পুণ্যের জোয়ার আনে মাহে মুবারাক

হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »

মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহ্ তাআলার জন্যই সমস্ত প্রশংসা, যিনি তাঁর অসংখ্য সৃষ্টি হতে নিজ প্রতিনিধিত্বের জন্য ইনসানকেই বেছে নিয়েছেন। তাঁর পবিত্রতার জয়গান করি, যিনি তাঁর ইবাদতের জন্য পবিত্রতার শর্ত আরোপ করেছেন। তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি, যিনি তাঁর নৈকট্য, প্রেম ভালোবাসা অর্জনের জন্য আমাদের ওপর রোযা ফরয করেছেন।
আল্লাহ্ এক, অদ্বিতীয়, একমাত্র উপাস্য। তাঁর ইবাদতে কারো কোন অংশীদারিত্ব নেই। তাঁর কোন মুখাপেক্ষিতা নেই। সমগ্র সৃষ্টিকূলের তিনিই ¯্রষ্টা। সৃষ্টির রিয্ক তিনি দিয়ে থাকেন। আমাদেরকে তাঁর পথে আহ্বানকারী, সত্যের দিশারী, মুক্তির কা-ারী সায়্যিদুনা হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র প্রিয়তম বান্দা ও তাঁর শ্রেষ্ঠতম রাসূল।
আল্লাহ্ তাআলা মাহে রমাদ্বানের আরো একটি জুমাআর জন্য আমাদেরকে এ জীবনের অবকাশ দিয়েছেন, তাঁর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। এটি এমন এক মাস, যা সারাজীবনে একবার পেলে আল্লাহ্র বিশ্বাসী বান্দা জাহান্নাম থেকে মুক্ত হয়ে যায়। হযরত কা’ব বিন আজরা (রাদ্বি.) বর্ণিত এক হাদীসে রয়েছে, জিব্রাঈল (আ.) যখন এ দুআ করলেন, ‘যে ব্যক্তি মাহে রমাদ্বানের মতো মাস পেয়েও নিজের মাগফিরাত (সমস্ত পাপের ক্ষমা) করাতে পারল না, সে লোক ধ্বংস হোক’। তখন মিম্বরে দাঁড়ানো অবস্থায় নবীজি বললেন, ‘আমীন’। পরবর্তী অংশে তেমনি আরো দু’টি দোয়ায়ও তিনি ‘আমীন’ বলেছেন। একটি হল, যে আমার নাম শুনে দরূদ পড়েনি সেও ধ্বংস। আরেকটি হল, মাÑবাবা উভয়কে বা একজনকে পেয়েও যে তাঁদের সেবা করে জান্নাতে যেতে পারল না, সে ধ্বংস। (হাকেম)
মাসটির ফযীলত, রহমত যাতে হাতছাড়া না হয়, সে লক্ষ্যে থাকতে হবে সতর্ক প্রতীক্ষায় প্রতিক্ষণ। নিদেনপক্ষে গুনাহ্র কাজ থেকে প্রাণপণে মুক্ত রাখতে হবে নিজকে। তাহলেও পবিত্রতা রক্ষা হয় এ মাসের। এ ছাড়া রোযাদার সুবহে সাদেক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোযা মুখে থাকে বলে সারাক্ষণ সে ইবাদতই থাকে। মনে রাখা জরুরি, অন্য ইবাদত পালনকালীন কেউ পাপে প্রবৃত্ত হতে পারে না। কাজেই রোযার হালত ইবাদতেই। তবে কেন পাপÑপ্রবৃত্তি? রোযা এমন এক ইবাদত, যা বান্দাকে আল্লাহ্র কাছে প্রিয় করে তোলে। রোযাদার বান্দাকে আল্লাহ্ এতটাই পছন্দ করেন যে, রোযাদারের মুখের গন্ধও আল্লাহ্র নিকট মেশ্কে আম্বর’র চেয়ে সুগন্ধময় বিবেচিত। কাজেই, আল্লাহর রাসূল ইরশাদ করেন, তোমাদের কেউ যখন রোযা রাখে, সে যেন না কোন অশ্লীল কথা বলে। না কোন পাপ কাজে লিপ্ত হয়, না কোন রূপ জাহেলী আচরণ করে। বরং কেউ যদি গালিগালাজ করে বা তোমার সাথে কলহ বাঁধাতে আসে তবে তাকে এটা বলো যে, নিঃসন্দেহে আমি রোযাদার’। (মুসলিম শরীফ)
সুরা বাকারার ১৮৫তম আয়াতের নির্দেশনা আমাদের প্রায় সবারই জানা। এতে ইরশাদ হয়েছে, ‘মাহে রমাদ্বান, যাতে নাযিল করা হয়েছে আল্কুরআন, মানুষের জন্য হেদায়ত এবং সঠিক পথ প্রদর্শনের সুস্পষ্ট প্রমাণাদি এবং সত্যÑঅসত্যের মাঝে পার্থক্যকারী। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাসে উপস্থিত থাকে, সে যেন মাসটিতে রোযা পালন করে’। এ নির্দেশ স্বয়ং আল্লাহর। তাই, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাসী মাত্র এ হুকুম মেনে চলবে। যা ফরযে আইন।
ফরয রোযা পালন করতে আমরা সাহরি- ইফতার গ্রহণ করি। রাসূলে কারীম’র তা’লীমে এগুলো গ্রহণ করলে তাও নিঃসন্দেহে অনেক অনেক সওয়াবের।
কারণ, দ্বীন নবীজির অনুসরণ বৈ কিছু নয়। একটা কথা অনস্বীকার্য এবং অবশ্যই মনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ্র কাছে তাঁর সকল সৃষ্টির চেয়েও প্রিয়তম হলো তাঁর রাসূল। এ জন্য তাঁর ভালবাসাই মূলত ঈমান। রাসূল’র চলাফেলা, উঠাÑবসা, নাওয়াÑখাওয়া সবকিছুই আল্লাহ্র কাছে অধিকতর প্রিয়। তাই তাঁর অনুসরণে উম্মত যা কিছুই সম্পন্ন করবে, সবই আল্লাহ্র কাছে পছন্দনীয় হবে। এটাই যৌক্তিক।
মাহে রমাদ্বান ইবাদতের মওসুম। এর ঘড়ি ঘড়ি, লহমা, সেকেন্ড, প্রতি মুহূর্ত রহমতে পুর্ণ। হযরত আবু হুরায়রা (রাদ্বি.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন, যখন মাহে রমাদ্বানের প্রথম রাতের আগমন হয়, শয়তানদের বন্দি করা হয় এবং বিতাড়িত জ্বিনদেরও। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় আর বেহেশতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়, তন্মধ্যে একটি দরজাও বন্ধ করা হয় না। একজন আহ্বানকারী এভাবে আহ্বান দিতে থাকেন, ‘হে কল্যাণের সন্ধানী, আগোয়ান হও। আর হে অকল্যাণÑসন্ধানকারী, সংযত হয়ে যাও। আল্লাহ কত জনকে যে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন’। এ আহ্বানের ধারা চলবে প্রতিটি রাত। (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ্) বাস্তবিকই আমরা দেখি, এ মাসের আগমন হলে মুসলিম নরÑনারীর মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি অনেক বেশি সক্রিয় হয়। ইবাদত বন্দেগির প্রেরণা তুলনামূলক বেশি দেখা যায়। ব্যবহারিক জীবনে দেখা যায়, তাঁরা অনেক বেশি সদাচরণ ও সহমর্মিতার অনুশীলন করেন। এ প্রবণতা যদি বারো মাস উজ্জীবিত থাকতো, তবে তো স্বর্গ নেমে আসতো আমাদের এ ঘুণেধরা সমাজে।
হযরত সালমান ফারেসী (রাদ্বি.) বর্ণিত এক হাদীসে রয়েছে, আল্লাহ্ তাআলা এ মাসের সিয়ামকে ফরয করেছেন এবং এর রাতে নামাযে দাঁড়ানোকে করেছেন স্বতঃপ্রণোদিত সুন্নাত আমল। রোযা তো আছে সারাদিন ব্যাপী ফরয ইবাদত। পাপ কার্যাদি থেকে বেঁচে থাকলে রোযাদার সর্বাবস্থায় থাকেন ইবাদতে। রাতে ইশা’র নামাযান্তে এ মাসের বিশেষ ইবাদত হল তারাভীহ্র নামায।
হযরত আবু হুরায়রা (রাদ্বি.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (দ.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঈমান সহকারে সওয়াবের প্রত্যাশায় মাহে রমাদ্বানের রোযা রাখে, তাঁর পূর্ববর্তী গোনাহ্সমূহ ক্ষমা করা হয়। অনুরূপ যে ব্যক্তি এ মাসের রাতের বেলা ঈমান ও নিষ্ঠাসহ নামাযে দাঁড়ায় তাঁর পূর্ববর্তী গোনাহ্ মাফ করে দেওয়া হয়। (নাসায়ী) এ নামাযই তারাভীহ্র নামায।
তারাভীহ্র নামায সুন্নাতে মুআক্কাদাহ্। এ সিদ্ধান্তে সাহাবায়ে রাসূল’র সর্বসম্মত ইজমা’ বা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত। জামাতসহ পড়া মুআক্কাদা আলাল কিফায়াহ। রাসূলুল্লাহ্ এ নামায পড়েছিলেন। নবীজির ইরশাদ, আল্লাহ্ পাক তোমাদের উপর রমাদ্বান’র রোযা ফরয করেছেন। আর আমি তোমাদের জন্য রমাদ্বান’র (রাতে তারাভীহ্র নামাযে) দাঁড়ানোকে সুন্নাত ঘোষণা দিলাম। (নাসায়ী, ইবনে মাজাহ্) ইমামে আ’যম (রা.) এ নামায পুরুষ-মহিলা সবার জন্য সুন্নাতে মুআক্কাদা’ সাব্যস্ত করেছেন। দৈনিক ফরযÑবিতর’র রাকাআত সংখ্যা ২০, রমাদ্বানের রাতে এর সমসংখ্যক রাকাআত নামায পরিপূরক সংখ্যায় ২০ হওয়া অধিকতর যুক্তিযুক্ত। এ নামাযে ন্যূনপক্ষে একবার কুরআন খতম করাও সুন্নাত। এ নামাযও তেলাওয়াতে কুরআন মাহে রমাদ্বানের অন্যতম আকর্ষণ।
আমরা জানি, পবিত্র কুরআন, এ মাসে নাযিল হয় এবং কদরের রাতে। বলা যায়, এটি কুরআন’র মাস, কদরের মাস। কুরআন ও শবেকদর দুটিই যে মাহে রমাদ্বানের তোহ্ফা। এত এত রহমত’র সওগাত নিয়ে আসে এই একটি মাস। প্লাবন যেভাবে দু’ কুল ছাপিয়ে যায়, আনে পলি, ঊর্বরতা, জোয়ার নিয়ে আসে শ্যামল সজীবতা, তেমনি রমাদ্বান একটি মাসেও পুণ্যের জোয়ার আসে। আসে মুমিনের দু’কুল ছাপিয়ে। তাই, বছরব্যাপী কত বান্দা এ মাসটির প্রতীক্ষায় দিন গোনে, কবে আসছে ইবাদত, রহমতের ভরা মওসুম, মাহে মুবারক।

লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।