যোদ্ধা

জসিম উদ্দিন মনছুরি »

খানসাহেব বিস্তর পড়াশোনা জানা জ্ঞানী লোক। কাস্টমসে চাকরি করেন। খুব নামডাক তাঁর। সবাই সম্মানের চোখে দেখে। মহল্লায় তাঁর বেশ প্রভাব-প্রতিপত্তি। তিনি জমিদারের ছেলে জমিদার। চাকরির ফাঁকে বিশাল সহায়-সম্পত্তি তিনি নিজেই দেখাশোনা করেন। মহল্লায় পাকাঘর বলতে খান সাহেবেরটাই বোঝায়। তাঁর ছয় সন্তান। সবাই যার যার অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত। শুলুকুল বহরে তাঁদের বসবাস।
চৌধুরী সাহেব পাকিস্তান সরকারের আস্থাভাজন নেতা। পূর্বপাকিস্তানের ন্গরিক। চৌধুরী সাহেব খানসাহেবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। চৌধুরী পশ্চিম থেকে পূর্ব পাকিস্তানে এলে খান সাহেবের সাথে দেখা না করে যান না। দুই বন্ধুর মধ্যে বেশ মিল রয়েছে। পূর্বের উন্নয়ন তাঁর হাত ধরে কম হয়নি। খোদ সরকার চৌধুরী সাহেবের মত ছাড়া কিছু করে না। চৌধুরী সাহেবদের যৎসামান্য উন্নয়নে পূর্বপাকিস্তানের জনগণ তেমন একটা খুশি নয়। গতকাল চৌধুরী সাহেব দেশেএসেছেন। খান সাহেবের ডাক পড়ে।
চৌধুরী : খান সাব আঁরে কি ভুলি গেইয়্যইগে না?
খান : অনে সরকারের মস্ত বড় হর্মহর্তা, অনের সময় বহুত মূল্যবান।
চৌধুরী : বন্ধুল্লায় সময়? ইন কী হঅ খানসাব।
খান : পূর্বপাকিস্থানত বিশেষ গরি চট্টগ্রামত এ্ক্কান মেড়িকেল, এক্কান ভার্সিটি দরহার। সুযোগ পাইলে চেষ্টা গরি চাইয়্যুন।
চৌধুরী : খানসাব, আঁই কি চেষ্টা হম গরির না? সুযোগ পাইলে মত্তে হাম গরি দিওম। দোয়া গরো চাই কি গরা যায়।
চৌধুরী সাহেব খানসাহেবকে চা দেওয়ার জন্য তাড়া দেয় মিন্নত আলিকে। মিন্নত, খান সাবেরল্লায় চা আান। গনি বেহারির বেলা বিস্কুট আন্নিদে হেত্তুন বিস্কুট দিস।
গনি বেকারীর বেলা বিস্কুট খানসাহেবের অত্যন্ত প্রিয়। উনি নিজেও গনি বেকারি থেকে বেলা বিস্কুট নেন। এই বেলা চট্টগ্রামে চায়ের সঙ্গে প্রিয় খাবার। সুস্বাদু বিস্কুট।
অনেকক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর খানসাহেব ও চৌধুরী পরস্পর পরস্পরকে বিদায় জানালেন। পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেলেন চৌধুরী। খানসাহেব চাকরিতে মগ্ন রইলেন। গ্রামের সালিশ-বিচার আর চাকরি নিয়ে অবসর যাপনের বিশেষ সুযোগ নেই তাঁর। তার ছোট ছেলে সেলিমকে খুবই ভালোবাসেন তিনি। সেলিমেরও পড়ালেখার পাশাপাশি দুষ্টুমির শেষ নাই। তবে খুবই মেধাবী সে। যে কোনো কিছু একবার দেখলে বা পড়লে তার সহজে মুখস্থ হয়ে যায়। তাই তার দুষ্টুমি সত্ত্বেও খানসাহেব সেলিমকে খুবই ভালোবাসেন। মহল্লায় সেলিম দুষ্টুদের সরদার। তার বন্ধুসংখ্যাও বহু। সবার নেতৃত্ব দেয় সে।
তাদের বাড়ির উত্তর পাশে বয়ে গেছে একটি ছোট্ট খাল। খালবিলে তখন প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। সেদিন স্কুল বন্ধ থাকায় সেলিম বন্ধুদের নিয়ে খালে মাছ ধরতে যায়। পাওয়াও গেল বেশ। কোন্ ফাঁকে সেলিমের হাতে শিংমাছ কাঁটা ঢুকিয়ে দিল। সেলিম যন্ত্রণায় অস্থির। বন্ধু নয়ন বলল, সেলিম, হাতে মুতে দে, দেখবি ব্যথা কমে যাবে।
সেলিম : কি বলিস, হাতে কি মুতা যায়?
নয়ন : ব্যথা কমাতে চাইলে আমি যেটা বলছি, সেটাই কর।
সেলিম হাতে প্রস্রাব করে দেয়। দেখা গেল, এই থেরাপি ঠিকই ভালো কাজ দিয়েছে। চট্টগ্রামের হলেও সেলিমদের বাড়িতে শুদ্ধভাষার চর্চা হতো। শহরের কিছু বনেদি পরিবারে কমবেশি শুদ্ধভাষায় কথার রেওয়াজ আছে এখনও।
সরকারের দ্বিমুখী নীতির কারণে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ চরম অসন্তুষ্ট। নির্যাতন-নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের সাত মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দেন। তখন বাঙালি যুবাপুরুষ-নারী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। হানাদার পাকিস্তান সরকার ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট নাম দিয়ে নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যায় মাতে। ওই রাতেই বঙ্গবন্ধুকে আটক করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন বাঙালি স্বাধীনতার জন্য তুমুলভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘোরতর যুদ্ধ শুরু হয়।
খানসাহেবের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা নিয়মিত যাতায়াত করতে থাকে। বলতে গেলে প্রতি রাতেই তার বাসায় মিটিং হয় গেরিলাদের। সে সংবাদ রাজাকারদের কানে যেতে বিলম্ব হলো না। পাকিস্তান সেনারা একরাতে খানসাহেবের বাসায় হামলা চালায়। গেরিলারা যে যার মতো পালিয়ে গেল। খানসাহেবের বাড়ির পাশের রোডের পূর্বপাশে ঝোপঝাড়ের মতো ছিল। খানসাহেবের ছেলে লল্লা একটি চাদর পেঁচিয়ে ঝোপে আশ্রয় নিল। সেনাবাহিনী লাইট বন্ধ করে যে যার মতো দাঁড়িয়ে ছিল। লল্লা মনে করেছিল সেনাবাহিনী চলে গেছে। ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসতেই লল্লাকে সেনাবাহিনী আটক করে। তাদের গোপন দুর্গে নিয়ে যায়। পাশে তখন সেলিমও ছিল। সেলিম দৌড়ে পালিয়ে যায়। খানসাহেবের পরিবার শোকে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও খানসাহেব চৌধুরীকে তার ছেলেকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে গেলেন। চৌধুরীর সাফ জবাব, তোমার একটি ছেলের জন্য আমি আমার ইমেজ নষ্ট করতে পারি না। অগত্যা খানসাহেব অশ্রুসজল নয়নে বাড়ি ফিরে এলেন। গেরামে তার প্রচুর সহায়-সম্পত্তি ছিল। এদিকে যুদ্ধ প্রচণ্ড রূপধারণ করে। এক রাতের অন্ধকারে খানসাহেব তাঁর পরিবার সদস্যদের গ্রামে পাঠিয়ে দিলেন। খানসাহেবের পরিবার লল্লার জন্য শোকে মুহ্যমান হয়ে রইল। সবার ধারণা, লল্লাকে হত্যা করা হয়েছে। লল্লার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিসংগ্রাম বিজয়ের পথে। এমতাবস্থায় একদিন সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি আসলো তাদেও বাড়ির সামনে। সবাই ভয়ে পালিয়ে গেল। পাকিস্তান আর্মিটি লল্লাকে নিয়ে এসেছিল। ভীতসন্ত্রস্ত লল্লাকে তার মায়ের হাতে তুলে দিল সেনাটি। ছেলেকে ফিরে পেয়ে মা খুশিতে আত্মহারা। পাকিস্তান সেনাসদস্যটি উর্দুতে যা বলল তার অনুবাদের সারসংক্ষেপ হলো, মা আমি আপনার ছেলের জন্য যা করেছি আল্লাহর উদ্দেশ্যেই করেছি। আপনার ছেলেকে আপনার হাতে তুলে দিয়ে গেলাম। আমার জন্য দোয়া করবেন। এরপর গাড়িটি দৃশ্য হয়ে গেল। এই দৃশ্যে লোকসমাগম হলো। লল্লাকে তারা প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করতে লাগলো।
লল্লা : সেনাবাহিনী আমাকে নিয়ে যাওয়ার পর একটি বদ্ধঘরে রেখেছিল। সেখানে সিলিংফ্যান ছিল। ফ্যানের সাথে পা বেঁধে মাথা নিচের দিক দিয়ে ঘোরানো হতো। এভাবে বেঁহুশ হয়ে যাওয়ার পর কখন-কীভাবে যে হুঁশ আসতো, আমার মনে নেই। হুঁশ ফিরলে দেখা যেত কে যেন চুপিচুপি বলছে, খেয়ে নাও। এভাবে কতদিন কত রাত অতিবাহিত হয়েছে। অনেককে গুলি করে তার সামনেই হত্যা করা হয়েছে। সেই বীভৎস্য দৃশ্য মনে পড়লে লল্লার মাথা ঘোরে, বমি করে।
সুঠাম দেহের অধিকারী লল্লা দিন দিন শুকিয়ে যেতে লাগলো। খানসাহেব তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন। বড় বড় ডাক্তার দেখালেন। কিন্তু সেই আঘাত সহ্য করতে না পেরে মানসিক যন্ত্রণায় লল্লা একটি ভোরে পাখির কূজনের ভেতর উড়ে-উড়ে অচিনপুরে চলে গেল।
দেশ স্বাধীন হলো লল্লা-সেলিমদের আত্মত্যাগে। সনদ না থাকায় তার ছেলে সন্তানেরা চাকরির তীব্র প্রতিযোগিতায় ঠাঁই পেল না। লাল-সবুজের মানচিত্রে লল্লাদের অদৃশ্য রুধির ভেসে ওঠে। লল্লাদের অদৃশ্য আত্মা ক্ষণে-ক্ষণে আসে, প্রার্থনায়, জাতীয় সংগীতে। কখনও মেঘের ভেলা হয়ে গর্জন তুলে। জলোচ্ছ্বাসের তীর হয়ে, আশার প্রতীক হয়ে। স্বাধীনভূমির স্বাধীনতার উল্লাস হয়ে।