাম বিস্তারিত দরখাস্তে আছে।
পাসপোর্ট চাই।’
জীবনকে সর্বোচ্চ সত্যতায় নিয়ে যেতে আজন্ম ধ্বনিমগ্ন সৈয়দ হক শোনান বেঁচে থাকার জয়গান। প্রাণের প্রফুল্লতায় জগতের আনন্দধামে একাকার হয়ে যাপনকে উদযাপনের ঈঙ্গিত রাখেন বিপুল রচনাসম্ভারে। মানুষের জয়, মানবতার বিজয়সূচক রেখা চিত্রিত হয় সাহিত্যের আকাশে। মনখারাপকে ছুটি দিয়ে দেন নির্জন রেস্তোরাঁয় নিঃসঙ্গ দুপুরে। কিন্তু কী ক্লান্তি আয়ুকে অবসাদে টেনে নেয় মহাকালীন কালো গহ্বরে আর সব স্মৃতিচিহ্ন মুছে দেয় নির্দয় অবাস্তবতার ভেতর। এই দৃশ্য ও পরম দৃশ্যের (বস্তুত অদৃশ্য) ভেতর এক অনিবার্য যোগসূত্র এঁকে দুটোকে করেছেন সমান্তরাল। তাই গুপ্তজীবন প্রকাশ্য মৃতুর মতো গুপ্তমৃত্যু ও প্রকাশ্য জীবনও হয়ে ওঠে সমান সহচর।
‘কয়েকটি তাস’ কবিতায় ‘উপরে নদীর মতো দীর্ঘ আকাশ’ দেখতে দেখতে তাঁর মনে হয়, ‘জানালায় রঙিন রুমাল নিয়ে’ ছেলেগুলোর তাকিয়ে থাকা নিছক তাকিয়ে থাকা নয় আর শুকনো কপি নিয়ে বেড়ালের খেলা আসলে ক্রীড়াচক্র নয়, অন্যকিছু। তাই তিনি বলেন :
কিন্তু এই যাকে তুমি মৃত্যু বলো,
আসলে তা মৃত্যুরই শেষ।
জন্মের মুহূর্ত থেকে তারা ছুটেও আকাশে,
দীর্ঘ এক অবিরত দিন’।
তখন চঞ্চল হরিণীর ক্ষুর আর যুদ্ধশ্রান্ত অশ্বের হ্রেষা মিলেমিশে বনে ও জনপদে এক আকাক্সিক্ষত সত্যের মতো কাব্যবিভাব সৃষ্টি করে। প্রতিটি দিন গুজরান তখন হয়ে ওঠে নিরীক্ষণের এক্সরে আইস। তখন ফুল থেকে মধু আর ভ্রমরার গুঞ্জরণে কাব্য উদ্যান হেসে উঠলে অন্যপৃষ্ঠায় জীবনের এক পরিপাঠ খেলা করে। তাই অগ্রাহ্যের পরও মৃত্যু এসে দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকে চিরায়ত নাছোড়বান্দা। আর এ জন্যই সৈয়দ হক চলে যাওয়াতেও রেখে যান থেকে যাওয়ার বৈভব :
‘কিন্তু আমরা সৃষ্টি করি আমাদের মৃত্যুকে
আর জীবনকে ফেলে রাখি ছুরির মতো
বিপদজনক বাতাসে।’
সময়ের খেলাঘরে একসময় সবকিছু ভেঙেচুরে পড়ে। আর বাতাস এসে উড়িয়ে নিয়ে যায় যত সব পথের ধুলো। তখন আকাশ থেকে জমিনে কিংবা বায়ু থেকে মানুষের শ্বাসে শুধু বিচরণ করে কবিতার অনির্বচনীয় সৌন্দর্য। তাই জীবন মধুময়। তবে কাঁটার আঘাত ছাড়া কি পুষ্পের প্রকৃত গন্ধ পাওয়া যায়? তাই কণ্টকিত যাপনকাষ্ঠার ভেতর বরণ করে নিতে হয় জীবনের পরিভাষ্য। আর এ রপ্তকৃত নবভাষার প্রয়োগেই আক্ষরিক অর্থে মানুষ মৃত্যুকে ভুলে থাকে। যেনো পালিয়ে বাঁচা, যেনো অস্বীকার করে বেঁচে থাকা, যেনো মানুষের মৃত্যু নেই! তবু তো মৃত্যু আছে, তাই সৈয়দ হক যখনই মৃত্যুকে আনেন প্রসঙ্গে, তখনই তাকে গভীর রেখায় করে তোলেন দৃশ্যময় এবং দেন সলিল সমাধির এক নতুনতর সংজ্ঞা। তাই কবিতাসংগ্রহের ‘কবিতা ২২৩’ এ তিনি বলেন :
মৃত্যু শাদাপাখি
জীবনের তৃণ দিয়ে আকাশকে ভরে।
আর কোটি কোটি মৃত্যু দিয়ে একজন
গড়ে তুলে স্বর্গ কি নরকের ঘর।’
কিছু মৃত্যু অন্তরে দাগ কাটে প্রবলভাবে, কিছু মৃত্যু চিত্রিত করে মর্সিয়া। মূলত সকল প্রস্থানই বেদনার চোরাবিষ ঢেলে দেয় জীবন্ত মানুষের মর্মে :
‘একদা যাচ্ছিলাম আত্মহত্যা করতে,
হাতে এসে ঠেকল হার্টক্রেনের বই
যখন বিষ নেবো হাতে।
যেনো বিষের অদৃশ্য হাত দিল বইটাকে ছুড়ে। …
পায়ের নীচে ভাঙা শার্সী জানালার। কাফনের মতো
শাদামুখ থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে জোছনা।’
এক জীবন অফুরন্ত রচনাসম্ভারে তিনি মানুষের জীবনকে ফুটিয়ে তুলেন বহু অভিধায়। ভেঙেচুরে তছনছ করে দেখেন, দেখান অপার রহস্য। উদঘাটনের আনন্দে তাই মধ্যরাতেও চাঁদ হেসে ওঠে আর দুপুরের রোদে তপ্তশ্বাস, বিচুর্ণ বাতাস তখন আলগোছে আলো হাতে এগিয়ে আসে। তখন জীবন সুন্দর হয়ে ওঠে। হাসে ফুল-পাখি, লতাগুল্ম, জলের মাছেরা ঢেউ খেলে চলে যায়। এভাবে অপরের অপর, এক মৃত্যু, এক বিভীষিকা আমাদের কাছ থেকে দূরে থাকে। আমরাও আনন্দযজ্ঞে মেতে চিরজীবিতের ছদ্মবেশে মিশি। কিন্তু ঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়া যায় আকাশবীণার সাত সুরে। তাই মানুষের অনিবার্য আনন্দের ভেতর অনিবার্য কান্নাও প্রাসঙ্গিক :
সে কি এক সঙ্গীতের শেষপর্ব শুনব বলে? নাকি, কবে
শহরের রঙিন মাথায় দুরন্ত রিবনগুলো খুলে যাবে ঘূর্ণিত ঝড়ে,
দুঃশীল আশায় তার বসে আছি অতিশয় অসুস্থ একজন,
নিজের দু’চোখে কবে জ্বলে উঠবে আসন্ন মৃত্যুরা?’
‘এ কেমন মৃত্যু এই নেয় কিন্তু ফেলে রেখে যায়?’ এ প্রশ্নের উত্তর মেলে না। দেহঘড়ি ছেড়ে দমের পাখি কোন্ সুদূরে উড়ে যায় তা তো জানা নেই। আসন্ন মেঘে কোথায় কী ঝড় হবে তা কি বলতে পারে সহস্রাব্দের মল্লার। নোঙর ফেলে তাই ঠায় বসে থাকা যায় না। মৃত্যু অনিবার্য জেনেও মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। তখন জীবন কিংবা মৃত্যু দুটোই হয়ে ওঠে উৎসবের সমার্থক :
মৃত্যুকে জীবন দেয়, জীবনের মৃত্যুকে ভোলায়;
কি কান্তি! তোমার তনু এ-হৃদয়-আসন্ন সন্ধ্যার পটে
নাচায় নিয়ন।’
নদী বয়ে চলে। কালো স্রোত ছেয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম। ভাসায় আত্মীয়-পরিজন। মানুষের দুঃখবোধ তখন চাঙর দিয়ে ওঠে। ভুলতে পারে না মানুষ মৃত্যুকে। ভুলতে চাইলেও মৃত্যুই নিজ যোগ্যতায় তাকে স্মরণের কাছাকাছি রাখে, একদম শাহ রগের নিকটে। আর এই করুণ মৃত্যুর তরজমা করতে পারে না কোনো অনুবাদক। তাই অনিশ্চিত যাত্রাপথের এই নাক্ষত্রিক বিচ্যুতি অবকাশে হাহাকার হয়ে ওঠে মন। কবির অনুজা যেদিন মারা যান, কবর দিয়ে এসে তিনি লেখেন :
‘অনুজার মৃত্যু হলো; সে আমার ছিল না আর কেউ।
কবর দিতে গিয়ে
কাফনের গায়ে দেখলাম
প্রজাপতিÑ
একেবারে হৃদয়ের পরে… যা স্তব্ধ;
যেনো তরঙ্গের ফুলচক্রের মধ্য দিয়ে ক্রমাগত কেন্দ্রের দিকে।’
আবার অনুজার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে কবি লেখেন :
মৃত্যুই নিয়ত টানে। মৃতগণ কখনো কখনো।
আমি অবিরাম জন্ম থেকে মৃত্যুতে আর
আবার নিয়েছি জন্ম …বারবার।’
এ কবিতারই আরেক জায়গায় সৈয়দ হক বলেন :
অথচ মৃত্যুই যেন একমাত্র অচেনা এখানে।
যেনো… অচেনা।
কারণ অত্যন্ত কাছে যা থাকে তা অত্যন্ত দূরের।’
এভাবেই জীবনের প্রজ্ঞা লেখকের কলমকে করেছে বিচিত্র মৃত্যুর তুলি। কখনো ক্যানভাসে এঁকেছেন সাদামাটা, কখনো এঁকেছেন গাঢ় রেখা :
‘শ্যামলের বোন আত্মহত্যা করে কোন
দুঃখে দূর কুড়িগ্রামেÑ আজো, রোজ করেÑ
আজো মাঝেমাঝে রাত দুপুরের গাড়ি
এইখানে বাঁশি দেয়।’
একান্ত আলাপচারিতায় একদিন আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, কীভাবে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও কবিতার জন্য সৈয়দ শামসুল হক ছিলেন ব্যকুল-বেকারার। তাগাদা দিয়ে কাগজ আনান হাসপাতালের বিছানায়। নিজ হাতে লিখতে না পেরে স্ত্রীকে অনুরোধ করেন শ্রুতিলিখন করতে। মৃত্যুমগ্ন সময়েও এমন কবিতামগ্ন থাকা তা শুধু সম্রাটের মতো এসে সম্রাটের মতো চলে যাওয়া সৈয়দ শামসুল হক-এর পক্ষেই সম্ভব। তাই তাঁর কবিতার কথায় বলতে হয় :
‘স্বপ্নবান বারবার মরে
আমার যা অবশিষ্ট আছে তার মৃত্যু যখন হবে
তখন তুমি বলবে
মৃত্যু হলো তোমার একটি অংশের’।