যে ভাষণে সৃষ্টি আজকের বাংলাদেশ

মো. মামুন অর রশিদ চৌধুরী »

পাকিস্তানের ¯ৈ¦রশাসকের রক্তচক্ষু আর ভয়ভীতি উপেক্ষা করে আজ থেকে ৫০ বছর আগে লাখো জনতার সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন “এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, ¯¦াধীনতার সংগ্রাম”। কিছু কিছু ভাষণ অত্যন্ত শক্তিশালী, যা কখনো কখনো ইতিহাস রচনা করে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ এমনই এক ইতিহাস রচনা করেছে, যার সমাপ্তি হয়েছে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসে¤¦র বাংলাদেশের ¯¦াধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানি ¯ৈ¦রশাসকদের শোষণ থেকে মুক্তিকামী বাংলাদেশি মানুষকে এই ভাষণ দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে।
ভাষণে কি যেন এক স¤েমাহনী শক্তি ছিলো। সমস্ত বক্তব্য জুড়ে মুক্তির একটা আকাক্সক্ষা ছিলো। পাকিস্তানি ¯ৈ¦রশাসকদের শোষণ আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাঁর এই বজ্রকণ্ঠের ঘোষণা বাংলার মানুষকে পরাধীনতার শিকল ভাঙার জন্য বদ্ধপরিকর করে তোলে। শুধুমাত্র একটি পৃথক রাষ্ট্র নয়, এই আহ্বান ছিলো বাংলার মানুষকে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক নিষ্পেষণ থেকে মুক্ত করার জন্য।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ এর কবল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশ মুক্ত হলো দুটি খ-ে বিভক্ত হয়ে -ভারত ও পাকিস্তান। আশ্চর্যজনকভাবে দেশ দুটি বিভক্ত হলো ধর্মের ভিত্তিতে। অবিভক্ত ভারতের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে গঠিত হলো পাকিস্তান-যার একখ- ভারতের পশ্চিমে (তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান), অপরখ- ২২০০ কিলোমিটার দূরে ভারতের পূর্ব পাশের্¡ যার তৎকালীন নাম পূর্ব পাকিস্তান। এই দুটি ভূখ-ের মধ্যে এক ইসলাম ধর্ম ছাড়া না ছিলো ভাষার মিল, না ছিলো সংস্কৃতি বা মানসিকতার মিল। আর এর শাসনভার দেওয়া হলো পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে যারা শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তানিদের অবহেলা আর অবজ্ঞার চোখে দেখা শুরু করলো। দেশ ভাগের প্রথম থেকেই রাজনৈতিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিরা প্রভুর বেশে আবির্ভূত হতে থাকলো। আর এ দেশকে অর্থনৈতিকভাবে শোষণের নেশায় মেতে উঠলো।
শোষণ আর বঞ্চনা চলতে থাকে।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ছয় দফা দাবির জন্য আন্দোলন শুরু করে। পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগের প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখান করে এবং তৎকালীন সামরিক সরকার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাগারে প্রেরণ করে।
১৯৭০ সালের ৭ই ডিসে¤¦র অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ টি আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসনে নিরংকুশভাবে জয়লাভ করে। সে হিসেবে সমগ্র পাকিস্তানের ৩১৩ টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ অর্ধেকের বেশি আসনে জয়লাভ করে। ৭ই ডিসে¤¦রের নির্বাচনে ভরাডুবির পর পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ ১৯৭১ সালে জাতীয় সংসদের অধিবেশন আহ্বান করেন। একই সাথে পাকিস্তান পিপল্স পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং শাসকগোষ্ঠী নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করার জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করে।
১লা মার্চ, ১৯৭১ সালে বাংলার মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন ইয়াহিয়া খান কি ঘোষণা দেন তা শোনার জন্য। কিন্তু সবাইকে হতাশ করে ইয়াহিয়া খানের পরিবর্তে তার একজন মুখপাত্র ঘোষণা করলেন, “পরবর্তী ঘোষণা না আসা পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের সকল অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত করেছেন”। তিনি মন্তব্য করেন যে, পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি একটি গভীর রাজনৈতিক সংকট। এই ঘোষণায় ¯পষ্ট হয়ে গেলো পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাদের নির্লজ্জ পরাজয় মেনে নেবে না আর রাষ্ট্রক্ষমতা পূর্ব পাকিস্তানিদের হাতে দেবে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংবাদ স¤েমলনে বললেন যে, এটা কোন রাজনৈতিক সংকট নয় বরং পাকিস্তানি শাসকদের ¯ৈ¦রাচারী মনোভাবের প্রকাশ।
তিনি আরও বলেন, বাঙালিরা এই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করেছে। তিনি ২রা মার্চ ঢাকায় এবং ৩রা মার্চ দেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দেন। বাঙালিদের তিনি তার পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে বলেন। এই প্রথম বাঙালিরা ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ ¯¦াধীন করো’ শ্লোগানে ¯¦াধীনতার ডাক দেন।
১৯৭১ সালের ২রা মার্চ ঢাকা পরিণত হলো শ্লোগান আর মিছিলের নগরীতে। সকাল থেকেই ঢাকা বিশ¡বিদ্যালয় অভিমুখে মিছিলের জোয়ার আসতে থাকে। বিশ¡বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গর্বের সাথে ¯¦াধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হয়। এই আন্দোলনকে দমিয়ে দেবার জন্য নিরস্ত্র সংগ্রামীদের ওপর নির্দয়ভাবে গুলি চালানো হয়। কমপক্ষে ৫০ জন গুলিবিদ্ধ অব¯হায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। তেজগাঁও পলিটেকনিক কলেজের দুই জন ছাত্র শহীদ হন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা অনির্দিষ্টকালের জন্য সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করে। সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু সংবাদ স¤েমলনে নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলি চালানোর তীব্র নিন্দা জানান। তিনি ৩ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত অর্ধ দিবস হরতালের ডাক দেন। পরের দিন তিনি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাথে বৈঠক শেষে পল্টনে একটি সমাবেশের ঘোষণা দেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সেই দিন থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের শব্দকোষ থেকে ‘পাকিস্তান’ শব্দটির ব্যবহার বিবর্ণ হতে থাকে। সন্ধ্যার সংবাদ স¤েমলনে বঙ্গবন্ধু বার বার ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি উচ্চারণ করছিলেন। পরবর্তীতে ৩রা মার্চ ছাত্রলীগ এবং শ্রমিক লীগের এক সভায় ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তিনি বলেন “আমি এখানে থাকি আর না থাকি বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম চলবে। বাঙালির রক্ত বৃথা যেতে পারে না। আমি যদি না থাকি, আমার সহকর্মীরা নেতৃত্ব দেবে। যদি তারা মারা যায়, তবে যারা বেঁচে থাকবে তারা নেতৃত্ব দেবে। লড়াই যে কোন মূল্যে চালিয়ে যেতে হবে। অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে”। এর আগে তিনি ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জাতির জন্য তাঁর পরবর্তী নির্দেশনা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছিলেন।
দিন যতই এগোতে থাকে বাঙালির ¯¦াধীনতার জন্য এক দফা দাবি তীব্র হতে থাকে। এদিন সামরিক জান্তার চাপিয়ে দেয়া কারফিউ ভেঙে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। খুলনায় বাঙালিদের সাথে অবাঙালিদের সংঘর্ষ হয়। লাগাতার হরতালের কারণে ঢাকা সহ সারাদেশ কার্যত নিশ্চল হয়ে পড়ে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো রেডিও পাকিস্তান ঢাকার নামকরণ করা হলো ঢাকা বেতার কেন্দ্র হিসেবে ।
৭ই মার্চের একদিন আগে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাথে বঙ্গবন্ধুর ফোনালাপ হয়। ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে জানান যে, পরবর্তী সংসদ অধিবেশন ২৫শে মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে। তা সত্ত্বেও ৭ই মার্চ সমাবেশকে সামনে রেখে ট্যাংক এবং সামরিক অস্ত্রশস্ত্র ঢাকার রাস্তায় মোতায়েন করা হলো। পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা বঙ্গবন্ধুকে ¯পষ্ট হুঁশিয়ারি জানালেন “পাকিস্তানের ঐক্যের বিপরীতে কিছু বললে শক্তভাবে তা দমন করা হবে। দেশদ্রোহীদের (বাঙালি) নিশ্চিহ্ন করার জন্য ট্যাংক, কামান এবং মেশিনগান প্রস্তুত আছে। প্রয়োজনে ঢাকাকে মাটিতে মিশিয়ে ফেলা হবে। শাসন করার জন্য বা শাসিত হওয়ার জন্য কেউ থাকবে না”
বাংলার জনগণের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রুখবার মতো শক্তি কারও ছিলো না। তিনি ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দিলেন, বাংলার মুক্তিকামী মানুষের জন্য স¤পূর্ণ দিক নির্দেশনা দিলেন, ¯হাপিত হলো ¯¦াধীন বাংলাদেশের ভিত্তি। পরাধীন একটা জাতি কিভাবে নিজ দেশকে শত্রুমুক্ত করে ¯¦াধীনতা ছিনিয়ে আনবে তার স¤পূর্ণ রুপকল্প আর কর্মপরিকল্পনাই হচ্ছে ৭ই মার্চের ভাষণ। বস্তুত ঐ দিন থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনগণ ¯¦াধীন বাংলাদেশের ¯¦প্ন দেখতে শুরু করে।

লেখক : প্রাবন্ধিক