বিআরটি সিস্টেমে নগরের যানজট নিরসন সম্ভব

সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরাম

নিজস্ব প্রতিবেদক
হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হচ্ছে কিন্তু যানজট কমছে না, জলজট নিরসন হচ্ছে না, কমছে না বায়ুদূষণ। এগুলো হলো প্রাতিষ্ঠানিক অক্ষমতারই অনিবার্য পরিণতি। কী করে বেশি মানুষ কম বিনিয়োগে, কম যানবাহনে, কম জায়গায়, কম খরচে, স্বল্প সময়ে, আরামে ও নিরাপদে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত করতে পারবে সেটা নিয়ে দীর্ঘ বছর গবেষণা চালিয়েছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের গবেষণার ফসল বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) সিস্টেম। সিম্পল ট্র্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও ডেডিকেটেড বাস লেইন করে চট্টগ্রাম নগরের যানজট সমস্যার সমাধান সম্ভব এবং তা আগামী একমাসের মধ্যে শুরু করা যায় বলে তথ্য দিয়েছেন ‘পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরাম’।
গতকাল রোববার সকালে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে ‘বন্দর নগরী চট্টগ্রাম-যোগাযোগ ভৌত অবকাঠামো কোন পথে’ শিরোনামে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দর খান। লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ফোরামের সহসভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া।
লিখিত বক্তব্যে তিনি ‘চট্টগ্রাম নগরের যানজট কমাতে প্রথম ধাপেই অত্যাধুনিক ব্যয়বহুল মেট্রোরেল সিস্টেমে (ঘণ্টায় যাত্রী পরিবহন সক্ষম ৬০ হাজার) যাওয়ার আগে বিকল্প সাশ্রয়ী ব্যবস্থায় নেওয়া যায়। এ সুপারিশগুলো ১৯৯৫, ২০০৮ এবং ২০১৮ সালের মাস্টারপ্ল্যাগুলোতে দেওয়া ছিল। যেমন ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, যানবাহন ব্যবস্থাপনা (টিডিএম), গণপরিবহন বাসের জন্য আলাদা (ডেডিকেটেড) লেইন করা, ফুটপাত ব্যবস্থাপনা, জাংশান ডিজাইন সংস্কার ও ব্যবস্থাপনা, বিদ্যমান সড়কের শতভাগ ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং ট্রাফিক আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা। এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করলে প্রতিঘণ্টায় গণপরিবহন বাসের (আলাদা লেইনে) মাধ্যমে ৯ হাজার থেকে ১৭ হাজার (২০৩০ সালের প্রজেক্টেড যাত্রী) যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব। আর সঠিকভাবে পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করলে আরও অনেক বেশি যাত্রী প্রতিঘণ্টায় প্রতিলেইনে পরিবহন করা সম্ভব। স্বল্প খরচে যানজট থেকে জনগণ পাবে মুক্তি। সড়কে ফিরবে শৃঙ্খলা।
সুভাষ বড়ুয়া বলেন, ‘রাজধানী ঢাকার জন্য যা প্রযোজ্য চট্টগ্রামে তা হুবহু প্রযোজ্য নাও হতে পারে। মেট্রোরেল সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ করতে সময় লাগবে ২-৩ বছর। তারপর সমীক্ষার ভিত্তিতে মেট্রোরেল ডিজাইন, প্রশিক্ষন, অনুমোদন, নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে আরও সময় লাগবে কমপক্ষে ৬ থেকে ৭ বছর। অর্থাৎ মেট্রোরেল সম্পন্ন হতে কমপক্ষে সময় লাগবে ১০ বছর। এই দশ বছর কী চট্টগ্রামবাসী অসহনীয় যানজটে দিনাতিপাত করবে?
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ‘১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম মহানগরের জন্য ইউএনডিপি‘ অর্থায়নে চারটা মাস্টারপ্ল্যান স্ট্রাকচারপ্ল্যান করা হয়। আরবান ডেভেলাপমেন্ট প্ল্যান, চট্টগ্রাম স্ট্রাকচার প্ল্যান, দীর্ঘ মেয়াদি ট্রাফিক অ্যান্ড ট্রান্সপোর্টেশন প্ল্যান এবং (৪) স্টর্মওয়াটার ড্যানেজ ও বন্যানিয়ন্ত্রণ মাস্টারপ্ল্যান। তারপর ২০০৮ সালে করা হয় চট্টগ্রামের ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান। এরপর ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাংক চট্টগ্রাম স্ট্র্যাটেজিক আরবান ট্রান্সপোর্ট মাস্টার প্ল্যান করে। মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে যে প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো এবং সক্ষমতা অপরিহার্য সে রকম অবকাঠামো এবং সক্ষমতা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) ছিল না এবং এখনও নেই। এ সত্যটুকু উপলব্ধি করে ১৯৯৫ সালের মাস্টার প্ল্যানে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল। শুধু তাই নয় আইনগতভাবে চউককে (চট্টগ্রাম প্লানিং অ্যান্ড ডেভেলামেন্ট অথরিটি- সিপিডিএ) প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করার লক্ষ্যে একটা বিলও তৈরি করে দেয়া হয়েছিল। দুর্ভাগ্য আজ অবধি এই প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করার প্রয়োজনীয়তা কেউ উপলব্ধি করেনি। কিন্তু উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেমে থাকেনি। বরং বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনার প্রক্রিয়াকে তোয়াক্কা না করে, মাস্টার প্ল্যানের সুপারিশ বাদ দিয়ে ইচ্ছামত বিশাল অংকের ভৌত অবকাঠামো (উড়াল সড়ক) উন্নয়ন চলছে যা মাস্টার প্ল্যানে সুপারিশ করা হয়নি।’
এতে উল্লেখ করা হয়, বন্দরনগর চট্টগ্রামে রাজধানী ঢাকার মত লোকসংখ্যা নেই। ঢাকা নগরীর লোকসংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ ৭৮ হাজার ৮৮২ (জনসংখ্যা জরিপ ২০২২, বাস্তবে দুই কোটির উপর)। ঢাকার জনঘনত্ব বিশ্বে ৪র্থ স্থান অধিকার করেছে। বন্দরনগর চট্টগ্রামের লোক ৩২ লাখ ২৭ হাজার ২৪৬ (জনসংখ্যা জরিপ ২০২২, বাস্তবে প্রায় ৭০ লক্ষ)। রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন যাত্রী ট্রিপ হয় ২১ মিলিয়ন। আর চট্টগ্রাম নগরে প্রতিদিন যাত্রী ট্রিপ হয় ৬.৭ মিলিয়ন যা ২০৩০ সালে হতে পারে ১০.৪ মিলিয়ন ট্রিপ। বর্তমানে বন্দর নগরে প্রতিদিন ট্রাক ট্রিপ হয় ৩৫,০০০ আর ২০৩০ সালে হবে ১১৩,০০০ । বন্দর নগরের একমাত্র সিডিএ এভিনিউ সড়কে ২০১৭ থেকে ২০৩০ সালে পিকআওয়ারে সর্ব্বোচ্চ যাত্রী (প্রতিঘণ্টায় প্রতি ডাইরেকশনে) চলাচল করবে ৯,৫০০ থেকে ১৭,০০০ (২০১৮ সালের বিশ্বব্যাংকের চট্টগ্রাম স্ট্র্যাটেজিক আরবান ট্রান্সপোর্ট মাস্টার প্ল্যানের সমীক্ষার তথ্য)। বন্দরনগরীতে যানবাহনের চিত্র : বাস-মিনিবাস ৮%, প্রাইভেটকার ১০%, বেবি ট্যাক্সি ৩৯% এবং রিকশা ৪৩% ।
পরিশেষে বলা হয়- সরকার কিভাবে জনগণের করের টাকা ব্যয় করে তা তদন্ত করার জন্য একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। এর ফলে কোনো টাকা অপচয় হবে না। একই সাথে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ফোরামের সহসভাপতি প্রকৌশলী এবিএম এ বাসেত, স্থপতি আহমেদ জিন্নুর, বিধান বড়ুয়া, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তাসলিমা মুনা, সদস্য ড. জসিম উদ্দিন, তানভীর পিয়াল প্রমুখ।