সরকারের তিন বছর-প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

আবদুল মান্নান »

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নানা নাটকীয়তার পর যে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে পরের বছরের ৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়েছিল তার আজ তিন বছর পূর্তি হচ্ছে। সব ঠিক থাকলে আগামী ২০২৩ সালের একই অথবা কাছাকাছি সময়ে দেশে আর একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে সেই নির্বাচনের বিরুদ্ধে যে নানামুখী ষড়যন্ত্র হবে না তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। বর্তমান সরকারের পাঁচ বছরের মধ্যে করোনার কারণে প্রায় দুই বছর একটি অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে কেটেছে। এই করোনা মহামারিতে বাংলাদেশে প্রায় ২৮ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। হয়তো আরো বেশি হতে পারতো তবে তা না হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়োচিত কিছু পদেক্ষপ ও নির্দেশনা। মহামারির শুরুতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অদক্ষতার পরিচয় দিলেও তা পরবর্তিকালে কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। প্রথম থেকে এই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় একটু সচেতন হলে মানুষের দুর্ভোগ কিছুটা হলেও কমতো।
ভারত তাদের দেশ হতে টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দিলেও বাংলাদেশ দ্রুত অন্য দেশ থেকে টিকা আমদানির বা সংগ্রহের ব্যবস্থা করে। করোনা মোকাবেলায় বর্তমান সরকার এই অঞ্চলের যে কোন দেশের তুলনায় ভালো করেছে, যেমনটি ধরে রাখতে পেরেছে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, যদিও এই মহামারিকালে অনেকে প্রথম দিকে বেকার হয়েছিলেন তবে তারা বর্তমানে তা কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছেন। বিশ্বের অনেক দেশে করোনা কালে মানুষের খাদ্যাভাবে মৃত্যু হয়েছে যা বাংলাদেশে হয়নি। সরকার ও বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান অনেকের বাড়ি বাড়ি বিনামূল্যে খাদ্য পৌঁছে দিয়েছে। এই সময় সম্ভবত সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে শিক্ষা খাতে। বর্তমান সরকারের আমলে দেশের বিদ্যুৎ খাতে প্রভূত উন্নয়ন হয়েছে, থেমে থাকেনি কোন মেগা প্রকল্পের কাজ। দেশে সাম্প্রদায়িক সমস্যা সৃষ্টি করতে একটি মহল সর্বদা তৎপর ছিলো কিন্তু সরকারের দৃঢ় ও দ্রুত হস্তক্ষেপের কারণে তা বেশী দূর অগ্রসর হতে পারেনি।
যেহেতু সংসদ নির্বাচনের আর দু’বছর বাকি সেহেতু এখন সময় হয়েছে বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় শরিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গত তিন বছরের অর্জন ও ব্যর্থতার খতিয়ান তৈরি করা। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার ইতিহাস আছে তাই এই বিষয়গুলো নিয়ে তাদের আরো বেশি চিন্তা করতে হবে। ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ধস নামানো বিজয় ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৯ এর ৬ জানুয়ারি সরকার গঠন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা কারণ এই সেই শেখ হাসিনা যাঁকে বেগম জিয়ার পুত্র তারেক রহমান ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড মেরে হত্যা করতে চেয়েছিল। এরপর শেখ হাসিনা অনেক বাধা অতিক্রম করে পরপর তিন মেয়াদে এখন সরকার প্রধান হিসেবে দেশ পরিচালনা করছেন।
অনেকে বলেন ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে ও আওয়ামী লীগ ৩০ তারিখের অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন ২৯ তারিখ রাতে সেরে ফেলেছে। বাস্তবতা হচ্ছে প্রথমে বিএনপি এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার জন্য নানা ধরনের টালবাহানা করেছে। পরে বঙ্গবন্ধুর কৃপাধন্য ড. কামাল হোসেনকে নেতা মেনে নির্বাচনে অন্যান্য সমমনা দলকে নিয়ে অংশ নিয়েছে যার মধ্যে বার জন প্রার্থী নিয়ে জামায়াতও অংশ নিয়েছে। নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্তটা মূলত লন্ডনে পলাতক বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক জিয়ার নির্দেশে কারণ এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশাল মনোনয়ন বাণিজ্য হয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। বাণিজ্যের পরিমাণ এমনও ছিল যে অনেক আসনে বিএনপি একাধিক প্রার্থীর কাছে মনোনয়ন বিক্রি করেছে। তা জানতে পেরে অনেক স্থানে বিএনপি প্রার্থীরা কোন নির্বাচনী প্রচারণা চালায়নি। আমার কেন্দ্রে আমি বেলা বারটায় ইভিএম মেশিনে ভোট দিয়েছি কিন্তু ঠিক মতো জানতে পারিনি ওখানে বিএনপি প্রার্থী কে? এই চিত্র দেশের বেশির ভাগ আসনের ক্ষেত্রে।
বিগত বছরগুলোতে সরকারের অর্জন অনেক। সবচেয়ে বড় অর্জন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এই কোভিড মহামারি মোকাবেলা করেও জাতিসংঘের তালিকায় স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটানো। এই মহামারি কালে যখন বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন মারাত্মক ভাবে ব্যাহত হয়েছে তখন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল স্বীকার করেছে ‘করোনায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ’। প্রথম দিকে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প হোঁচট খেলেও কিছুদিনের মধ্যেই তারা আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং তাতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে সরকার আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে। সরকারের অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবদুর রউফ তালুকদার সম্প্রতি অর্থনীতিবিদদের এক সেমিনারে বলেছেন, বিশ্বের ৪১টি শীর্ষ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশের মধ্যে মাত্র আটটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক ছিল গত অর্থ বছরে। এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক ছিল।
বিগত তিন বছরে সরকারের সব কাজ যে প্রশংসাযোগ্য ছিল তা কিন্তু নয় এবং তা প্রত্যাশিতও নয়। কোন দেশের সরকার এটা দাবি করতে পারে না যে তারা যা করেছে তা সব ভাল করেছে। নানা কারণে যে কোন দেশের যে কোন সরকারের সময় বেশ কিছু অজনপ্রিয় ও অপ্রত্যাশিত বা ক্ষতিকর কাজ হয় এবং তা হয় কখনো কখনো নীতিনির্ধারকদের ভ্রান্ত নীতির কারণে অথবা সরকারকে বেকায়দায় ফেলার উদ্দেশ্যে। যেমন, বর্তমান সরকারের তিন বছর পূর্তির ঠিক আগের মুহূর্তে ২০২১ এর শেষ দিনে আমানতকারিদের ব্যাংক একাউন্ট হতে কোন পূর্ব অনুমতি বা জানানো ছাড়া আবগারি শুল্ক হিসেবে একটি বড় অংকের টাকা কেটে রাখা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে একাউন্ট হোল্ডারকে ব্যাংক বছর শেষে যে সুদ দিয়েছে তার চেয়ে কেটে রেখেছে বেশি। দীর্ঘমেয়াদী সময়ে এটি একটি মারাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে এবং ব্যাংক আমানত কমে যেতে পারে যার ফলে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ পুঁজি সরবরাহে অপারগ হতে পারে। এমনিতে ব্যাংকের আমানতের সুদের হার আর মুদ্রাস্ফীতি বর্তমানে সমানে সমান। এর ফলে বিদেশে পাচার হতে পারে দেশের অর্থ বা মানুষ তার অপ্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করে মূদ্রাস্ফীতিতে অবদান রাখতে পারে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের অবস্থা বেশ নাজুক। সময় এসেছে পুরো ব্যাংকিং খাতকে ঢেলে সাজানোর।
সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ রাজনৈতিক। বর্তমান সরকারে বাস্তবে আছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সেই দলের প্রধান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। এবার করোনার কারণে যেহেতু শেখ হাসিনা সরকারি বাসভবনে বসেই প্রায় সব সিদ্ধান্ত নেন, তিনি জনগণ হতে কিছুটা হলেও বিচ্ছিন্ন সেহেতু তাঁর অগোচরে অনেক সময় ভুল তথ্যের ভিত্তিতে অনেক সিদ্ধান্ত নেন যা পরবর্তিকালে বুমেরাং হয়ে যেতে পারে। সম্প্রতি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে মনোনয়ন তার একটি বড় উদাহরণ। আমার এক পরিচিতজন নিজ বাড়ি গিয়েছিল ভোট দিতে। তিনি জানালেন প্রার্থী তালিকা দেখে মনে হলো ওটি এলাকার সর্বাধিক খ্যাতিমান দূর্বৃত্তদের তালিকা যার মধ্যে আওয়ামী লীগ হতে মনোনীত প্রার্থীও আছেন। পরিস্থিতি এমন হয়েছে দলের সাধারণ সম্পাদকের ঘোষণা অনুযায়ী বিদ্রোহী প্রার্থীদের বহিষ্কার করা হবে। তা যদি বাস্তবে হতেই থাকে তাহলে সামনের নির্বাচনে অনেক কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের কোন নেতা কর্মী পাওয়া যাবে না। আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে খ্যাত ফরিদপুরে নয়টি ইউনিয়নের আটটিতে নৌকা মার্কার প্রার্থীর ভরাডুবি হয়েছে। সারা দেশে এই পর্যন্ত প্রায় ত্রিশ জন প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। এটি কেন শেখ হাসিনাকে মেনে নিতে হবে? সময় এসেছে কাদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে, মনোনয়নের সময় তৃণমূলের কোন পরমার্শ নেয়া হয়েছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা। এই সব অপদার্থদের মনোনয়ন নিয়ে বাণিজ্য হয়েছে বলে সর্বসাধারণের ধারণা। এই ধারণাতো অমূলক নয় তা সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায়। শেখ হাসিনাকে জানতে হবে সরকারের আইন অমান্য করে কাদের কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হয়েছে। আরো একটি সত্য কথাকে স্বীকার করতেই হবে। এই তিন বছরে আওয়ামী লীগে বানের পানির মতো জামায়াত বা বিএনপি’র নেতা কর্মীরা ঢুকেই পড়েনি, কোন কোন এলাকায় তাদের সংখ্যা আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীর চেয়ে বেশি হয়ে গেছে। এরা সকলেই দুধের মাছি। দল ক্ষমতায় না থাকলে এদের কেউ আর ধারে কাছে থাকবে না। মঙ্গলবারের একটি জাতীয় দৈনিকে খবর দিয়েছে দেশের একই বড় মহানগরে এই দুধের মাছি জোগাড় করার জন্য এক শ্রেণির আওয়ামী লীগ নেতা বেশ তোড়জোড় করছে।
এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনার কোন বিকল্প তৈরি হয়নি। ২০২৩ সালের নির্বাচনের আগে তাঁর সামনে করণীয় অনেক। প্রথমে দলের খোল নলচে পাল্টাতে হবে। দলের ভিতরে গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে দলের কে কত বড় ক্ষতি করছে তাদের সনাক্ত করাটা জরুরি। একজন ডা. মুরাদের কথা সকলে জানেন কিন্তু দলে আরো কত মুরাদ আছে তা কি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানেন? দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ একবার বলেছিলেন ‘আওয়ামী লীগ একটা অনুভূতির নাম’। সেই অনুভূতি কি দলের অভ্যন্তরে সকলের আছে? বর্তমানে উত্তরাধিকার সূত্রে অনেকে দলের পদ পদবি আর মন্ত্রিত্ব বাগিয়েছেন। তাদের ক’জনের এই ‘অনভূতি’ আছে তাতো জানতে হবে। তারা সকলে নিজেদের আখের গুছাতে ব্যস্ত। সব কিছু দলের প্রধান করবেন এই সংস্কৃতি হতে বের হয়ে আসতে হবে। দেশের একটি বড় সমস্যা এক শ্রেণির সরকারি আমলা, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ীদের লাগামহীন দুর্নীতি। এটি বন্ধ করার উপায় খুঁজতে হবে। আমলদের দাপটে মাঝে মাঝে মনে হয় সরকার অসহায়। নির্বাচনের সময় জনগণ এই সব বিচার বিশ্লেষণ করে। অনেক ক্ষেত্রে দেশে সুশাসনের ঘাটতি আছে। তা নিশ্চিত করাটা আবশ্যিক। একইভাবে দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানেগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে।
২০০৯ সালের পর হতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলে দেশ বর্তমান সময়ে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এত চোখ ধাঁধানো উন্নতি করেছে। ২০২৩ সালের নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগকে যদি ভোট দিয়ে আবার নির্বাচিত করে তা হলে সরকার প্রধান হিসেবে হাল ধরতে হবে শেখ হাসিনাকেই। মালয়েশিয়ার ডা. মহাথির মোহাম্মদ বিভিন্ন মেয়াদে ২৪ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। সর্বশেষ তিনি যখন ক্ষমতা ছাড়েন তখন তাঁর বয়স ৯৪। সিঙ্গাপুরের প্রেসিডেন্ট লী কুয়ান একত্রিশ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তাঁরা তাদের দেশের চেহারা পাল্টে দিয়েছেন। কাজের মানুষের বয়স কোনে বিষয় নয়। শেখ হাসিনা যে কাজের মানুষ তা নতুন করে প্রমাণ করার প্রয়োজেন নেই। তবে তিনি আগামীতে কাদের নিয়ে পথ চলবেন তা তাঁকে সতর্কতার সাথে বিবেচনা করতে হবে।

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক।