প্রধান সড়কেও চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশা

অধিকাংশ চালক অদক্ষ ও কিশোর
শতাধিক অলিগলিতে দাপিয়ে চলছে

রাজিব শর্মা
কোন ধরনের নিয়মনীতির বালাই ছাড়া নগরজুড়ে বেড়ে চলেছে ফিটনেসবিহীন ব্যাটারিচালিত রিকশা, নসিমনের আধিপত্য। ছোটবড় প্রায়সকল রাস্তা তাদের দখলে। এ যানবাহনের বেপরোয়া গতির কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। তবুও চলছে এই বাহনটি।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিগত কয়েক বছরের তুলনায় ব্যাটারিচালিত এমন রিকশা বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। অলিগলি দখল করে এখন নগরীর প্রধান সড়কও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই বাহন। কোন কোন স্থানে ট্রাফিক প্রশাসনের কড়াকড়ি নিষেধাজ্ঞা দেখা গেলেও প্রতিবন্ধী এবং বয়স্ক হওয়ায় মানবিক কারণে পার পেয়ে যাচ্ছেন অনেক চালক। তবে ব্যস্ত সড়কে বিপজ্জনক এই যানটি এখন দুর্ঘটনার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শনি ও রোববার নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নগরীর শতাধিক অলিগলি ব্যাটারিচালিত রিকশা ও নসিমনের দখলে। যে বাহনের চালকদের কোন ধরনের প্রাইমারি শিক্ষা, ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ বা যানবাহন চালানোর দক্ষতা নেই। করোনা সংকটের পরবর্তীকালীন অনেকজন তাদের পেশা পরিবর্তন করে অল্প সময়ে অধিক আয়ের আসায় ঝুঁকেছে এ পেশায়। অদক্ষতা ও প্রশিক্ষণবিহীন চালকের কারণে প্রতিদিন দূর্ঘটনা বেড়েই চলছে। তাছাড়া নগরীর বাকলিয়া থানা অধীনে কালামিয়া বাজার থেকে টেরীবাজার, বাকলিয়া রাস্তার মাথা থেকে চকবাজার, কোরবানিগঞ্জ, বউবাজারসহ, চাঁদগাও থানার বহদ্দারহাট থেকে কালুরঘাট, ষোলশহর, এক কিলোমিটার রাস্তার মাথা, কোতোয়ালি থানার মোড় থেকে চকবাজার, আন্দরকিল্লা থেকে জামালখান মোড় হয়ে কাজির দেউড়ী, নিউমার্কেট থেকে এনায়েতবাজারসহ শতাধিক রাস্তা ব্যাটারিচালিত রিকশা ও নসিমন চালকদের দখলে।
ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের উপকমিশনার মো. নাছির উদ্দিন বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত রিকশা বা নসিমন যেন শহরের প্রধান সড়কগুলোতে উঠতে না পারে তার জন্য আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। তবুও তারা প্রশাসনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। আমাদের চোখে পড়লে তাদের ব্যবস্থা নিচ্ছি।
সম্প্রতি নগরীর টাইগারপাস, আমবাগান, ঝাউতলা, হালিশহর, অক্সিজেন, বায়েজিদ, শেরশাহ কলোনি, পলিটেকনিক্যাল, হাইলেভেল রোড সিটি গেইট, বাদুরতলা চকবাজার ফ্রি-পোর্ট, বিটেক, বন্দর টিলা, বাংলাবাজার, কলসি দিঘীর পাড়, ছোটপোল, বড়পোল, লালখানবাজার, মতিঝর্না, বন্দরটিলা, বন্দর হালিশহর থানা পাহাড়তলি থানার এক অংশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্যাডেল রিকশা ও নসিমনে মোটর ও ব্যাটারি লাগিয়ে চলাচল করছে। প্রতিটি এলাকায় মোড় দখল করে নিয়েছে বাহনটি। যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে বাড়তি ভাড়াও। আগে ট্রাফিক বিভাগ অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা বা নসিমন আটক করলেও এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনেই দাপিয়ে চলাচল করছে এই বাহনটি।
নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সমন্বয় না থাকায় প্রতিদিনই এই বাহনটির সঙ্গে অন্য বাহনের সঙ্গে ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। পাশাপাশি সড়কে সৃষ্টি হচ্ছে বিশৃঙ্খলা আর যানজট। তবে এমন বাস্তবতা অবশ্য অস্বীকার করেছেন ট্রাফিক প্রশাসন। রাস্তায় দেখা মাত্রই ব্যবস্থা নিচ্ছেন বলে দাবি তাদের।
ট্রাফিক পশ্চিম বিভাগের বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার তারেক মাহমুদ বলেন, ‘হাইকোর্টের একটি রিট আছে যে ব্যাটারিচালিত রিকশা, নসিমন, করিমন কোনটায় মহাসড়কে চলাচল করতে পারবে না। কিন্তু অলিগলিতে এসব বাহন চলতে পারবে এমন কোন আদেশও নেই। তবুও চালকরা ওই যানবাহন চালাচ্ছে। আমাদের ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযান চলমান রয়েছে। রোডে দেখলেই তাদের বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা নিচ্ছি।
কালামিয়া বাজার থেকে টেরী বাজার আসা মো. ফারুক নামের এক যাত্রীর সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন এই রাস্তায় দুয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটে। এখানে যারা গাড়ি চালায় তাদের মধ্যে ১৪-১৭ বছর বয়সী কিশোরদের সংখ্যা বেশি। অনেকসময় একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা দিয়ে গাড়ি চালায়। এসব গাড়ি চালানো, নিয়ন্ত্রণ করা ও রোড সিগন্যাল বুঝার জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হলেও এসব চালকদের কোন ধরনের প্রশিক্ষণ নেই। বস্তিতে বেড়ে উঠা কিশোররা এসব গাড়ি চালাচ্ছে। তাছাড়া পায়ে বা মোটরচালিত যানটি চলা মানেই বিপদ বেড়ে যাওয়া। প্রশাসনের এসব বিষয়ে নজর রাখা প্রয়োজন।
বন্দর ট্রাফিক বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত রিকশা বা নসিমন নগরীর প্রধান সড়কে চলাচল করা পুরোপুরি নিষিদ্ধ। প্রধান সড়কে এসব যান চলাচল করে না। তারা অলিগলিতে চলাচল করে। তবে কোথাও প্রধান সড়কে চললে চালক ও মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। মাঝে মাঝে গাড়িগুলোকে ডাম্পিংও করা হয়। তবে নগরীতে কি পরিমাণ ব্যাটারিচালিত রিকশা, নসিমন রয়েছে আমার জানা নেই। কারণ দিন দিন তো এসব বাড়ছে। নির্দিষ্টভাবে বলাও যাবে না। তবে আমরা যানজট নিরসনে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের প্রতি নজরদারি রেখেছি।’
চকবাজার ও বাকলিয়া থানা এলাকার কয়েকজন অটোরিকশা চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওইসব এলাকায় অলিগলিতে অনেক অটোরিকশা গ্যারেজ রয়েছে। সেখান থেকে দিনচুক্তি ভাড়া দেন রিকশা মালিকরা। কোনো কোনো রিকশা দিনে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া জমা দিয়ে থাকে। ওইসব রিকশা আগে গলির মধ্যে চলাচল করত। কিন্তু করোনা মহামারির সময় থেকে ব্যাটারিচালিত এই অটোরিকশা অলিগলি থেকে বের হয়ে প্রধান সড়কেও চলাচল শুরু করেছে। এক্ষেত্রে পুলিশের আশ্রয়-প্রশয়ে কোনভাবে ম্যানেজ করে গাড়ি চালানোর কথা জানান তারা।
রিকশাচালক মো. জাহাঙ্গীর উদ্দিন বলেন ‘রিকশা চালানো আমাদের কর্ম। এটা করে আমাদের পরিবার নিয়ে খেতে হয়। আমার মতন অনেক অটোরিকশা চালক আছে যারা রিকশা চালিয়ে পরিবার চালায়। আপনারা যদি এগুলো বন্ধ করে দেন তাহলে আমরা কীভাবে চলব? কাজ করতে না পারলে তো মানুষের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা করে খেতে হবে। আর প্যাডেল রিকশা চালানোর মতো শক্তিও আমার নেই।’
অটোরিকশা দুর্ঘটনার শিকার কালামিয়া বাজারের এক ব্যবসায়ী জানান, মাসখানেক আগে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল থেকে অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে বাসায় যাচ্ছিলেন অটোরিকশায় চড়ে। সে সময় রিকশাটি চকবাজার গোলজার মোড়ের সামনে দুর্ঘটনায় পড়ে। এতে তার স্ত্রী এবং কোলে থাকা মেয়ে আহত হন। তিনি বলেন, ‘রিকশাটি চালানোর সময় অস্বাভাবিক গতির কারণে চালক নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। অনেক দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। শুধু তাই নয়, ওইসব রিকশার চালকরাও অভিজ্ঞ নয়।’
চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী মো. ফয়সাল উদ্দিন ব্যাটারিচালিত রিকশায় করে চট্টগ্রাম চকসুপার মার্কেট থেকে আন্দরকিল্লা এসেছেন। যাতায়তের জন্য কেন এই অবৈধ এবং ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাটারিচালিত রিকশা ব্যবহার করলেন এ সম্পর্কে তিনি সুপ্রভাতকে বলেন, ‘একসময় অনেক পরিবারে বেকারদের অলস সময় পার করতে হতো। ব্যাটারিচালিত রিকশা গরিব মানুষসহ অনেক বেকার যুবককে স্বাবলম্বী করেছে। তা ছাড়া গতির কারণে সময় ও রিকশা ভাড়া কমেছে। অটোরিকশায় যে ভাড়া ১০ টাকা প্যাডেলচালিত রিকশায় তা ২০ বা ৩০ টাকা। তা ছাড়া এই গরিব মানুষগুলো চড়া সুদে কিস্তি নিয়ে রিকশা কিনেছে, বন্ধ করে দিলে তাদের পথে বসতে হবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অদক্ষতার কারণে কখনো চালক কখনো বা পথচারী শিকার হন দুর্ঘটনার। বেপরোয়া চলাচলে তীব্র যানজট সৃষ্টির অন্যতম কারণ ব্যাটারিচালিত রিকশা। এজন্য ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। তাছাড়া এসব যানে ব্যবহৃত হচ্ছে বৈধ ও অবৈধ বিদ্যুৎ। এভাবে কয়েক লক্ষ ব্যাটারি চার্জ দেওয়া হচ্ছে গ্যারেজে। এতে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। আর লাভবান হচ্ছে অসাধু অটো-রিকশা মালিকরা।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সহকারী স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ আবদুল্লাহ আল ওমর বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা বা অন্য কোন ইলেকট্রিক যানবাহন চালানোর সুবিধা ও অসুবিধা দু’টিই রয়েছে। প্রথমত রাতের অফপিক আওয়ারে বিদ্যুৎ দিয়ে গাড়িগুলো চার্জ দেওয়া হয় তা দিনে চলে। সাধারণত অফপিক আওয়ারে বিদ্যুৎ ব্যবহার না করলে তা যে রিজার্ভ থাকবে তা নয়। অন্যদিকে এসব গাড়ির কারণে নিয়মিত যানজট, দুর্ঘটনার মত ঘটনা আমরা দেখি। সাধারণত এসব গাড়িকে ফিটনেসবিহীন হিসেবে গন্য করা হয়। তাছাড়া এসব গাড়ির ব্যবহারে আইন থাকা জরুরি বলে মনে করছি।