বড় ছেলে

আবু মোশাররফ রাসেল :

তপ্ত রোদ। বাবা খেত থেকে বোঝা কাঁধে বাড়ি  ফেরেন। বোঝা বয়ে আনতে তিনি হাঁপিয়ে উঠেছেন। উঠানের কাছাকাছি বাবার ডাক শুনলেই মা ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এসে বোঝাটি নামিয়ে নেয়। পানির কলটি কিছুক্ষণ চেপে, ওপরের পানি ফেলে দিয়ে এক জগ ঠান্ডা পানি বাবার হাতে তুলে দিতে দিতে মা আক্ষেপ করেন, ‘আহা, মানুষটা আর কত পারে? একজনের আয়ের সংসার, কত কঠিন। ছেলেগুলো বড় হলে তোমার কষ্ট আর থাকবে না।’ বাবার মনে অবশ্য কোনো দুঃখ নেই। হাসিমুখে কাজ করে যান। তিনি মেনে নিয়েছেন, এভাবেই চলতে হবেÑ এটাই জীবন। আমরা পাঁচভাই-দুই বোনের বিশাল সংসার একা টেনে চলেছেন তিনি। বাবা খেত থেকে ফিরলেই মায়ের  সেই আক্ষেপ শুনি, ‘একটা মানুষ আর কত পারে! ছেলেগুলো বড় হোক, তোমার কষ্ট আর থাকবে না।’

আমার স্কুলজীবন পর্যন্ত বাবার সংসারটি যে টানাটানির, এটুকু বুঝতাম। কলেজে ওঠে মায়ের সেই আক্ষেপের অর্থ পুরোপুরি বুঝতে পারছিলাম। মা চাইছিলেন, আমরা ছেলেরা বড় হয়ে যাই আর বাবার কাজের হাল ধরি। বাবাকে নিত্যদিনের পরিশ্রম থেকে মুক্তি দিই। একদিন কলেজ থেকে ফিরতে আমারও মনে হতে থাকলোÑ বাবা প্রতিদিনই হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন, তিনি আর কতই বা পারেন! আমি কলেজে পড়ি মানে আমি তো বড় হয়ে গেছি। বাবার বড় ছেলে হিসেবে আমারই তো কিছু করা উচিত। মাকে বললাম, আমি বাবার কাজের হাল ধরতে চাই। বাবার সামান্য যে জমিটুকু আছে, বেচে দিয়ে আমাকে বিদেশ পাঠাতে বলুন। মা আমার কথায় অন্যরকম খুশিতে মেতে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে বাবাকে বললেন। বাবাও রাজি হয়ে গেলেন। জমিটা বিক্রি করে ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে তিনি সংসারের ঘানি টানা থেকে কিছুটা হলেও রেহাই চান।

অল্প কিছুদিনের মধ্যে জমিটি বিক্রি করে দিলেন বাবা। সেই টাকায় এক আত্মীয়ের মাধ্যমে আমিরাতের ভিসাও জোগাড় করে ফেললাম। ছোট ভাইবোনদের খুব মনখারাপ হলো। বোনটির বড় সাধ ছিল, আমি পড়ালেখা করে কলেজের অধ্যাপক হবো। তাই সে কান্নাজুড়ে দিল। আমি তাদের বুঝালাম,আমি তোদের সবার বড়, পরিবারের বড় ছেলে। বাবার একার আয়ে সংসার চলছে না। আমি টাকা পাঠাবো, তোমরা পড়ালেখা করবে, সুন্দরভাবে-সচ্ছলভাবে চলবে। মায়ের অনুভূতিটা ঠিক আঁচ করা গেল না। তিনি দুধরনের কথা বলছেন। মা, সম্ভবত দোটানায় পড়েছেনÑ আমার জন্য মায়া লাগছে আবার সংসারের অভাব দূর করতে এটা ছাড়া যে উপায় নেই, সেটাও ভাবছেন। তিনি একবার বলছেনÑআহা, আমার বড় ছেলেটাকে দূরে পাঠিয়ে কিভাবে থাকবো? আবার বলছেন, ছেলে দুবাই থেকে অনেক টাকা কামাই করবেÑআমরা বড়লোক হয়ে যাব।

আমার চোখে অনেক স্বপ্ন জ¦লজ¦ল করছে। আমিরাত গিয়ে টাকা কামাই করবো, দেশে পাঠাবো। বাবাকে আর এমন খাটুনি করতে হবে না প্রতিদিন। ছোট ভাইবোনদের পড়ালেখাবন্ধ হবে না। বোন দুটিকে বিয়ে দিতে হবে। সুন্দর একটি বাড়ি করবো।আরও কত কি। মাকে আর আক্ষেপ করতে হবে না বাবার জন্য। সবার সুখের কথা চিন্তা করে, পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে বিদেশে পাড়ি জমালাম।

গ্রামের সহজ-সরল জীবনে অভ্যস্ত সবে কৈশোর পেরোনো এই আমি দুবাই শহরের আলোর ঝলকানিতে বিমোহিত থাকি কয়েকদিন। এখানে জীবন যেন এক অন্যরকম বিলাসিতা, কারও হাতে সময় নেই। সবাই ছুটছে আর ছুটছে। ভিসা দেওয়ার আগে যে স্বজনেরা ফোনে বলেছিল, দুবাই আসলেই সব ব্যবস্থা করে দেবেÑ তাদেরই কী কদর্য চেহারা দেখছি এখন। ফোনে যা বলেছিল তার কিছুই ঠিক নেই।  তাদের আচরণ ঠিক উল্টো। আমার জন্য কারও বিন্দুমাত্র সময় নেই, মায়া নেই। একটি বহুতল ভবনের এক ফ্ল্যাটের মেসে কোনো প্রকার থাকার বন্দোবস্ত হলো। ফ্ল্যাট শব্দটি শুনলে কেমন যেন একটা অভিজাত ব্যাপার-স্যাপার মনে হতো। এখানকার ব্যাপারটি মোটেই তা নয়। ফ্ল্যাট বটে। তবে একেক রুমে কমপক্ষে ত্রিশ-চল্লিশজন মানুষ ওপর-নিচে অদ্ভুত ধরনের খাট বানিয়ে ঘুমায়। তা দেখে আমার গ্রামের মুরগির খোপগুলোর কথা মনে পড়ে। কিছুদিনের মধ্যে অনেকের একটু-আধটু বদান্যতায় একটি কাজও জোগাড় করা গেল। তারপর কাজে নেমে পড়লাম পুরোদমে। কাজে নেমেই বুঝলাম, এই শহর যতটা রঙিন, আমার চোখের স্বপ্ন যতটা রঙিন ছিল বাস্তবে প্রবাসজীবন বিন্দুমাত্রও ততটা রঙিন নয়। খুব ভোরে, ফজরের আজানের সাথে সাথে ঘুম থেকে ওঠে কাজে যেতে হয়। আর সারাদিন বিরামহীন খেটে চলা। বিশ্রাম বলে কোনো শব্দ নেই। বাবা খেতে কাজ করে দুপুরের তপ্তরোদে বাড়ি ফিরতেন। তারপর দক্ষিণের খোলা বারান্দায় একটি পাটি বিছিয়ে গভীর ঘুম দিতেন। এখানে আমার কাজের সময়ের হিসেব নেই। সকালে যথাসময়ে পৌঁছাতে হবে, সেটাই বাধ্যতামূলক। আর কাজ কবে যে শেষ হবে, তার হিসাব নেই। দিনে বার-চৌদ্দ ঘণ্টার পরিশ্রম শেষে বাসায় ফিরে রান্না করে খাওয়া, কাপড়-চোপড় ধোয়া থেকে সব কাজ নিজেকেই করতে হয়। বাড়িতে যে কাজে কোনোদিন হাতও দিইনি, সেসব এখন রুটিন কাজ। দিন নেই, রাত নেই। অসুখ-বিসুখের তোয়াক্কা নেই। গাধার খাটুনিতে মাস শেষে যে টাকা পাই তার একটি বড় অংশ বাসা ভাড়া আর খাবার বিল দিতে চলে যায়। বাকি টাকা মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিই। নিজের সাধ-আহ্লাদের জন্য অল্প টাকা জমিয়ে রাখব কিনা ভাবি, পরক্ষণেই মনে হয়, দরকার কী? টাকা কম গেলে বাবার তো কষ্ট হবে। কঠোর পরিশ্রম করি। নিজের জন্য মাস শেষে কিছুই থাকে না। একটা ভালো কাপড় কিনি না। তবুও মায়ের মুখ থেকে যখন শুনি, সবাই ভালো আছে ঘরে তখন মনটা ভালো হয়ে যায়। মনের কষ্ট আড়াল করে হাসিমুখে বলি, ‘আমি ভালো আছি, মা।’

প্রবাসে দিন যতই বাড়ছেÑদেশের সবার জন্য, সবকিছুর জন্য মন ততই পুড়ছে। গ্রামের নির্মল প্রকৃতিতে মিশে কাটানো মায়াভরা শৈশব, স্কুল-কলেজের বন্ধুবান্ধব, গ্রামের সাঁতার কাটা পুকুরটি, ঘরের পেছনে বিস্তৃত সবুজ ধানখেত,  আইল ধরে হাঁটা, ধান ওঠে গেলে ফুটবল খেলায় মেতে ওঠা, নদীর চরে বাদাম চাষ, ঘরের গাছের আম-জাম পেড়ে খাওয়ার স্মৃতি ক্ষণে ক্ষণে মনের মাঝে উদয় হয়। ইচ্ছে করে এখনই ছুটে যাই শৈশবের সেই বালুকাবেলায়। মায়ের মুখটি মানসপট থেকে সরাতেই পারি না। আর যখন কাজ করতে গিয়ে ঘর্মাক্ত শরীরের ফিরি তখন বাবার সেই ঘামঝরা গতরের দৃশ্যটি চোখে ভেসে ওঠে।

এভাবেই কাটতে লাগলো প্রবাসজীবন। টাকা পাঠাই। ভাইয়েরা পড়ালেখা করছে। বাবা পরিশ্রমের কাজ থেকে মুক্তি পেয়েছে। মায়ের আক্ষেপ ঘুচেছে। অনেক কিছুই বদলে যাচ্ছে। মন কাঁদে। কিন্তু দেশে যাওয়ার পথ খুঁজে পাই না। অসঙ্গতিতে আটকে আছে জীবন। আমি টাকা পাঠাই বলেই ভাইয়েরা পড়ছে, বোনগুলো বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে, তাদের বিয়ে দিতে হবে, সে জন্য কিছু কিছু টাকা জমানোর চেষ্টা করি। এর মধ্যে ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ায় রিনিউ করতে টাকা লাগছে। ছোটভাই বায়না ধরে তার একটি মোটরসাইকেল দরকার। আমি ঘামভেজা টাকা পাঠিয়ে তার শখ পূরণ করিÑএভাবে নানা চাহিদা মেটাতে মেটাতে দেশে যাওয়ার সুযোগ আসে না।

সময়ের সাথে দেশের ফোনকলগুলোর ধরনও বদলে যাচ্ছে। মা ফোন করেন, মাঝে মাঝে বাবা ফোনে কথা বলেন। বেশির ভাগ ফোনই নানা ধরনের চাহিদার কথা বলে। আশপাশে কেউ একটি জমি বিক্রি করে দিচ্ছে জেনে ছোটভাই ফোন দিয়ে বলে, ভাই জমিটা কিনে নেন। আমি টাকা পাঠাই, সে জমি কিনে নেয়। মা ফোন করে বলেন, তার এক মামাতো ভাই খুব অসুস্থ। তাকে কিছু সাহায্য যেন করি। আমি তা-ই করি। বোন ফোন দিয়ে বলে, তার স্বামীর একটা সমস্যা হয়েছে তাকে যেন কিছু টাকা ধার দিই। আমি তা-ই করি। এসব কাজে বড়ই তৃপ্তি পাই। মা সবাইকে বলে বেড়ান, আমার বড় ছেলেটা না হলে আমাদের দুঃখ কোনোদিন যেত না।

এভাবেই কেটে গেল প্রায় বারটি বছর। ক্ষণিকের জীবন থেকে এতগুলো বছর অনেক বড় সময়। তবুও কাজ শেষে কবুতরের খুপড়ির মতো খাটে ক্লান্ত দেহটা এলিয়ে দিয়ে যখন হিসেব করিÑএই জীবনে কি করতে পেরেছি, তার যে ফলাফল দেখি, তাতে নিজেকে বেশ সফল মনে হয়। বাবাকে খাটুনি থেকে মুক্তি দিয়েছি। ভাইদের পড়ালেখা করিয়েছি। বোনদের বিয়ে দিয়েছি। আর কিছু জমিজমা করেছি।

বাবা-মা, ভাইবোনদের জন্য বড্ড মায়া লাগছে। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছি না। দেশে এবার যাবই। তারপর, আরও অনেকদিন পর একদিন দেশে ফিরলাম। এতদিনে অনেক কিছুই বদলে গেছে। চিরচেনা গ্রামটি অনেক অচেনা লাগছে। আমাদের পরিবারের আগেরকার পরিস্থিতি আর এখনকার চালচলনে বেশ তফাৎ। বাবা-মায়ের মধ্যে অভিজাত ভাব দেখে বেশ আনন্দই পেলাম। কিছুদিন গ্রামে কাটানোর পর মনে হতে থাকলো, বিদেশের গাধার খাটুনি থেকে আমারও মুক্তি দরকার। বাবার জন্য মায়ের করা সেই আক্ষেপের বাক্যটি এখন নিজেকেই বিদ্ধ করছে। ভাবলাম, দেশেই একটা কিছু করি। কিন্তু কপাল যে আমার এতটা মন্দ, ভাবতেই পারিনি। ভাইদের কাছে পাঠানো টাকা আর জমিজমার হিসাব নিতে গিয়ে দেখলাম, আমার কিছুই নেই। টাকাগুলো সব নানাখাতে খরচে গেছে, জমিগুলো কেনা হয়েছে ভাইদের নামেই। এমন কেন জানতে চেয়ে উত্তর পেলাম, বাবার জমিটা বিক্রি করেই তো বিদেশে গিয়েছিলাম, সুতরাং জমি এখন অন্যেরা পাবে!

মনখারাপেরও একটা সীমা থাকে, আমার সে সীমা অতিক্রম করল। নিজেকে সংযত রাখার জন্য এই ঘর ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। গভীর রাত, বাইরে গভীর অন্ধকার, আমি বেরিয়ে পড়লাম।

অন্ধকার মাড়িয়ে হাঁটছি, আমার চোখ ভিজে যাচ্ছে।